floura and fauna

জীববৈচিত্রের রক্ষার কাজ আমাদেরও

সম্পাদকীয় বিভাগ

ভাস্করানন্দ রায়
 

প্রকৃতির তথাকথিত ‘খামখেয়ালিপনা’ উদ্বেগ তৈরি করেছে। আইলা, আমফান, ইয়াশ, ২০২১-এর বন্যা, চলতি বছরে তীব্র দাবদাহ কিংবা বাতাসে আর্দ্রতার আধিক্যের কারণে দুর্বিষহ আবাহাওয়ার দাপটে মানুষের জীবন আজ বিপন্ন। প্রতি বছরই এই ধরনের দুর্যোগ হচ্ছে। প্রকৃতি, উন্নত প্রজাতির শ্রেষ্ঠ জীব মানুষের প্রতি প্রতিশোধ নিচ্ছে। জীববৈচিত্রের উপর চরম আঘাত নেমে এসেছে। ফলে জীববৈচিত্র আজ চরম সঙ্কটের মুখে। আদিম কাল থেকে উদ্ভিদ ও প্রাণীকূলের নানান বৈচিত্রময় প্রজাতি সারা পৃথিবীতে অবস্থান করছে। উভয় কূলের প্রজাতি পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। কেউ বিচ্ছিন্ন হলে তাদের যেমন প্রতিক্রিয়া হয়, সেই প্রতিক্রিয়া আমাদের সমাজ জীবনেও পড়ে। ইতিমধ্যেই অনেক প্রজাতি হারিয়ে গেছে। বিশেষ করে কৃষিতে পুঁজির অনুপ্রবেশের ফলে বহুমুখী কৃষিব্যবস্থা আজ অবলুপ্তির পথে। এর প্রভাব প্রকৃতি, পরিবেশ ও জীববৈচিত্রের মধ্যে পড়ছে।
বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, দৃশ্যদূষণ, নদীদূষণ—সবমিলিয়ে পরিবেশ দূষিত হয়ে যাচ্ছে। নির্বিচারে ধ্বংস হচ্ছে বনাঞ্চল, জলাশয় ভরাট হয়ে যাচ্ছে। গোরুমারা জাতীয় উদ্যানের মধ্যে কয়েক হাজার গাছ কেটে নেওয়া হয়েছে। বামফ্রন্টের আমলে পঞ্চায়েতগুলি লক্ষ লক্ষ বনসৃজন করেছিল। ২০১১ সালের পর এই গাছ কেটে নামমাত্র দামে বিক্রি হয়ে গেছে। নতুন করে বনসৃজন পরিকল্পনা করা হয়নি। আশার কথা, কিছু কিছু ব্যক্তি, ক্লাব, সবুজের অভিযান নামে সংগঠন মিলিতভাবে বনসৃজন সহ হারিয়ে যাওয়া গাছগুলি লাগাতে শুরু করেছে।
তারপর আছে নদীদূষণ, নদীভাঙন। ফি বছর ঘূর্ণিঝড় আর প্রবল বৃষ্টিপাত। জীবাণুর দাপটে রোগের আঁতুড়ঘর এখন গঙ্গা। ফিক্যাল কলিফর্ম এর ধরনের ব্যাকটেরিয়া। মানুষ ও পশুর মলে থাকে। প্রাতঃকৃত্য তো চলছেই গঙ্গার দুই ধারে। গঙ্গার জলে গঙ্গা নদীর দুই ধারে শহরের পয়ঃপ্রণালীর জলের বর্জ্য গঙ্গায় যাচ্ছে। 


গঙ্গার জলে জলজ প্রাণী ও জলজ উদ্ভিদ আজ বিপন্ন। জলে দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা কমে যাচ্ছে। গঙ্গার এই দূষণের ফলে আমাশয়, টাইফয়েড, হেপাটাইটিস-জাতীয় রোগ বাড়ছে। গঙ্গা দূষণ রোধে কোটি কোটি খাকা খরচ করেও সঠিক পরিকল্পনার অভাবে তা ঠেকানো যায়নি। নদীদূষণ থেকে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য অস্বাস্থ্যকর হয়ে উঠেছে। নদীর ধারে কলকারখানা, হাটবাজার গড়ে উঠেছে। বর্জ্য পদার্থ দীর্ঘদীন ধরে পচতে পচতে বিষাক্ত গ্যাসে জলবায়ু দূষিত হচ্ছে। প্রশাসন সব দেখেও না দেখার ভান করে বসে থাকে।
শব্দদৈত্য আজ পাড়ায় পাড়ায়, অলিগলিতে, ডিজের দৌরাত্ম্য। মানুষ অতিষ্ঠ। পুজোপার্বণ, নানান অনুষ্ঠানে ডিজে। এমনকি, বিভিন্ন রাজ‍‌নৈতিকদলের মিছিলে বা নানা কর্মসূচিতে ডিজের শব্দে নাজেহাল মানুষ। আর দৃশ্যদূষণ! নেতা-নেত্রীদের কাটআউটের ছবি যত্রতত্র। তারপর আছে বিজ্ঞাপনের জলুস। দলের ফ্লেক্স পতাকায় ছেয়ে যাচ্ছে রাস্তার দুধার। রাস্তায় যেতে যেতে মাঝে মাঝে চোখ বন্ধ রাখতে হয় বিশ্রামের জন্য।
বর্তমানে উদারীকরণের যুগে ও ধান্দার ধনতন্ত্রের সভ্যতার বিকাশপর্বে বাণিজ্যিক স্বার্থে, মুনাফার জন্য কর্পোরেট প্রকৃতি, পরিবেশ ও কৃষি সহ জীব বৈচিত্রকে ধ্বংস করছে সরকারের মদতে। এইভাবেই জলবায়ুর পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। গত বছর ৫টি জেলায় বজ্রপাতে একদিনে ২৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৯-২০ সালের তুলনায় ২০২০-২১ সালে বজ্রপাতের হার বৃদ্ধি পেয়েছে যা কিছু হচ্ছে সবই মানুষের কৃতকর্মের জন্য। বিশ্বের উষ্ণায়নের প্রভাবে বাতাসে জলীয় বাষ্পের বেশিমাত্রায় বেড়ে যাওয়া, অত্যধিক গরম অর্থাৎ তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া, তার সাথে আছে দূষণ। ফলে বজ্রপাত বাড়ছে। তেল আভিভ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা জানিয়েছেন — প্রতি এক ডিগ্রি সেলসিয়াস উষ্ণতা বৃদ্ধিতে বজ্রপাতের পরিমাণ প্রায় ১০ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেতে পারে। উষ্ণতা যত বাড়বে বজ্রপাতও তত বাড়বে। আর গ্রাম ও শহরতলির গরিব-গুরবো মানুষ মরবে বেশি। কারণ তারাই বেশি থাকে মাঠে-ঘাটে-রাস্তায়। সরকার সামান্য কিছু টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়ে দায়িত্ব ও কর্তব্য শেষ করবে। আসল প্রশ্ন হলো গ্রিন হাউসের তাপ নির্গমণ কি কমানো হবে? বিশ্বের উষ্ণায়ন কমানোর জন্য গবেষক ও বিজ্ঞানীরা, এমনকি আন্তর্জাতিক সংস্থা প্যারিস চুক্তি যা নিদান দিয়েছে, তা পুঁজিবাদী উন্নত দেশগুলি মানবে? মানছে না। যার ফলেই আজ সঙ্কট দেখা দিয়েছে। সতর্কবার্তা বিজ্ঞানীরা কী দিয়েছিলেন — আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলি কী নিদান দিয়েছিল সেগুলি দেখে নেওয়া যাক। আজকের যে করোনা মহামারীর জন্যও মানুষই দায়ি। প্রসাধনী উন্নয়নের নামে প্রকৃতিও পরিবেশের উপর যে ধ্বংসলীলা হচ্ছে, অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে বন্যপ্রাণীর সাথে মানুষের সংস্পর্শ বাড়ছে। এই সব বন্যপ্রাণীই বহন করে নিয়ে আসে ভয়ঙ্কর সব জীবাণু। প্রায়ই সংবাদপত্রে দেখা যায় বাঘ লোকালয়ে ঢুকে পড়ছে। বিরল প্রজাতির প্রাণীও লোকালয়ে ঢুকে যাচ্ছে। কেন ঢুকছে? তার কার্য-কারণ কী? আমরা কি একবারও তা ভেবে দেখেছি? এর জন্য চাই তাদের বিচরণের জন্য অবাধ জঙ্গল ও পর্যাপ্ত খাদ্য ও জল। সরকারকেই বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও বনাঞ্চল রক্ষার দায়িত্ব নিতে হবে।


২০১৫ সালের প্যারিস শহরে ২০ নভেম্বর থেকে ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত পৃথিবীর সমস্ত দেশের প্রতিনিধিদের নিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের উপর একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ঐ সম্মেলনে কিয়টো চুক্তি বাতিল করে মূল সিদ্ধান্ত হয়েছিল— ‘‘পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি শিল্প বিপ্লবের আগের (অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ) মাত্রা থেকে কোনোমতেই ২ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের বেশি না হয়। কিন্তু উদ্যোগ নিতে হবে যাতে এই বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের মধ্যে বেঁধে রাখা যায়...।’’ আবহাওয়া পরিবর্তন সংক্রান্ত প্যারিস চুক্তিতে আমেরিকা স্বাক্ষর করে। ঐ সময় রাষ্ট্রপতি ছিলেন বারাক ওবামা। ২০১৭ সালের ১জুন প্যারিস চুক্তি থেকে আমেরিকা বেরিয়ে আসে। সমস্ত বিধি নিষেধ ভঙ্গ করে গ্রিনহাউস তারা বাড়াতেই থাকে। লক্ষ্য করার বিষয় হলো যে, ১৯১৩ থেকে ২০১৩— এই একশো বছরে আ‍‌মেরিকার গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমন, ভারত ও চীনের যা নির্গমন হয়, তার দশগুণ।
১৮৪৫ সালে এঙ্গেলস তাঁর ‘‘Condition of the working class in England” বই-এ লিখেছেন, ‘সামাজিক হত্যা’ বা ’Social Murder’। করোনা মোকাবিলায় ভ্যাকসিনেশন বা টিকাকরণ যেভাবে প্রয়োজন ছিল, রাষ্ট্র সেই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ। করোনা রোগীরাও দিশাহারা। চিকিৎসাও অপ্রতুল। স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ কম, পরিকাঠামোর অভাব তাদের আরও বিপন্ন করে তুলেছে। এর পরিণতিতেই আমরা গঙ্গার জলে করোনা রোগীর মৃতদেহ ভেসে যেতে দেখি। এটাও‍‌তো একরকম ‘সামাজিক হত্যা’।
ক্ষমতার দম্ভে যাঁরা মত্ত, দল বদলের নেশায় যাঁরা ব্যস্ত, টাকা কামানোর রাস্তা পরিষ্কার করতে যাঁরা গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ করার যড়যন্ত্রে লিপ্ত, ধর্মীয় বিভাজনের মেরুকরণকে কাজে লাগিয়ে যাঁরা ক্ষমতায় টিকে থাকতে চায়, তাঁরা সহ তাঁদের আমলারা কি প্রখ্যাত ন্যাশনাল ওশিয়নিক অ্যান্ড অ্যাটমোস্ফেরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের তথ্য দেখেছেন? তথ্য বলছে— ‘‘লকডাউনের মধ্যেও এপ্রিল, ২০২০ ‍‌তে বাতাসে কার্বন-ডাই অক্সাইডের ঘনত্ব সর্বকালীন রেকর্ড ছাপিয়ে পৌঁছে গেছে ৪১৬.১৭ পার্টস পার মিলিয়নে। ২০১৯ সালে জর্ডন ডাইয়েট ও ক্যাসিডি একটি নিবন্ধে দেখিয়েছিলেন জার্মানিতে কীভাবে পরিবেশগত সমস্যাকে একটা বিশেষ জনগোষ্ঠীর মানুষের বিরুদ্ধে তীব্র জাতিবিদ্বেষ তৈরী করে উগ্রজাতীয়তাবাদ এবং শেষ পর্যন্ত ফ্যাসিবাদের মাঠ প্রস্তুত করা হয়েছিল। এঙ্গেলস কত যুগ আগে লিখেছিলেন, ‘‘আমাদের অবস্থান প্রকৃতির সীমারেখার বাইরে নয়, বরং রক্ত-মাংস, মেদ-মজ্জা, মেধা-মনন সহ আমরা প্রকৃতিরই অবিচ্ছেদ্য অংশ, প্রকৃতির মধ্যেই আমাদের অস্তিত্ব।’’
প্রকৃতি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ প্রায় একশো বছর আগে সাতদফা সতর্কবার্তা দিয়েছিলেন সরকার ও দেশবাসীর উদ্দেশ্যে। তারমধ্যে তিনটি এখানে উল্লেখ করা হলো— আমাদের প্রকৃতির উপর প্রভুত্ব করা হয়, প্রকৃতিকে ভোগ করা নয়, প্রকৃতির সঙ্গে সম্মিলন। প্রকৃতির সঙ্গে কোনও বিরোধ নয়, তার কাছে আমাদের জন্মকালের ঋণ, প্রকৃতির মধ্যে আমাদের স্বাভাবিক অস্তিত্ব। প্রকৃতির দিকে মানুষ যত কানা হচ্ছে, প্রকৃতি তাকে মৃত্যুবাণ মারছে। 
ভোগবাদের দুনিয়ায়, ধান্দার ধনতন্ত্র ও পুঁজিবাদ নখ-দাঁত বের করে প্রকৃতির ধ্বংসলীলায় নেমেছে, পরিবেশকে যেভাবে ধর্ষণ করা হচ্ছে, জীববৈচিত্রকে যেভাবে লোপাট করে দেওয়া হচ্ছে, তার বিরুদ্ধে সচেতন দেশবাসীকেই রুখে দাঁড়াতে হবে। অবশ্যই প্রধান দায়িত্ব ও কর্তব্য বামপন্থীদের। সিপিআই (এম)-এর ২৩তম পার্টি কংগ্রেসে গৃহীত রাজনৈতিক প্রস্তাবে বাম ও গণতান্ত্রিক কর্মসূচি অধ্যায়ে পরিবেশ সংক্রান্ত কলমে আহ্বান জানানো হয়েছে যে, ‘‘বিষাক্ত গ্যাস নির্গমণ নিয়ন্ত্রণে আইন প্রণ‌য়ন, নবীকরণযোগ্য প্রাকৃতিক শক্তি ব্যবহারকে উৎসাহদান, প্রত্যেকের জন্য প্রাকৃতিক শক্তি ব্যবহারকে উৎসাহদান, প্রত্যেকের জন্য প্রাকৃতিক শক্তি ব্যবহারের অধিকার সুনিশ্চিত করা, অরণ্য জলাভূমি সংরক্ষণ, দূষণের মাত্রা চিহ্নিত করে আইনি বিধি লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ।’’


বামপন্থী ও ধর্মনিরপেক্ষ মানুষের লড়াইয়ের ফসল, জীববৈচিত্র ২০০২ আইন গৃহীত হয়। এই আইনে মূলত তিনটি দিককে নির্দেশ করা হয়েছে — (১) জীববৈচিত্র সংরক্ষণ, (২) জীববৈচিত্রের উপাদানগুলির দীর্ঘমেয়াদি ব্যবহার, (৩) জীব সম্পদের ব্যবহার এবং সেই সম্পর্কিত জ্ঞান থেকে প্রাপ্ত সুবিধার সমবণ্টন সুনিশ্চিত করা।
আইন হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সেই আইনকে সাধারণ মানুষের স্বার্থে সঠিকভাবে কার্যকর করা হচ্ছে কি? উক্ত আইন মোতাবেক জীববৈচিত্র পর্ষদ গঠনের সরকারি আদেশনামা থাকলেও বিশেষ অগ্রগতি হয়নি। অর্থাৎ রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবেই ঐ আইন চাপা পড়ে আছে। তার জন্যই চাই তীব্র গণআন্দোলন। পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকার থাকাকালীন দ্রুত পর্ষদ গঠন করা হয় ও তারা কাজ শুরু করে। তৎকালীন সময়ে পর্ষদ সমীক্ষার জন্য সমতলভূমি, পাহাড়ি এলাকা, বনাঞ্চল এলাকার অন্তর্গত তিনটি জেলার তিনটি গ্রাম পঞ্চায়েত চিহ্নিত করে কাজে নামা। পর্ষদ উক্ত এলাকায় তিনটি জীববৈচিত্র ব্যবস্থাপনা সমি‍‌‍‌তি গঠন করে। দা‍‌র্জিলিঙ জেলার মাটিগাড়া পঞ্চায়েত সমিতি (চম্পাসারি গ্রাম পঞ্চা‌য়েত), হুগলী জেলার গোঘাট-২নং পঞ্চায়েত সমিতি (পশ্চিমপাড়া গ্রাম পঞ্চায়েত) ও দক্ষিণ চ‍‌ব্বিশ পরগনা জেলার পাথরপ্রতিমা পঞ্চায়েত সমিতি (পাথর প্রতিমা গ্রাম পঞ্চায়েত)। এই সমিতি প্রাথমিকভাবে সংশ্লিষ্ট গ্রাম পঞ্চায়েতে জীববৈচিত্র নথিকরণের (People’s Biodiversity Register) কাজ শুরু করে। এই কাজ যখন শুরু হচ্ছে, ঠিক তখনই সারদার উত্থান হচ্ছে। সারদার হাত ধরে সমস্ত কট্টর দক্ষিণপন্থী, অতিবামপন্থী, বিদেশি শক্তি মিলিতভাবে তৃণমূল কংগ্রেসের নেতৃত্বে মমতা ব্যানার্জিকে প্রোজেক্ট করে বামফ্রন্ট সরকারকে উৎখাত করার গভীর ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের মধ্য দিয়ে সরকার পরিবর্তন করে এবং তার পরেই সব উদ্যোগ চাপা পড়ে যায়।
আমাদের সামাজিক জীবনে এই কাজটি কেন গুরুত্বপূর্ণ, জরুরি, তা নিচের তথ্য দেখলে কিছুটা হলেও উপলব্ধি করা যায় যে, আমরা কী ভয়ঙ্কর বিপদের মধ্যে আছি। ১৯৯৯ সালে  গোঘাট-১নং পঞ্চায়েত সমিতি পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞানমঞ্চ ও বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশিষ্ট কয়েকজন বিজ্ঞানীদের সহায়তায় কুমুড়শা গ্রাম পঞ্চায়ে‌তের তেলিগ্রাম মৌজাটিকে বেছে নেওয়া হয় জনজীববৈচিত্রের নথিকরণের কাজে। স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রী, গ্রামের প্রবীণ মানুষদের নিয়ে গঠিত হয় সমীক্ষক দল। তাঁদের দেওয়া তথ্যই ২০০৩ সালে বেসরকারিভাবে জনজীববৈচিত্র নথি হিসাবে প্রকাশিত হয়। সেই নথির গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি তথ্য সকলের অবগতির জন্য দেওয়া হলো :
আগে চাষ হতো (ধানের জাত) - ‍‌(১) শুঁয়ো কলমা, (২) চামরমণি, (৩) গৌরীকাজল, (৪) ধুলে, (৫) কলমকাঠি (আমন-মুড়ি ভালো হয়), (৬) দুধ কলমা, (৭) সীতাশাল (পুরানো দিনের সবথেকে সুস্বাদু চাল), (৮) মাশুরি, (৯) গোবিন্দভোগ, (১০) শুঁয়োডহর ইত্যাদি। কৃষকের পরামর্শমতো পুরানো জাত বাঁচিয়ে রাখা দরকার। পুরানো জাত য‍‌দি না থাকে, তাহলে নতুন জাত তৈরি করার ক্ষেত্রে সমস্যা হবে।


প্রাকৃতিক প্রাণীকূল: কচ্ছপ একেবারেই কমে গেছে। কাক কমেছে, চড়ুই তো প্রায় অবলুপ্তির পথে, শকুন দেখতে পাওয়া যায় না। খটাশ, ভাম লুপ্তপ্রায়। সোনা ব্যাঙ, গুগলি-শামুক-ঝিনুক কমেছে গ্রামে গোরুর সংখ্যা কমেছে — ফলে গোবর সংগ্রহের পরিমাণ উল্লেখ‍‌‍যোগ্যভাবে কমে‍ গেছে। ছাগল হাঁস কিছুটা বেড়েছে।
উদ্ভিদকূল : জাম, আতা, ভেমুচ, ডালিম, গামীর, খেজুর, তাল, অশোক, তেঁতুল, বট, অশ্বত্থ ক্রমশ কমে যাচ্ছে। নিম, করবী, বাবলা, চালকদম, বকুল, কুল, রাধাচূড়া, সুবাবুল কম।
মৎস্যকূল : গ্রামের বে‍‌শিরভাগ মানুষ লাভের দিকে নজর রেখে বিদেশি জাতের সংকরা‌‌য়িত প্রজাতির উচ্চ ফলনশীল মাছ চাষের দিকে ঝুঁকছেন। অত্যধিক রাসায়নিক সার প্রয়োগ, মাঝে-মধ্যে কীটনাশক ব্যবহার করে পুকুর পরিষ্কার করে নতুনভাবে চাষ করা হয়। ফলে দেশীয় মাছগুলির প্রায় লুপ্তপ্রায় অবস্থা। ডেনকোণা, চিতল, ফলুই, ট্যাংরা (ছোটো), শাল, শোল, কুচে, পাঁকাল, বাণ, খোলসে, কই, চাঁদা, মৌরোলা, কালবোস, মাগুর, সিঙি, পুঁটি ইত্যাদি মাছগুলির ছবি বই‌য়ের পাতাতে দেখেই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মানুষকে চিনতে হবে। বাস্তবে তাদের স্বাদ পাওয়া থেকে বঞ্চিতই থাকতে হবে আমাদের।
পাখি : চড়ুই-খড়ের চাল না থাকায় একেবারেই দেখা যায় না। তাছাড়া কোকিল, দোয়েল, ডোমচিল, কাঠঠোকরা, পানকৌড়ি, ঘুঘু প্রভৃতি পাখিগুলি উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাচ্ছে। কুসুমের চাষ কমায় এবং গাছপালা কেটে ফেলায় টিয়া প্রায় দেখতেই পাওয়া যায় না। বাবুই, মৌটুসী, বালিহাঁস, খড়হাঁস, শামুকখোল প্রভৃতি পাখিদেরও আর সেভাবে দেখতে পাওয়া যায় না।
স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে : খটাশ, বড়ো নেউল, ছোটো নেউল, কাঠবেড়ালি, বাদুড়, চামচিকে প্রভৃ‍‌তি কমেছে। ভোঁদড় আর দেখা যায় না। গ্রামে জীববৈচিত্র সম্পর্কিত আচার-অনুষ্ঠান, কৃষির সাথে সম্পর্কযুক্ত — খামার পুজো অথবা বারলক্ষ্মীপু‍‌জো, গো-পার্বণ, নল-সংক্রান্তি।
‘আকাশের জল-পাতালের নল/ধান ফলে গলগল।’


ছোট গাছ-গাছড়া, লতা-গুল্ম : (গ্রামবাসী ব্যবহৃত দেশীয় ঔষধি সম্পর্কিত জ্ঞান) ভ্যারান্ডা, বেনাঝাড়, কালিন্দি, কুকসীমা, নলশর, শুষণি, কলসীপাতা, কানমুগরো, পদ্ম কমেছে। বন কমে যাওয়ায় আপাং দেখা যায় না। ঘৃতকুমারী কমে গেছে, (হাত-পা মচকে গেলে পাতার শাঁস দিলে উপশম হয়)। শালুক কমে গেছে, থানকুনি কমে গেছে (রক্ত আমাশয় হলে থানকুনি পাতার সঙ্গে চার-পাঁচটা আতপ চাল বেটে খেতে হয়)। বিষল্লকরণী কমে গেছে (কেটে গেলে রস লাগায়), বাসক কমে গেছে (সর্দি-কা‍‌শিতে পাত সেদ্ধ জল খুব উপকারি), কুলে শাক (কুলেখাড়া) রক্তে হিমগ্লোবিন বাড়াতে সাহায্য করে। ধুতুরা কমে গেছে। ঘেঁটু ফুল গাছ কমে গেছে। শতমূলী কমে গেছে (ঔষধ তৈরি হ‌য়)। ফণী মনসা কমে গেছে (শেকড় বেটে চাপান দিলে দাঁতের যন্ত্রণা কমে)
প্রয়োজন হয়ে পড়েছে প্রতিটি গ্রামে ও মৌজায় সম্পদ অনুসন্ধান ও নথিকরণের কাজ। কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষদের স্বার্থে এই কাজ সফল হতে পারে। কৃষক সমিতির ও খেতমজুর ইউনিয়নের নেতৃত্বে ছাত্র, যুব, শ্রমিক সংগঠনগুলির সাথে বিজ্ঞান ক্লাব ও বিজ্ঞান সংগঠনকে কাজে নামানোর প্রয়োজন। আমাদের দেশে পরিবেশ স্থিতিশীল কৃষি ব্যবস্থা ও জনজীববৈচিত্রকে রক্ষা করা এই মুহূর্তে জরুরি হয়ে পড়েছে।

 

Comments :0

Login to leave a comment