গৌতম রায়
ভারতীয় উপমহাদেশে বিশ শতকে সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রে সুফিয়া কামাল এক ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব। কেবলমাত্র নারী জাগরণের প্রেক্ষিতেই সুফিয়া কামালের কর্মকাণ্ড আবর্তিত হয়নি। প্রত্যক্ষভাবে কখনো কোনো দলীয় রাজনীতির বৃত্তে অবস্থান না করেও, রাজনীতির সঠিক প্রয়োগের ভেতর দিয়ে, ভারতীয় উপমহাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াইতে সুফিয়া কামাল এক ঐতিহাসিক অবদান রেখে গেছেন।
গোটা ভারতীয় উপমহাদেশে আজ যখন গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ একটা বড় রকমের সংকটের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, এইরকম একটা সময়ে, সামাজিক ক্ষেত্রে, বহু প্রেক্ষিতে ভেতরেও গণতন্ত্র রক্ষার প্রশ্নে সুফিয়া কামালের যে ভূমিকা, সে বিষয়টি পর্যালোচনা ,এক বিশেষ রকমের প্রাসঙ্গিকতার দাবি রাখে।
গোটা ভারতে আজ গণতন্ত্র এক ভয়াবহ সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে আছে। পশ্চিমবঙ্গে আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনকে ঘিরে গণতান্ত্রিক পরিবেশ এমন একটা জায়গায় এসে পৌঁছেছে যে, একজন সাধারণ মানুষ দ্বিধাহীন চিত্তে ,নিজের রাজনৈতিক ইচ্ছাকে প্রকাশ করতে ভয় পাচ্ছেন। শাসকের তাঁবেদার না হলে, শাসক তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রযন্ত্রের পেষণ ক্রিয়ার সবকটি পর্যায়েকেই ব্যবহার করছে।
বাংলাদেশের যে সুস্থ গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ পরিবেশ রয়েছে, তাকে বিঘ্নিত করে, হানাদার পাক বাহিনীর সমর্থকদের শাসনপাটে বসিয়ে, গোটা বাংলাদেশকে, আবার অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া পাকিস্তানের ছায়া উপনিবেশে পরিণত করবার জন্য সে দেশের ভেতরে এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের অঙ্গুলি হেলনে ,নানা ধরনের ষড়যন্ত্র চলছে। পাকিস্তান, মায়ানমার ,শ্রীলংকা, কোনো দেশেই আজ সুস্থির গণতন্ত্রের কোনো লক্ষণ আমরা দেখতে পাচ্ছি না ।
এই অবস্থায় আমাদের বারবার মনে হয়, অবিভক্ত পাকিস্তানের আমলে, আইয়ুব খানের লোক দেখানো গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে, প্রকৃত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করবার জন্য যে অসম সাহসিকতার সঙ্গে সুফিয়া কামাল, তাঁর সহযোগীদের নিয়ে আন্দোলন চালিয়েছিলেন, সেই ঘটনাক্রমের কথা। আইয়ুব খান বিরোধী উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ,বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা-- সমস্ত প্রেক্ষিতেই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান, আজকের বাংলাদেশের ,নারী সমাজকে সংঘটিত করবার ক্ষেত্রে , কখনো কোনো রকম দলীয় বৃত্তের মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ না রেখে , গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য সুফিয়া কামাল যে সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, তা আজ গোটা ভারতীয় উপমহাদেশের গণতান্ত্রিক অস্থিরতার প্রেক্ষিতে বারবার আমাদের শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে হয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব নিজেও বহুবার বাংলাদেশের নারী সমাজকে, পশ্চিম পাকিস্তানের সার্বিক শোষণের বিরুদ্ধে সংগঠিত করবার ক্ষেত্রে সুফিয়া কামালের বিশেষ অবদানের কথা অত্যন্ত সশ্রদ্ধ চিত্তে স্মরণ করেছেন। আইয়ুব খানের 'বেসিক গণতন্ত্র 'নামক এক সোনার পাথর বাটি যখন পাকিস্তান তৈরির মূল উপাদান, 'মুসলিম জাতীয়তাবাদে'র কার্যত পরিপূরক হিসেবে, একটা বড় অংশের মানুষ ,যাঁরা ধর্মে বিশ্বাস করেন, কিন্তু ধর্মান্ধ নন ,তাঁদের ভেতরে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে, তখন ধর্মপ্রাণ সুফিয়া কামাল ,আইয়ুব খানের ,ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার সম্পর্কে মানুষকে, বিশেষ করে বাংলাদেশের নারী সমাজকে, সচেতন করবার ক্ষেত্রে যে ভূমিকা পালন করেছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে গোটা বাংলাদেশে নারী সমাজকে পাকিস্তানের অগণতান্ত্রিক ,সন্ত্রাসবাদী হানাদারিত্বের বিরুদ্ধে সামাজিকভাবে উদ্বুদ্ধ করার ক্ষেত্রে সুফিয়া কামালের যে ভূমিকা ও অবদান ,ভারতীয় উপমহাদেশে তার দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া ভার। সুফিয়া কামাল কখনো নিজেকে জাহির করে কোনোরকম রাজনৈতিক বা সামাজিক বা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড করেননি। অথচ তাঁর গোটা জীবনকালটাই ছিল একটা আন্দোলন অবিভক্ত ভারতে নিজের লেখালেখির ক্ষেত্রেই হোক, '৪৩ এর দুর্ভিক্ষের সময় কমিউনিস্টদের নেতৃত্বাধীন নারী আত্মরক্ষা সমিতির কর্মীদের সঙ্গে বর্ধমানে লঙ্গরখানা পরিচালনা ই হোক, '৪৬ এর দাঙ্গার পর, দাঙ্গাক্রান্ত মহিলাদের আর্থ-সামাজিক পুনর্বাসনের জন্য পার্ক সার্কাস অঞ্চলে হাতে কলমে কাজ করাই হোক ,বা পাকিস্তান তৈরির পর ,তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের সমস্ত ধরনের আর্থ-সামাজিক -সাংস্কৃতিক রাজনৈতিক কর্মকান্ডে নীরবে নিভৃতে ,সুফিয়া কামালের ভূমিকা, তা আজ গোটা ভারতীয় উপমহাদেশ জুড়ে ,গণতন্ত্রের এই সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে , সেই ভূমিকার চর্চা এবং সেখান থেকে শিক্ষা নেওয়ার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব '৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে শাহাদাত বরণের পর ,পাকিস্তানের ছায়া উপনিবেশে পরিণত হয়ে বাংলাদেশের অবৈধ শাসকেরা, সেখানকার গণতন্ত্রের সমাধি রচনা করেছিল। সেই গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য আটের দশকের গোড়ায় ভারতের রাজনৈতিক আশ্রয় থেকে বাংলাদেশে ফিরে গিয়ে শেখ হাসিনার যে আন্দোলন সেই আন্দোলনকে সামগ্রিকভাবে প্রাসঙ্গিক করে তুলতে , সুফিয়া কামালের যে অবদান,তার জন্যে কোনো শব্দই বাংলা ভাষায়
স্বৈরাচারী এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের কালে, তৎকালীন বিরোধী নেত্রী শেখ হাসিনার লড়াইয়ের মূল শক্তি ছিলেন তাঁর 'ফুফু' সুফিয়া কামাল। পরবর্তীতে খালেদা জিয়া সরকার যখন জিয়াউর রহমানের আদলেই একের পর এক যুদ্ধাপরাধীদের পুনর্বাচিত করতে শুরু করে, ঘাতক দালালদের পুনর্বাচিত করতে শুরু করে , তখন সাধারণ মানুষকে, এই পাকিস্তানপ্রেমীদের সম্পর্কে সচেতন করে ,প্রকৃত গণতন্ত্র যাতে বাংলাদেশ কায়েম হতে পারে, সে লড়াইয়ের নেতৃত্বের মূল জায়গাটিতে কিন্তু সব সময় থেকেছেন সুফিয়া কামাল।
নয়ের দশকের গোড়ার দিকে, যখন ঘাতক দালালদের শাস্তির দাবিতে, গণ আন্দোলন ধীরে ধীরে দানা বাঁধতে শুরু করেছে ,তখনও সেই আন্দোলনের নেতৃত্বে থেকেই সুফিয়া কামাল, প্রাতিষ্ঠানিক নেতৃত্বভার তুলে দিয়েছিলেন শহীদ জননী জাহানারা ইমামের হাতে।
রাজনৈতিক দলগুলির কর্মকাণ্ড একটা রাজনৈতিক গতি প্রবাহ নিয়ে পরিচালিত হয়। কিন্তু সেই গতি প্রবাহের সঙ্গে সার্বিকভাবে সাধারণ মানুষের সংযোগ ঘটানোর প্রশ্নে, আদর্শবাদের ভিত্তিকে স্থাপিত করবার প্রশ্নে ,বুদ্ধিজীবী সমাজের একটা বিশেষ ভূমিকা থাকে। ভারতীয় উপমহাদেশে বাংলাদেশকে দিয়ে যে সামাজিক ভূমিকা সুফিয়া কামাল পালন করে গিয়েছেন, সেই ধারা, কেবলমাত্র বাংলাদেশের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয় ।
আজ পশ্চিমবঙ্গেও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের প্রশ্নে প্রকৃত মেরুদণ্ডসম্পন্ন বুদ্ধিজীবী সমাজের সেই ভূমিকা ,সেই ভূমিকায় ধর্মনিরপেক্ষ ,গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল রাজনৈতিক আন্দোলনের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার। এই হাতিয়ারের মাধ্যমেই একদিন পশ্চিমবঙ্গে গণতন্ত্র এই ফ্যাসিবাদের গ্রাস থেকে নিজেকে মুক্ত করে , মানুষের গণতন্ত্র হিসেবে নিজেকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে পারবে।
Comments :0