আপাতত গ্রেপ্তার করা যাবে না সীমা মুস্তাফা, সীমা গুহদের। বুধবার সুপ্রিম কোর্ট স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, আগামী ১১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মণিপুরে এডিটর্স গিল্ডের তথ্যানুসন্ধানী দলের কাউকে গ্রেপ্তার করা যাবে না।
মণিপুরের জাতি সংঘর্ষ নিয়ে ‘বিভ্রান্তিকর এবং পক্ষপাতদুষ্ট’ খবর প্রচারের অভিযোগে ‘এডিটর্স গিল্ড অব ইন্ডিয়া’ (ইজিআই)-র চার সদস্যের বিরুদ্ধে দু’টি এফআইআর দায়ের করলেও আপাতত সে রাজ্যের পুলিশ তাঁদের গ্রেপ্তার করতে পারবে না। বুধবার সুপ্রিম কোর্ট গিল্ডের সভাপতি সীমা মুস্তাফা এবং অন্য অভিযুক্তদের রক্ষাকবচ দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে। বুধবার প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়, বিচারপতি জেবি পারদিওয়ালা ও বিচারপতি মনোজ মিশ্রের বেঞ্চ জানিয়েছে, আগামী সোমবার পর্যন্ত অভিযুক্ত চার সাংবাদিকের বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ নেওয়া যাবে না। পাশাপাশি ওই সময়সীমার মধ্যে এফআইআর দায়েরের কারণ জানানোতে মণিপুর সরকারকে নির্দেশ দিয়েছে শীর্ষ আদালত।
প্রসঙ্গত, মণিপুরে লাগাতার যে জাতি সংঘর্ষ চলছে তাতে মিডিয়ার ভূমিকা খতিয়ে দেখতে রাজ্যে চার সদস্যের তদন্ত দল পাঠায় গিল্ড। গিল্ডের দল তা খতিয়ে দেখে বিশদ রিপোর্ট প্রকাশ করে। এতে জাতিগত সংঘর্ষে রাজ্য প্রশাসন থেকে রাজ্যের শাসক দল যে পক্ষপাতমূলক ভূমিকা পালন করে চলেছে তা উল্লেখ করে। তাতেই ক্ষিপ্ত হয়ে গিল্ডের দলের চার সদস্যের বিরুদ্ধে এফআইআই দায়ের করে তাদের গ্রেপ্তার করে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন মুখ্যমন্ত্রী। এই নির্দেশের বিরুদ্ধে এদিন সুপ্রিম কোর্টে মামলা দায়ের করে গিল্ড। সেই মামলায় গ্রেপ্তার থেকে সাময়িক আইনি সুরক্ষা পেয়েছে গিল্ড।
মণিপুরে গিল্ডের কণ্ঠ রোধের এই অভিযানের তীব্র নিন্দা করেছে বিভিন্ন সাংবাদিক ও সংবাদকর্মী সংগঠন। গিল্ড মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন্দ্র সিংকে এফআইআর প্রত্যাহারের আবেদন জানিয়ে চিঠি দিয়েছে। তাতে কোনও আমল দেননি সিং। উলটে সিং দ্রুত গিল্ডের মণিপুর তদন্ত দলের চার সদস্য গিল্ড সভানেত্রী সীমা মুস্তাফা, বরিষ্ঠ সাংবাদিক সীমা গুহ, ভরত ভূষণ, সঞ্জয় কাপুরকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেন। এদিন সকালেই সুপ্রিম কোর্টে মণিপুর সরকারের এই নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে এবং আইনি সুরক্ষার আবেদন জানিয়ে মামলা দায়ের করে গিল্ড।
এদিন গিল্ডের বরিষ্ঠ আইনজীবী শ্যাম দিওয়ান আদালতে জানান, গত ৭আগস্ট থেকে ১০ আগস্ট গিল্ডের চার সদস্যের দল মণিপুরে জাতি সংঘর্ষের ঘটনায় মিডিয়ার ভূমিকা খতিয়ে দেখতে রাজ্য সফর করে। মিডিয়া প্রতিনিধি, সেনা প্রতিনিধি, সাধারণ মানুষ সহ বিভিন্ন অংশের মানুষের সঙ্গে কথা বলেন। তার ভিত্তিতে গত ২সেপ্টেম্বর রিপোর্ট প্রকাশ করে। রিপোর্টে সামান্য কিছু তথ্যগত ত্রুটি থাকায় তা সংশোধন করে নেওয়া হয়। এদিকে রিপোর্ট প্রকাশের পর চার সদস্যের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করে তাদের গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিয়েছে মণিপুর সরকার। দিওয়ানর গিল্ডের বক্তব্য শুনে প্রাথমিকভাবে বেঞ্চ এতে গ্রেপ্তারে সাময়িক নিষেধাজ্ঞা জারি করে মণিপুর হাইকোর্টের এই মামলা দায়েরের কথা জানান। প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড় দিভানকে বলেন, আপনারা এনিয়ে সুপ্রিম কোর্টে সরাসরি এসেছেন কেন? এনিয়ে মণিপুর হাইকোর্টে মামলা দায়ের করে সুরক্ষার আবেদন জানানোর প্রস্তাব দেন। এই বক্তব্যে সমর্থন জানিয়ে মণিপুর সরকারের আইনজীবী কানু আগরওয়াল জানান,এই মামলা মণিপুর হাইকোর্টে হওয়া উচিত। গিল্ডের আইনজীবী দিওয়ান এতে মণিপুরের পরিস্থিতি ব্যখ্যা করেন। চন্দ্রচূড় এনিয়ে বেঞ্চের অন্য বিচারপতিদের সঙ্গে আলোচনা করেন। বিচারপতিরা এর পরই মত বদল করে জানান সুপ্রিম কোর্টে এই মামলার শুনানি হবে। পরবর্তী শুনানি হবে আগামী সোমবার। এনিয়ে মণিপুর সরকারকে তাদের বক্তব্য আদালতে পেশ করার নির্দেশ দেন বিচারপতিরা। তারা অন্তর্বর্তীকালীন নির্দেশে আরও জানিয়ে দেন, মামলা চলাকালীন মণিপুর সরকার গিল্ডের দলের চার সদস্যের বিরুদ্ধে কোনও দমনপীড়ন ব্যবস্থা বা গ্রেপ্তার করতে পারবে না।
এদিকে মামলা সম্পর্কিত মণিপুরের জাতি সংঘর্ষ নিয়ে মণিপুর রাজ্য সরকারের ভূমিকা নিয়ে গিল্ড তার প্রকাশিত রিপোর্টে স্পষ্ট জানিয়েছে, রাজ্যে জাতি সংঘর্ষের সময় পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে রাজ্য সরকার এতে এক জাতির হয়ে পক্ষপাতমূলক আচরণ করছে। জাতি সংঘর্ষের সময় সরকার ও প্রশাসনের এই পক্ষপাতমূলক আচরণ অবশ্যই এড়ানো দরকার। মণিপুরের একটি গণতান্ত্রিক সরকার জাতি সংঘর্ষের সময় সেই পক্ষপাতহীন নিরপেক্ষ সরকারের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। যাদের উচিত ছিল রাজ্যের সমস্ত জনজাতি আদিবাসীর জীবন জীবিকার সুরক্ষার ব্যবস্থা করা তা তারা পালন করেনি।
মণিপুরের মিডিয়ার ভূমিকা ব্যাখ্যা করে রিপোর্টে বলা হয়েছে, রাজ্যের আইন শৃঙ্খলার পরিস্থিতির এতোই অবনতি ঘটেছে যে কোনও সাংবাদিকের ঘটনা স্থলে দ্রুত যাতায়াত করার ব্যবস্থা নেই। যে কোনও খবর পেলে তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য প্রশাসনের কোনও সহযোগিতা মেলে না সাংবাদিকদের। ফলে শুধু মাত্র সরকারের বিবৃতির উপর নির্ভর করতে হয় সাংবাদিকদের। ফলে মিডিয়ার বড় অংশ কার্যত সরকারের ভাষ্য হয়ে গেছে। একই সঙ্গে রাজ্যসরকার রাজ্যে ইন্টারনেট পরিষেবা নিষিদ্ধ করে দেওয়ায় সাংবাদিকদের রাজ্যের বিভিন্ন তথ্য দ্রুত সংগ্রহের করা প্রায় অসম্ভব হয়ে গেছে। এই জটিল পরিস্থিতির মধ্যে আঞ্চলিক খবরে ভারসাম্য রেখে নিরপেক্ষ সংবাদ প্রকাশ কঠিন হয়ে পড়ছে। রিপোর্টে মণিপুর সরকারের জাতি সংঘর্ষে পক্ষপাতমূলক আচরণের উদাহরণ তুলে বলা হয়েছে,সরকারের পক্ষে একটা পরিষ্কার প্রচার করা হচ্ছে, কুকিরা বিদেশি, তারা রাজ্যে অনুপ্রবেশকারী। কোনও তথ্য প্রমাণ ছাড়াই সরকার থেকে সরাসরি এই জাতি বিদ্বেষের প্রচার চলছে। রিপোর্টে নির্দিষ্ট জনগণনার রিপোর্ট উল্লেখ করে বলা হয়েছে, ১৯০১ থেকে ২০১১ মণিপুরে অন্যা ন্য আদিবাসীদের জনসংখ্যা একেবারে বৃদ্ধি পায়নি।
এদিকে মণিপুর জাতি সংঘর্ষে মণিপুর বিজেপি সরকারের পক্ষপাতমূলক ভূমিকা গিল্ড ফাঁস করে দেওয়ায় ক্ষিপ্ত হয়ে পড়েছেন মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী সিং। তার নির্দেশে জাতি সংঘর্ষে প্ররোচনা সৃষ্টির ফৌজদারি অপরাধে একের পর এক অভিযোগ এনে এফআইআর দায়ের করা হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী সিং পুলিশকে এতে গিল্ডের চার সদস্যের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়ে সাংবাদিক সম্মেলন করেই জানিয়েছেন, ‘গিল্ডের দলের সাংবাদিকরা হলো রাষ্ট্রবিরোধী, রাজ্য সরকার বিরোধী, রাজ্যের মানুষের স্বার্থ বিরোধী। এই দল এখানে এসেছিল সরকারের বিরুদ্ধে বিষ ছড়াতে। আমি যদি আগে জানতাম তারা এই কাজ করছে, তাহলে তাদের রাজ্যে ঢুকতেই দিতাম না।’ প্রসঙ্গত ন্যাশনাল ফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান উইমেনের প্রতিনিধিরা মণিপুরে ধর্ষণের ঘটনার তদন্তে সফর করে। মণিপুরে মহিলাদের বিবস্ত্র করে ঘুরিয়ে তার পরিজনদের হত্যা করে তাদের পরপর ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। সেই ফেডারেশনের প্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে মণিপুর সরকার এফআইআর দায়ের করে। এদিন প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড়ের নেতৃত্বে বেঞ্চে অন্য বিচারপতিদের মধ্যে ছিলেন জে বি পারদিওয়ালা এবং মনোজ মিশ্র।
Comments :0