Cattle Smuggling Anubrata Mandal

এফআইআর রহস্যে ভরা!

রাজ্য

Cattle Smuggling Anubrata Mandal

 হাস্যকর এফআইআর’র বয়ান! 
অভিযোগপত্রে যেমন উল্লেখ নেই ঘটনার দিন কিংবা সময়, এফআইআর’এও তেমনই নেই কিছু। বরং এফআইআর’র নির্দিষ্ট কলমে ঘটনার দিনের জায়গায় লেখা আছে, ‘মে মাসের যে কোনও দিন’ আর সময়ের জায়গায় লেখা আছে, ‘উল্লেখ নেই’! সেই অভিযোগের ভিত্তিতে ভর করেই সোমবার সকাল ১১টা ৭ মিনিটে এফআইআর করে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে আসানসোল জেলে গিয়ে অনুব্রতকে ‘জিজ্ঞাসাবাদ’ সম্পূর্ণ করে ‘শোন অ্যারেস্ট’ দেখিয়ে ‘প্রোডাকশন ওয়ারেন্ট’ নিয়ে মঙ্গলবার ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই তাঁকে নিয়ে পুলিশ রওনা দেয় দুবরাজপুর আদালতে! 
এদিকে দিল্লির রাউস অ্যাভিনিউ কোর্টে অনুব্রত মণ্ডলকে দিল্লিতে ইডি’র দপ্তরে নিয়ে এসে জেরা করার রায়কে চ্যালেঞ্জ করে দিল্লি হাইকোর্টে আবেদন জানানো হয়। রাউস অ্যাভিনিউ কোর্টের নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করে দিল্লি হাইকোর্টে যে মামলা হয়েছিল, বুধবার সেই শুনানি পিছিয়ে গিয়ে পরবর্তী তারিখ ঠিক হয়েছে ২০২৩’র ৯ জানুয়ারি। অর্থাৎ অনুব্রত আপাতত তাঁর নিজের জেলা বীরভূমেই কার্যত সরকারি আতিথেয়তাতেই থাকবেন। দিল্লি হাইকোর্টে এরপরে ইডি’ও জানিয়েছে পরবর্তী শুনানি পর্যন্ত তাঁকে দিল্লি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে না। ফলে গোরু পাচারকাণ্ডে আপাতত দিল্লি যাত্রা স্থগিত। এমনটাই চাইছিল সরকার, শাসক দলও। তাই মঙ্গলবার এমন নাটকীয়ভাবে এফআইআর সাজিয়ে পুলিশ হেপাজতে নেওয়া হয় অনুব্রতকে।


এদিকে এদিনই অনুব্রতর তরফে আইনজীবী কপিল সিবাল দিল্লি হাইকোর্টে বেঞ্চ বদলের আবেদন জানান। বেঞ্চ বদলও হয়। প্রথমে মামলাটি দিল্লি হাইকোর্টের বিচারপতি জয়রাম ভাম্বানির বেঞ্চে উঠেছিল। বুধবারই বিচারপতি যশমিত সিং-র বেঞ্চে শুনানি হয়। এদিন আবার অনুব্রতর তরফে সওয়াল করেন আরেক অভিষেক মনু সিংভি। মমতা ব্যানার্জির সরকার যে অনুব্রতর দিল্লি যাত্রা ঠেকাতে সর্বোচ্চ শক্তি ব্যয় করছে, তা স্পষ্ট ঘটনা পরম্পরায়।
শুনানি পিছিয়ে যাওয়ায় স্বস্তিতে অনুব্রত। এদিন দিল্লি হাইকোর্ট ইডি’কে নির্দেশ দেয় তারা যাতে ই-মেল করে আদালতকে লিখিতভাবে জানায়, এখনই প্রোডাকশন ওয়ারেন্ট ব্যবহার করা হবে না অর্থাৎ অনুব্রতকে পরবর্তীর শুনানির আগে দিল্লিতে জেরার জন্য আনা যাবে না। শুক্রবার থেকে দিল্লি হাইকোর্টে বড়দিনের ছুটি পড়ে যাচ্ছে। অবকাশকালীন বেঞ্চেও হবে না এই মামলার শুনানি। ৯ জানুয়ারি শুনানি হবে।
গত শনিবার দিল্লির রাউস অ্যাভিনিউ কোর্টে শুনানি শেষ হয়েছিল, সেই রায়দান সোমবার পর্যন্ত স্থগিত রাখা হয়েছিল। এদিকে জেলা পুলিশের একটি সূত্রেই জানা গিয়েছে রায় কী হতে পারে তা আগাম টের পেয়েই পরিকল্পনা সাজানো শুরু হয় শনিবার রাত থেকেই। জেলা পুলিশের শীর্ষ কর্তাও তা নিয়ে গোপনে আলোচনায় বসেন। সোমবার রায় হলে মঙ্গলবারের মধ্যে ইডি গোরু পাচারে অভিযুক্ত অনুব্রতকে দিল্লি নিয়ে যেতে পারে। ফলে সোমবারের মধ্যে অনুব্রত জেলা পুলিশের হাতেই রাখার জন্য পরিকল্পনা সাজানো হয়। নবান্নের শীর্ষকর্তারাও সেই পরিকল্পনায় শামিল হয়েছিলেন। গোটা প্রক্রিয়াটা সুষ্ঠুভাবে করতে অনুব্রতকে ‘গ্রেপ্তার’ করার আগে রাতভর চলেছে সেই শলাপরামর্শ। 


যদিও সেই অভিযোগ দায়েরের পর তিন দিন পেরিয়ে গেলেও অভিযোগকারীর বয়ান পর্যন্ত পুলিশ এখনও রেকর্ড করেনি। এব্যাপারে অনুব্রতর বিরুদ্ধে অভিযোগ করা তাঁরই দলের নেতা শিবঠাকুর মণ্ডল বুধবার সকালে বলেছেন, ‘আমি গত সোমবার অভিযোগ করেছিলাম। তারপর থেকে পুলিশ আর আমার সাথে যোগাযোগ করেনি। বয়ান রেকর্ড করেনি।’ 
শুধু তাই নয়, এফআইআর’এ অফিসার ইন চার্জের জায়গায় স্বাক্ষর রয়েছে সেখ কাবুল আলি নামে এক অফিসারের। সেখানে উল্লেখ করা হচ্ছে, তিনি নিজেই করবেন এই মামলার তদন্ত। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, দুবরাজপুর থানার ওসি তো কাবুল আলি নন। তাহলে কি বর্তমান ওসি’কে ছুটিতে পাঠিয়ে এই এসআই কাবুল আলিকে থানার চার্জ দিয়ে তদন্তকারী আধিকারিক করা হয়েছে কোনও বিশেষ উদ্দেশ্যে?
যেহেতু নিজেদের হাতে সাজানো হয়েছিল চিত্রনাট্য তাই অনুব্রত যে দুবরাজপুর থানায় আসতে চলেছেন তাতে নিশ্চিতই ছিল পুলিশ। তাই আগেভাবে দুবররাজপুর থানার এসআই’দের বসার ঘর ফাঁকা করে তা অনুব্রতর শয়নকক্ষে পরিণত করা হয়েছে। যাতে মমতা ব্যানার্জির স্নেহধন্য এই বাহুবলী নেতার কোনও অসুবিধা না হয়। থাকা-খাওয়া নিয়ে যাতে কোনও অভিযোগ না ওঠে। বাড়ির মতোই পরিবেশ যাতে উনি পান। সিসিটিভি’রও ব্যবস্থা  হয়ে গিয়েছে রাতারাতি। তবে নিরাপত্তা রয়েছে আঁটোসাঁটো। থানার ভেতরে অনুব্রতর জন্য ‘আতিথেয়তা’র ব্যবস্থা কেমন তা যাতে কোনোভাবেই বাইরে প্রকাশ না হয় তারজন্য কড়া নজর রেখেছে পুলিশ। অনুব্রতর ইচ্ছাতেই সাজানো হচ্ছে খাবারের তালিকা। 


এদিন সকালে সেই থানাতেই প্রবেশ করতে দেখা যায় সিউড়ি জেলা আদালতের সরকারি আইনজীবী তথা তৃণমূলের সহ সভাপতি মলয় মুখার্জিকে। প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘অন্য একটি মামলার নথি সংক্রান্ত কাজে থানায় এসেছিলাম। শুনলাম অনুব্রত মণ্ডল ভালো আছেন’। এখানেও উঠছে প্রশ্ন, যেখানে অনুব্রতর সাথে দেখা করা নিয়ন্ত্রিত সেখানে তৃণমূল নেতা তাঁর প্রশাসনিক পদ ব্যবহার করে প্রবেশ করে যাচ্ছেন অনায়াসে। কারণ তখন তিনি সরকারি আইনজীবী! আবার অনুব্রতকে যখন স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তখনও তিনি থাকছেন অনুব্রতর গায়ে গায়ে। তখন তিনি হয়ে যাচ্ছেন দলের সহ সভাপতি! 


অন্যদিকে এদিন বালিজুড়ি গ্রাম থেকেই ফের শিবঠাকুর মণ্ডলের বিরুদ্ধে উঠেছে মারাত্মক অভিযোগ। গ্রামের বাসিন্দা দীপকচন্দ্র মণ্ডলের স্পষ্ট অভিযোগ, ‘এই শিবঠাকুর মণ্ডল আমার ছেলের চাকরি দেওয়ার নাম করে দেড় লাখ টাকা নিয়েছিল। চাকরিও পায়নি, টাকাও ফেরত পায়নি।’ শুধু একজন নয়, এমন অভিযোগ শোনা গিয়েছে আরও কয়েকজনের মুখেই। গ্রামের কয়েকজন যুবকই বলেছিলেন, ‘কিছুই ছিল না শিবঠাকুরের। তারই এখন বাড়ি, গাড়ি, জমি জায়গা। বাড়ি আবার সিসিটিভি’তে মোড়া। প্রধান হওয়ার পর থেকেই তার রমরমা বেড়েছে। অনুব্রতকে ‘সাহায্য’ করার জন্য এগিয়ে আসার বিনিময়ে নিশ্চিতভাবেই কোনও না কোনও রফা হয়েছে, সামনেই আবার পঞ্চায়েত ভোট।
 

Comments :0

Login to leave a comment