visva bharati

বিশ্বভারতীতে একমঞ্চে অমর্ত্য-প্রভাত , পাঁচ অধিকারের জন্য সংগ্রামের বার্তা

রাজ্য

 

মাস কয়েক আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় অংশ উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবে যে অমর্ত্য সেনের সাথে বিশ্বভারতীর সম্পর্ক ‘তীক্ত’ করেছিল। নোবেলজয়ীকে বাধ্য করেছিল আদালতের দ্বারস্থ হতে, সেই অমর্ত্য সেন ফের চেনা চেহারায় স্বাগত ভাষন দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত স্মারক বক্তৃতায়। 

বছর চারেক আগে যে গা জোয়ারিপনা, রাজনৈতিক ছুৎমার্গের কারণে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ প্রভাত পট্টনায়েকের জন্য অবরুদ্ধ করা হয়েছিল ভাষনের মঞ্চ, এদিন সেই অধ্যাপক পড়ুয়া, শিক্ষক, আশ্রমিক, প্রাক্তনীদের ভীড়ে ঠাসা সভাকক্ষে রেখেছেন তাঁর দীর্ঘ আলোচনা। আর সেই আলোচনায় নয়া উদারনৈতিক, নয়া ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার ভয়াল থাবার জন্য অকপটেই রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনা করেছেন জেএনইউ’র এমিরেটাস অধ্যাপক প্রভাত পট্টনায়েক। বলেছেন, ‘‘সারা বিশ্বে নয়া উদারনীতি মুখ থুবড়ে পড়েছে। ধনতন্ত্র চরম সঙ্কটে। চাহিদার থেকে উৎপাদন কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। সেই অর্থনৈতিক সঙ্কটকে ধামাচাপা দিতে নয়া ফ্যাসিবাদ কোথাও দাপিয়ে বসেছে। তো কোথাও ডানা বিস্তারের জন্য অপেক্ষায় বসে আছে। আর্জেন্টিনা থেকে শুরু করে ব্রাজিল, ভারত, ইতালি, হাঙ্গেরি, তুরস্ক, ফ্রান্স, জার্মানি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং স্ক্যান্ডিনেভিয়া সর্বত্র এক চিত্র।  এই সঙ্কট থেকে মুখ ঘোরাতে তাক করা হচ্ছে সংখ্যালঘুদের। যেমন, ভারতবর্ষে ভাষ্য ছড়ানো হচ্ছে হিন্দুদের কাজ খেয়ে নিচ্ছে মুসলমানরা। বাংলাদেশ, পাকিস্তানে ছড়ানো হচ্ছে উল্টোটা। আবার আমেরিকা, ফ্রান্সে বিভেদ তৈরী করা হচ্ছে নিগ্রো, এশিয়ানদের বিরুদ্ধে। কারন নয়া উদারবাদী ব্যবস্থায় গোটা বিশ্বের সাথে ভারতের অর্থনীতি যে সঙ্কটে নিমজ্জিত তার কোনও সমাধান নেই। বড় পুঁজিপতিদের কর ছাড় দিয়ে  শ্রমজীবী অংশের উপর কর আরোপ করে অর্থায়ন করা হচ্ছে। ফলে দারিদ্র, বেকারত্ব স্বাভাবিকভাবেই গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে।’’

গত চার বছর আগেই হওয়ার কথা ছিল এই স্মারক বক্তৃতা। গত ২০২০ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি এই প্রভাত পট্টনায়কেরই স্মারক বক্তৃতা দেওয়ার সূচী ঠিক হয়েছিল। কিন্তু তৎকালীন উপাচার্যর  তরফে অজানা কারনে বক্তা পরিবর্তনের নির্দেশ যায় অর্থনীতি বিভাগের কাছে। কিন্তু সেই নির্দেশ গ্রহন করে নি বিশ্বভারতীর অর্থনীতি ও রাজনীতি বিভাগ। প্রতিবাদে চার বছর আয়োজন করা হয় নি সেই স্মারক বক্তৃতার। অবশেষে বুধবার ২য় ‘অশোক রুদ্র স্মারক বক্তৃতা’ সংঘটিত হয়েছে বিশ্বভারতীর সভাকক্ষে।  তাতে বিদেশে থাকা নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন ভার্চুয়াল মাধ্যমে অংশগ্রহন করে তাঁর স্বাগত ভাষনে বলেছেন, ‘‘শান্তিনিকেতনে প্রভাত পট্টনায়েককে স্বাগত জানানোর সুযোগ পাওয়াটা আমার জন্য  সৌভাগ্যের। আমার আজও মনে পড়ে, তিনি তাঁর অসাধারণ মেধা ও যোগ্যতা বুদ্ধিমান মন্তব্য দ্বারা শ্রেণীকক্ষ আলোকিত করতেন। বিশ্বে যা ঘটছে এবং বিশেষ করে ভারতে, তা উপস্থাপন করার ক্ষেত্রে প্রভাতের দক্ষতা অনস্বীকার্য।  তাঁর বাস্তব দক্ষতা রয়েছে অর্থনৈতিক, সামাজিক বিবেচনা, রাজনৈতিক কারণ, শ্রেণী বিশ্লেষণের সাথে অর্থনৈতিক প্রতিফলনের পার্থক্যগুলিকে একত্রিত করার। যে অসমতা বর্তমান ভয়ানক অবস্থা তৈরির জন্য দায়ী, সেই কঠিন বিষয়গুলোকে সরল প্রাণবন্ত ভাষায় ব্যাখ্যা করতে প্রভাতের জুড়ি পাওয়া ভার।’’

স্মারক বক্তৃতার বিষয় ছিল ‘‘নয়া উদারনৈতিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় কর্মসংস্থান ও দারিদ্র’। মূল আলোচক হিসাবে উপস্থিত প্রভাত পট্টনায়েক তাঁর বক্তব্যে  স্বাস্থ্য-শিক্ষায় বেসরকারীকরণ রদের পক্ষে সওয়াল করে বলেন, ‘‘গভীর অর্থনৈতিক সঙ্কটাপন্ন ভারত তথা গোটা বিশ্বে, এই সঙ্কট অতিক্রম করার জন্য একটি সুনির্দিষ্ট অর্থনৈতিক এজেন্ডার প্রয়োজন। প্রশ্ন হল, ফ্যাসিবাদ বিরোধী জনগণের জোটের সামনে কী অর্থনৈতিক এজেন্ডা উপস্থাপন করা উচিত? উচিত, সমাজের প্রত্যেকের জন্য একটি মৌলিক ন্যূনতম আয়ের বিধান। তাই এই সঙ্কটকালীন সময়ে কমপক্ষে কমপক্ষে পাঁচটি মৌলিক অর্থনৈতিক অধিকারকে সাংবিধানিক স্বীকৃতির লক্ষ্যে সংগ্রাম জোরদার করতে হবে। সেগুলি হল এক, প্রত্যেক নাগরিককে প্রতিটি নাগরিককে গণবন্টন ব্যবস্থার মাধ্যমে নামমাত্র মূল্যে নির্দিষ্ট পরিমাণ খাদ্যের অধিকার দিতে হবে। দুই,  প্রত্যেকের জন্য কর্মসংস্থান বাধ্যতামূলক করতে হবে। তিন, সার্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রত্যকের কাছে বিনামূল্যে শিক্ষার অধিকার (অন্তত উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত) পৌছে দিতে হবে । চার, বিনামূল্যে প্রত্যেক নাগরিকের স্বাস্থ্য পরিষেবা সুনিশ্চিত করতে হবে এবং পাঁচ, অ-অনুদানমূলক বার্ধক্য পেনশনের সুবিধা পাওয়ার অধিকার প্রদান করতে হবে।’’  এদিন স্মারক বক্তৃতায় সভাপতিত্ব করেন প্রাক্তন অধ্যাপক প্রণব কুমার চট্টোপাধ্যায়। উপস্থিত ছিলেন অনুষ্ঠানের কো-অর্ডিনেটর অপূর্ব কুমার চট্টোপাধ্যায় এবং বিভাগীয় প্রধান সৌম্য চক্রবর্তী। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে বক্তব্য রাখেন অধ্যাপক সুদীপ্ত ভট্টাচার্য।

 

Comments :0

Login to leave a comment