RATION SCAM

রেশনের খাদ্য পাচার করে বিপুল সম্পত্তি

রাজ্য

CPIM TMC BJP AIKS WEST BENGAL PANCHAYAT ELECTION WEST BENGAL POLITICS 2023 BENGALI NEWS RATION SCAM JYOTIPRIYA MALLICK

রেশনে রাজ্যবাসীকে কম আটা, চাল দেওয়া হয়েছে। ভুয়ো রেশন কার্ড বানানো হয়েছে দেদার। সেই ভুয়ো কার্ডের বরাদ্দ চাল, আটা বাজারে বিক্রি করা হয়েছে। এই ভাবে কয়েক হাজার কোটি টাকা চুরি হয়েছে রাজ্যে। 
এই চুরির টাকা মমতা ব্যানার্জির মন্ত্রীসভার সদস্য, তাঁর বিশ্বস্ত জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক পেয়েছেন, এমনটাই অভিযোগ ইডি’র। তাদের যুক্তি দুটি। প্রথমত, ২০১৬ থেকে জ্যোতিপ্রিয় এবং তার পরিবারের আয়, সম্পত্তি যা বেড়েছে, তা অন্য কোনোভাবে আয়ের কোনও প্রমাণ জ্যোতিপ্রিয় দেখাতে পারেননি। দ্বিতীয়ত, ইতিমধ্যেই ধৃত বাকিবুর রহমান ইডি-কে বলেছেন, তিনি বিপুল টাকা ধার দিয়েছিলেন জ্যোতিপ্রিয় তথা ‘বালুদা’-কে। যে টাকা ‘বালুদা’ কখনও ফেরত দেননি — বাকিবুর স্বীকার করেছে। 
এই টাকাই রেশন-চুরির টাকার ‘বালু’র অংশ। ইডি’র তাই সন্দেহ। পরিমাণ? ইডি নিশ্চিত নয় এখনও। তবে কয়েক শো কোটি টাকা, জানাচ্ছে ইডি’রই একটি সূত্র।
তবে এই চুরির অনেক কিছুই রেশনের গ্রাহকরা সন্দেহ করেছিলেন। সিপিআই(এম) একাধিকবার, বিভিন্ন জেলায় এই নিয়ে আন্দোলন করেছে। এখন ইডি’র তদন্তে এই অভিযোগগুলিই প্রধান হয়ে উঠছে মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক, তার প্রাক্তন এক আপ্ত সহায়ক, ব্যবসায়ী বাকিবুর রহমান সহ অন্যান্যদের বিরুদ্ধে। শুক্রবার ইডি’র একটি সূত্র জানাচ্ছে, ‘সহ অন্যান্য’দের তালিকায় রাজ্য সরকারের কয়েকজন আমলা এবং কয়েকটি জেলায় তৃণমূলের আরও কয়েকজন নেতার নাম আছে। আপাতত ৮জনের নাম পেয়েছে ইডি’র তদন্তকারীরা। তাদের মধ্যে একটি পরিচিত কোম্পানির কাপড়ের শো রুমের মালিক আছেন। আছেন জ্যোতিপ্রিয়র দীর্ঘদিনের পরিচিত, ঘনিষ্ঠ একজনের নামও, যিনি সরকারি কাজেও জ্যোতিপ্রিয়কে সহায়তা করেছেন। ইডি’র এক আধিকারিক জানিয়েছেন,‘‘এই ব্যক্তির রাজ্যের শাসক দলে এত জোর যে, তিনি লন্ডনে মুখ্যমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হতে পেরেছিলেন।’’ মমতা ব্যানার্জি দু’বার লন্ডন গেছেন রাজ্যের জন্য বিনিয়োগ আনার নামে। প্রথমবার তিনি লন্ডন গেছিলেন ২০১৫-র ২৬ জুলাই। ফিরে এসেছিলেন ৩০ জুলাই। দ্বিতীয়বার গেছিলেন ২০১৭-র ১৩ নভেম্বর, ছাব্বিশ মাস পরে। ফিরেছিলেন ১৯নভেম্বর। ইডি’র গোয়েন্দারা জানাচ্ছেন, দ্বিতীয়বারের সফরেই ছিলেন রেশন-দুর্নীতির অন্যতম এই চক্রী।
উল্লেখ্য, বৃহস্পতিবার ইডি জ্যোতিপ্রিয়র বর্তমান আপ্ত সহায়ক অমিত দে-র তিনটি ফ্ল্যাটে তল্লাশি চালায়। সেখানেও কিছু নথি, তথ্য মিলেছে। তার মধ্যে একটি মেরুন রঙের ডায়েরি পাওয়া গেছে। যেখানে রেশন-দুর্নীতির বেশ কিছু সূত্র, অনেকগুলি নাম পাওয়া গেছে বলে ইডি’র দাবি। 
কিছু নাম ধৃত বাকিবুরের থেকে মিলেছে। কিছু নাম ‘অসুস্থ’ জ্যোতিপ্রিয়কে জেরার পর মিলবে বলে তদন্তকারীদের আশা।
কিন্তু রাজ্যের খাদ্য ও সরবরাহ দপ্তরের এই দুর্নীতি টাকার অঙ্কে কত কোটি— তা এখনও নিশ্চিত করতে পারেনি ইডি। তবে ৬টি শিখণ্ডি সংস্থার হদিশ তদন্তকারীরা আগেই পেয়েছেন। সেখানে জ্যোতিপ্রিয়-বাকিবুরের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠরাই হর্তাকর্তা। সেই সংস্থাগুলির মারফত কত টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে, তাই আগে নিশ্চিত করতে চাইছেন তারা। তবে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে, ৩টি সংস্থার মাধ্যমে প্রায় ১২ কোটি টাকা সাদা করা হয়েছে ওই সংস্থাগুলির মাধ্যমে। তবে শুধু এই টাকারই লেনদেন হয়েছে ওই সংস্থাগুলির মাধ্যমে— তা নয়। অনেক বেশি টাকার কারবারে ব্যবহার করা হয়েছে সংস্থাগুলিকে। যেমন, ইডি জেনেছে বাকিবুরের একাধিক শিখণ্ডি সংস্থা। তার মধ্যে ছটির নথি তারা পেয়েছে। যেমন- এনপিজি রাইসমিল প্রাইভেট লিমিটেড, রুদ্রাক্ষ ব্যাপার প্রাইভেট লিমিটেডে, ত্রিমূর্তি ইনফ্রা ডেভেলপার্স প্রাইভেট, কানাইয়া নির্মাণ প্রাইভেট লিমিটেড। সেখানে খাদ্য সাথী প্রকল্পে রেশনের মাধ্যমে আটা বণ্টন দুর্নীতির টাকা ঢুকেছে। প্রাথমিকভাবে রেশন দুর্নীতির প্রায় ৫১কোটি টাকা ঢুকেছে বাকিবুরের শিখণ্ডি সংস্থাগুলিতে, ইডি তেমনই জেনেছে। এই টাকার কত অংশ জ্যোতিপ্রিয় নিয়েছেন— তাই জানতে চাইছে ইডি।
ইডি জানতে পেরেছে পুজোর সময়েই তৃণমূল ঘনিষ্ঠ বাকিবুর রহমান দুবাইতে পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিল। ইডি’ বাকিবুরকে গ্রেপ্তারের পরে আদালতে জানায় সে দুবাইয়ে চলে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিল, তার আগেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে। দুবাইয়ে তার বিনিয়োগ আছে বলে দাবি তদন্তকারী সংস্থার। সরকারি একাধিক দপ্তরের স্ট্যাম্প কী করে বাকিবুরের রাইস মিলে উদ্ধার হলো তা নিয়ে আদালতে একাধিক প্রশ্ন তোলে ইডি। 
রেশনে আটা বণ্টরের বেনজির দুর্নীতির ১০ কোটির বেশি টাকা ঢুকেছিল বাকিবুরের সংস্থা এনপিজি রাইসমিলের অ্যাকাউন্টে। গুডলাইফ ডিলার্স প্রাইভেট লিমিটেড নামে বাকিবুরের আরেকটি সংস্থায় ঢুকেছিল ৭ কোটি ৩৫ লক্ষ টাকা, ইউনিকন কমোডিটি নামে আরেকটি সংস্থায় কোভিড পর্বেই ঢুকেছিল প্রায় ১২কোটি টাকা, ত্রিমুর্তি ইনফ্রা ডেভলপার্স নামে একটি সংস্থায় ১৪ কোটি টাকা ঢুকেছিলে । আদালতেও তা জানায় ইডি। তদন্তকারী সংস্থার দাবি রেশন সামগ্রী বণ্টনের গোটা কারবার চলত চেন সিস্টেমে।
সেই সিস্টেম সম্পর্কে জ্যোতিপ্রিয় জানতেন। তিনি এর একাংশ পেয়েছেন, নাহলে তার এত সম্পত্তি হয় কী করে? প্রাথমিকভাবে এটিই ইডির যুক্তি। তাছাড়া জ্যোতিপ্রিয় কিংবা তার স্ত্রীর আর কোনও আয়ের উৎস দেখা যাচ্ছে না, যা থেকে ২০১৬-র পরে তাদের সম্পত্তি বিপুল পরিমাণ বাড়তে পারে।
এমন কিছু তথ্য ইতিমধ্যেই জ্যোতিপ্রিয়র মতো তৃণমূল নেতার খুব চেনা এক প্রভাবশালী নেতার পক্ষ থেকেই সরবরাহ করা হয়েছে ইডিকে— এমনই মনে করছেন মমতা ব্যানার্জির দলের একাংশ। তাদের অন্যতম, তৃণমূলের দীর্ঘদিনের এক নেতার মতে,‘‘এত তথ্য ইডি পেতে পারে না, যদি না কেউ তা তাদের দিয়ে থাকে। আর যে দিয়েছে, সে বালুর দপ্তর, সম্পত্তির বিষয়ে অনেক তথ্যই জোগাড় করেছিল। এই কাজ সাধারণ কারও পক্ষে সম্ভব নয়।’’
যদিও শুক্রবার ভোরে, সিজিও কমপ্লেক্সে ঢোকার মুখে জ্যোতিপ্রিয় বলেছেন,‘‘গভীর ষড়যন্ত্রের শিকার হলাম। শুধু এইটুকুই বলে গেলাম। ভারতীয় জনতা পার্টি খুব ভালো কাজ করেছে। তারা আমাকে শিকার করল।’’ বিজেপি’র ষড়যন্ত্র বললেন না জ্যোতিপ্রিয়। বিজেপি শিকার করেছে তাকে— তাই বললেন। 
বৃহস্পতিবার ভোর সাড়ে ৬টায় জ্যোতিপ্রিয়র তিনটি বাড়িতে তল্লাশি শুরু করেছিল ইডি। তাকে গ্রেপ্তার করা হয় শুক্রবার রাত পৌনে ৩টে নাগাদ। প্রসঙ্গত, ২০২০-তে বাকিবুর সহ বেশ কয়েকজন রেশন ডিলার এবং ডিস্ট্রিবিটরের বিরুদ্ধে রাজ্য পুলিশই ৩টি মামলা করেছিল। নদীয়ার কোতোয়ালি থানায় সেই এফআইআর গুলি হয়েছিল। সেগুলিরই ভিত্তিতে নিজেদের রেশন দুর্নীতির তদন্ত শুরু করে ইডি। মমতা ব্যানার্জি যেখানে স্বরাষ্ট্র(পলিশ) মন্ত্রী, তখন বাকিবুরের নাড়িনক্ষত্র না জেনে রাজ্য পুলিশ এফআইআর দায়ের করেছিল, এমনটা তৃণমূলের অনেকেই মনে করছেন না। উল্লেখ্য, ওই সময়ের কিছু আগে থেকেই মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপো অভিষেক ব্যানার্জির বিরুদ্ধে নানা দুর্নীতিতে যুক্ত থাকার অভিযোগ উঠতে শুরু করেছে। 
ইডি’র সূত্রের দাবি, জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের একাধিক সম্পত্তির হদিশ তারা পেয়েছে। যার অনেকগুলিই বেনামে আছে। শুক্রবার আদালতেও জ্যোতিপ্রিয় বারবার পরিবারের দিকেই অভিযোগগুলি ঘুরিয়ে দিতে চেয়েছেন। বিচারপতিকে বলেছেন,‘‘আমার নামে কিছুই পায়নি। সব কাগজেই সম্পত্তি পরিবারের লোকদের নামে!’’

Comments :0

Login to leave a comment