Panchayat vote 2023

নব্য ধনীদের বিরুদ্ধে লড়ছেন রেণুকা বাউরিরা, তৃণমূলের মহাজনের হাতে মাইনের টাকাও

জেলা

অভিমন্যুর চক্রব্যূহ! জাল ছিঁড়ে বেরোনো অসম্ভব। মাইক্রোফিনান্স গিলে খাচ্ছে একের পর এক গ্রামীণ জনপদ। রাজ্যের একাধিক প্রান্তে মিলেছে সেই ছবি।
আরও ভয়াবহ চেহারা সামনে আসছে কয়লাঞ্চলে। 
মাইক্রোফিনান্সের ধাঁচেই লুম্পেন পুঁজির কবলে খনি মহল্লা। সামান্য ক’টা টাকার ঋণের জালে আটকে পড়ছে শ্রমিক মহল্লাগুলি। শাসক তৃণমূলের নব্য ধনীদের ঋণের জালে বিস্তীর্ণ তল্লাট।
কীভাবে? দেখতে হলে আসা যেতে পারে উখরা, খান্দরা, কাজোরা, অণ্ডালে। পুঁজির এক বিকৃত চেহারা। সুদখোর মহাজন শাসকের পাল্লায় পড়ে কার্যত সর্বস্বান্ত হচ্ছে শ্রমিক মহল্লাগুলি।
অণ্ডাল ব্লকের খান্দরা পঞ্চায়েতের নাগস খান্দরা কোলিয়ারি। সকালে গেলেই চত্বরে দেখা মিলবে শাসক তৃণমূলের দাপুটে নেতা ভোম্বলের। এই এক ব্যক্তির কাছ থেকেই কয়েকশো শ্রমিক ঋণ নিতে বাধ্য হয়েছেন। সুদের হার? দশ হাজার টাকা নিলে মাসে ১২০০ টাকা করে সুদ। তাও চলছে বছরের পর বছর। নাম কে ওয়াস্তে একটি চুক্তিপত্র, তাতে টিপ সই কোলিয়ারি শ্রমিকদের। এত অঙ্ক বোঝেন না সুরেশ বাউরি। শুধু জানেন রোজের টাকার সবটাই দিতে হয়। লোন নাকি শেষই হচ্ছে না!
শুধু তাই নয়, হাজার পঞ্চাশেক টাকা ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে কোলিয়ারি শ্রমিকের ব্যাঙ্কের পাসবই, বেতনের স্লিপও নিয়ে নেয় সুদখোর মহাজনরা। মাইনের টাকার সবটাই হাতে চলে যায় মহাজনের। সেখান থেকেই একটা টাকা শ্রমিকের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়, বাকি টাকা মহাজনের পেটে। ‘মানবিক’ মুখ দেখাতে পুজো বা কোনও পরবের সময় তাঁদের জামাকাপড়ও কিনে দেওয়া হয়। মাইনের টাকা মহাজনের হাতে, ব্যাঙ্কের পাসবই মহাজনের হাতে— ঋণ চলছে তো চলছেই। রুক্ষ, ধুলোমাখা কোলিয়ারি মহল্লা ধীরে ধীরে অসাড় হচ্ছে।
এই চিত্র অণ্ডালের বিস্তীর্ণ কয়লা তালুকেই। সেই সুদখোর তৃণমূল নেতা ভোম্বলই এখন নবজোয়ারে ভেসে ভাইপোর ‘নতুন তৃণমূল’-এর অণ্ডাল পঞ্চায়েত সমিতির প্রার্থী! বন্ধন ব্যাঙ্ক থেকে শুরু করে নানান কিসিমের ঋণদানকারী সংস্থার জায়গায় এখন তৃণমূল নেতাদের ব্যক্তি পুঁজির জালে শ্রমিক মহল্লাগুলো।
সিপিআই(এম) নেতা তুফান মণ্ডল নির্বাচনী প্রচারের ফাঁকেই বলছিলেন তাঁর অভিজ্ঞতা। কাজোরা দক্ষিণ খণ্ডের একটি গ্রামে মানুষের সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিলেন। হঠাৎই দেখলেন দু’টি বাইকে করে চারজন গ্রামে ঢুকল। ‘আশ্চর্য হলাম, তাঁদের দেখেই লোকজন সব লুকিয়ে পড়ল, প্রথমে ভাবলাম তাহলে কি হামলা চালাতে এসেছে দুষ্কৃতীরা? আমি দাঁড়িয়েই থাকলাম। দেখলাম তা নয়, কিছুক্ষণ গ্রামে খোঁজাখুঁজি করার পরে কাউকে না পেয়ে চলে গেল। তারা যেতেই মানুষজন আবার বেরিয়ে এল।’ তুফান মণ্ডলের কথায়, ‘আসলে ওরা বাউন্সার ছিল। ঐ যে মাসে দশ হাজার টাকার জন্য মাসে ১২০০টাকার সুদ। তা হয়তো এক সপ্তাহ কেউ দিতে পারেনি। বাউন্সার চলে এসেছে। তার মানে তৃণমূলের সুদখোর নেতারা বাউন্সারও পোষে গরিবের কাছ থেকে টাকা নিতে’।
ব্যাঙ্ক তো দূর অস্ত, এমনকি মাইক্রোফিনান্সের সংস্থাও নয়, একেবারে ব্যক্তিপুঁজির মহাজনী ঋণের জালে আটকাচ্ছে শ্রমিক জনপদ। মাকড়সার জালের মতো আটকে পড়া সেই মানুষগুলির ভোটও নির্বিচারে লুট হয় তাদের ‘বাবু’দের হাতে। সুদে ঋণ দিচ্ছে যে বাবু, ভোট লুটও করছে সেই ‘বাবু’!
সুদখোর সেই নেতারাই তৃণমূলের একাধিক পঞ্চায়েতের সদস্য। কয়লা মাফিয়াদের দাপটের মাঝেই তাই বিস্তীর্ণ কোলিয়ারি এলাকায় একের পর এক শ্রমিক লাইন এভাবে কুক্ষিগত করছে শাসক তৃণমূল। প্রতিরোধের লড়াইয়ের বৃত্ত তাই এখানে অনেক বড়, গভীরও বটে।
ব্যাঙ্ক কর্মচারী আন্দোলনের সর্বভারতীয় নেতা, সারা ভারত নাবার্ড কর্মচারী সমিতির সাধারণ সম্পাদক রানা মিত্রের কথায়, ‘এ তো ভয়াবহ পরিস্থিতি। সরকার, প্রশাসন কোথায়? এরজন্য আমরা বারেবারে প্রতিষ্ঠানিক ঋণ অর্থাৎ ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী, সহজে ঋণ পাওয়ার কথা বলছি। একই সঙ্গে সমবায় ব্যবস্থাকে মজবুত করা প্রয়োজন। যদিও গত এক দশকে তৃণমূল শাসনে এরাজ্যে সমবায় ব্যবস্থাটাই কার্যত ভেঙে ফেলা হয়েছে। ফলে গরিব মানুষকে সুদখোরদের হাতেই ধরা দিতে হচ্ছে।’
একদিকে, ব্যক্তি পুঁজির ঋণের জালে আটকে রাখা, অন্যদিকে সরকারি প্রকল্পের সুযোগ থেকে পরিকল্পিতভাবে তাঁদের বঞ্চিত করা—যাতে মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে। এই ভয়াবহ কৌশলই শাসক তৃণমূলের।
উদাহরণ সেই খান্দরা। কয়েকদিন আগেই মনোনয়ন প্রত্যাহারে শাসক তৃণমূলের বহিরাগত দুষ্কৃতী বাহিনীর হামলার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর লড়াই করেছে খান্দরা। সিপিআই(এম)’র প্রতিরোধের মুখে মনোনয়ন প্রত্যাহার করাতে পারেনি তৃণমূলী বাহিনী। অণ্ডাল ব্লকে সেই আস্ত খান্দরা পঞ্চায়েতই সরকারের ‘আবাস প্লাস’ তালিকা থেকে বাদ‌!
গোটা একটা পঞ্চায়েতই বেমালুম উবে গেছে সরকারের তালিকা থেকে। সিপিআই(এম) নেত্রী দেবমিতা চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, ‘একবার ভাবুন আস্ত একটা খান্দরা এলাকাই তালিকা থেকে বাদ। মানে তৃণমূল বলতে চাইছে যে খান্দরা এলাকায় একজনও গরিব মানুষ নেই? সব ওদের মতো কাঁচা টাকার মালিক? আসলে খান্দরায় সিপিআই(এম) কর্মী, সমর্থকরাই আছেন, তাই বাদ দাও গোটা গ্রাম’। অথচ রীনা বাউরি, অর্জুন বাউরির মতো মানুষগুলির মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই। নাগস খান্দরা কোলিয়ারির বাসিন্দা। যেখানে থাকেন সেটাকে ঘর বললেও বাড়াবাড়ি। কিচ্ছুটি নেই। কতবার পঞ্চায়েতে হত্যে দিয়েছেন, দুয়ারে সরকারের শিবিরেও গেছে। ফল কিছু মেলেনি। 
এই পঞ্চায়েতেরই নবজোয়ারের তৃণমূলের প্রার্থী আশিস ভট্টাচার্য। চাকরি, ব্যবসা কিছুই করেন না। একসময় বাবা অন্যের বাড়িতে রান্না করে সংসার চালাতেন। স্রেফ মমতা ব্যানার্জি-অভিষেক ব্যানার্জির অনুগামী— এই পরিচয় দিয়েই এখন গ্রামে পেল্লাই তিনতলা বাড়ি, একাধিক গাড়ি। এখন গ্রামের সবথেকে পয়সাওয়ালা ব্যক্তি! খান্দরায় এখন তাঁর বিরাট মার্বেলের শোরুম! সেই দোকানের বাইরেই এলাকার মানুষজনই আবার পোস্টার সেঁটে দিয়েছেন- ‘এত পয়সা কোথা থেকে আসে?’
খান্দরা গ্রাম পঞ্চায়েতেরই সিপিআই(এম) প্রার্থী রেণুকা বাউরি। বাবা দিনমজুর। অশক্ত শরীরে আর জোরও নেই, কাজ জোটে না। মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়তে পেরেছেন রেণুকা। পড়াশোনার খরচ টানতে গেলে খালি পেটে থাকতে হতো বাকিদের, তাই তিনি আর পড়াশোনা করতে পারেননি। এখন দু’বেলা ভাতের দাম জোগাড়ে গৃহপরিচারিকার কাজ করেন। বাড়ি বলে কিছু নেই, ভেঙে পড়া কোনোমতে একটা ঝুপড়ির মতো ঘর।
সেই রেণুকা বাউরি তৃণমূলের নব্য ধনীদের বিরুদ্ধে লালঝান্ডার প্রার্থী। ২০১৯’র ডিসেম্বর চিত্তরঞ্জন থেকে কলকাতা শিল্পের দাবিতে, কাজের দাবিতে ২৮৩ কিলোমিটার লং মার্চে হেঁটেছিলেন রেণুকা বাউরি। তাঁর কথায়, সেই লং মার্চই বদলে দিয়েছে তাঁকে, ইস্পাতদৃঢ় করেছে।

 

Comments :0

Login to leave a comment