Hirbandh couple committed suicide

অভাবের তাড়নায় অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে নিয়ে আত্মঘাতী আদিবাসী খেতমজুর

জেলা

কাজ না থাকায় তীব্র অভাবের তাড়নায় অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে নিয়েই আত্মহত্যার পথ বেছে নিল এক আদিবাসী খেতমজুর। বৃহস্পতিবার সকালেই হিড়বাঁধের ভুয়াকানা (জামবেদিয়া) গ্রামের একটি গাছের ডালেই কাপড় জড়িয়ে আত্মহত্যা করেন এই গ্রামেরই বাসিন্দা প্রদীপ সর্দার (২৩) ও তাঁর স্ত্রী সাবিত্রী সর্দার (২৩)। ঘরে পড়ে রইল প্রদীপের ১৫বছরের বোন দশম শ্রেণির ছাত্রী পূর্ণিমা ও হায়দরাবাদে পরিযায়ী শ্রমিক হিসাবে কাজ করতে যাওয়া ২০বছরের ভাই সন্দীপ। এই হিড়বাঁধ এলাকা রানিবাঁধ বিধানসভার মধ্যে পড়ে। রাজ্যের খাদ্য দপ্তরের রাষ্ট্রমন্ত্রী জ্যোৎস্না মান্ডি এই কেন্দ্র থেকেই বিধায়ক। 
গ্রামের ৮০টি পরিবারের মধ্যে ৭০টি পরিবারেই কোনও কাজ নেই। পঞ্চায়েতের কোনও ভূমিকা নেই। এই গ্রাম থেকেই হিড়বাঁধ পঞ্চায়েতের উপপ্রধান নির্বাচিত। কিন্তু উপপ্রধান এই গ্রামে কখনও পা রাখেন না। এই ঘটনার পর শুনশান করছে ভুয়াকানা গ্রাম। শুধু ভুয়াকানা নয়, পাশাপাশি দেউলাগড়া, দুসতিনা, খাঁদারানী আদিবাসীপাড়া, কাটাগোড়া, মোসলেহা, চেপারডিহি, গোবরদা সহ এই অঞ্চলের একাধিক গ্রামের মানুষ অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার প্রশ্নে দিশেহারা। শুক্রবার গ্রামে যেতেই একাধিক মানুষের প্রশ্ন, কীভাবে আমরা বাঁচবো বলুন? আমাদেরকেও কি এই পথ বেছে নিতে হবে? হিড়বাঁধের ভুয়াকানা গ্রামে জনমজুর দম্পতির গাছে ঝোলা টাটকা লাশ ফের আর একবার প্রমাণ করে দিল জঙ্গলমহল কেমন হাসছে। কেমন কাটছে এ রাজ্যের গরিব মানুষের একদিন-প্রতিদিনের জীবন। 
প্রদীপ সর্দারের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল তাঁর বাড়ির টিনের চালা ফুটো হয়ে কোনরকমে দেওয়ালে চেপে আছে। হেলে পড়েছে দেওয়ালগুলিও। প্রদীপের বাবা সুভাষ সর্দার ইটভাটার শ্রমিক ছিলেন। প্রতিদিন কাজ মিলত না। মা পুঁটিবালাও ছিলেন দিনমজুর। প্রয়োজনীয় খাদ্যের অভাবে শরীরে দুজনেরই অপুষ্টি বাসা বাধে। ২০২০সালে লকডাউনে সব কাজ চলে যায়। শরীর অসুস্থ হয়ে পড়ে দুজনেরই। একপ্রকার বিনা চিকিৎসাতেই ঐ বছরেই তিনমাসের ব্যবধানে প্রদীপের মা, বাবা মারা যান। মারা যান এক জ্যাঠা দিনমজুর অজিত সর্দারও। 
গত বছর ঝাড়গ্রাম জেলার বেলপাহাড়ি এলাকার সাবিত্রী সর্দারের সঙ্গে প্রদীপের বিয়ে হয়। প্রদীপ খাতড়া সহ বিভিন্ন জায়গায় রাজমিস্ত্রির জোগানদারের কাজ করতেন। স্ত্রীও চাষের সময় মাঝে মধ্যে খেতমজুরের কাজ করতেন। এই এলাকায় আমনের সময়ই খালি কাজ মেলে। বছরে ১০মাস বসেই কাটাতে হয় এঁদের। প্রদীপের ভাই সন্দীপ কাজের জন্য পরিযায়ী শ্রমিক হিসাবে গত বছরই হায়দরাবাদে চলে গেছে। ছোট বোন পূর্ণিমা দেউলাগড়া স্কুলের দশম শ্রেণিতে পাঠরত। 
পূর্ণিমা জানায়, ‘দাদার এখন কোনো কাজ ছিল না। প্রায় ১০দিন কোনও কাজ মেলেনি। খালি খাতড়া যেত। আর খালি হাতে ফিরে আসত। রেশনে মাসে যে চালটুকু পাওয়া যায় তাতেও আমাদের তিনজনের পেট ভরত না।’ এক প্রতিবেশি মহিলা জানান, অন্তঃসত্ত্বা থাকায় তাঁকে তো অতিরিক্ত কিছু খাবার দিতেই হবে। সেই খাবারও সংগ্রহ করতে পারেনি প্রদীপ। কারণ, কোনো কাজই তো ছিল না। 
ভাঙা বাড়িতে একটি ঘর। পাশে জ্যাঠার ঘরে পূর্ণিমা থাকত। প্রতিবেশিদের ধারণা, বুধবার রাতেই ওরা ঘর থেকে বেরিয়ে গ্রামের উত্তর দিকে একটি গাছের ডালে দুজনে গলায় কাপড়ের ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে। বৃহস্পতিবার তাঁদের দেহ উদ্ধার করা হয়। এদিন গ্রামের বাসিন্দা স্বপন, শুকদেব সর্দাররা জানান, এই গ্রামে ৮০টি পরিবার বাস করেন। তার মধ্যে আদিবাসী ভূমিজ, সাঁওতাল, মুসলিম, গোয়ালা জনগোষ্টীর মানুষজন আছেন। বড় অংশের যুবক পরিযায়ী শ্রমিক হিসাবে বাইরে চলে গেছেন। আগে খাতড়া, গোড়াবাড়িতে যে ইটভাটা ছিল সেগুলোর বেশিরভাগই বন্ধ। গ্রামে রেগার কাজ নেই। বালি বন্ধ। ফলে নির্মাণ শ্রমিকের কাজও স্তব্ধ হয়ে গেছে। মানুষগুলো যে কিভাবে দিন কাটাবেন তার কোন নজর নেই, সরকার, পঞ্চায়েতের। প্রধানমন্ত্রী আবাসযোজনার বাড়িও নজরে পড়ল না। শুকদেব সর্দার জানান, তাঁর ছেলেও গুজরাটে কাজ করতে চলে গেছে। তার পাঠানো পয়সাতেই আমাদের পেট চলে। 
এদিন সিপিআই(এম) বাঁকুড়া জেলা নেতা মাধব মণ্ডল জানান, খালি হিড়বাঁধ অঞ্চল থেকেই ২৫০০ যুবক পরিযায়ী শ্রমিক হিসাবে বাইরে চলে গেছে। আর পুরো ব্লক ধরলে সংখ্যাটা ১০ হাজারে গিয়ে পৌঁছাবে। আক্ষরিক অর্থেই ধুঁকছে হিড়বাঁধ ব্লক। পুলিশের পক্ষ থেকে শুক্রবার জানানো হয়, তারা মৃত্যুর কারণ খতিয়ে দেখছে। এলাকার মানুষের বক্তব্য, প্রশাসনের কাছ থেকে কোনদিনই এর কারণ জানা যাবে না। কারণ একটাই, তা হল তীব্র অভাব। একের পর বাড়িতে অপুষ্টিতে ভুগছেন মানুষ। আর এই জ্বালা সহ্য করতে না পেরে প্রদীপ সর্দারের মতো যুবকরা স্ত্রীর পেটে সন্তান সহ আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। আর কত ঘটনা ঘটবে? রক্তশূন্য মুখ নিয়ে হিড়বাঁধের মানুষের কাছে এখন একটাই প্রশ্ন। 

Comments :0

Login to leave a comment