Farmers crisis bardhaman

চাষের সঙ্কট বেআব্রু, ছ’মাসে শুধু বর্ধমানের মর্গেই ১৫০ গরিবের দেহ

জেলা

  সলদার ধু ধু মাঠ। নিমো-২ পঞ্চায়েতের এই মাঠে একসময় সোনালি ধানের শিষে ঢেউ খেলত। এখন সেই জমি বন্ধ্যা হয়ে পড়ে রয়েছে। কৃষকের চাষে অনীহা। ছোট কৃষক হায়দার মল্লিক শোনালেন, ‘‘কয়েক বছর টানা লোকসানের পর আর বোরোচাষ করছি না।’’ 
একসময়ে কৃষকের জমিতে চুক্তিচাষ করতেন গরিবরা। ফসলের একটা অংশ পেতেন মালিক, বাকিটা গরিবরা। গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতা, গতর খাটিয়ে চাষ করার পরে খরচটুকুও উঠছে না। ফলে গরিবরাও আর জমির ধারেকাছে যাচ্ছেন না। তাঁদের আক্ষেপ, ‘‘জমি তো নয়, যেন যম!’’ মেমারির সলদা শুধু নয়, কেন্না, বহেরা, দেউলিয়া, সড়ডাঙা, আলিপুরের সব জমিই এখন চড়া রোদে ফেটে চৌচির।  
জমিতে কৃষকের চাষ নেই মানে খেতমজুরেরও কাজ নেই। বোরোচাষ হলে খেতমজুর যে কাজ পেতেন, এখন সেই জমি অনাবাদি পড়ে থাকায় খেতমজুররাও বেকার। তাই কৃষকের ঘরে এখন যেমন অভাব, প্রায় অনাহার চলছে খেতমজুরের ঘরেও। গ্রামে কাজ নেই, তাই কুডু মান্ডি, শেখ সুলেমানরা সারাদিন শহরের মোড়ে কাজের সন্ধানে বসে থাকেন। বিকেলে ফিরে আসেন খালি হাতে। খেতমজুরের ঘরে প্রায়শই এখন আর হেঁসেল জ্বলে না। সেই আলু ওঠার সময় ক’দিন কাজ ছিল, তারপর টানা সাড়ে তিন মাস বসে। ধার-দেনায় জেরবার অবস্থা। গ্রামের মুদিখানাও আর ধার দিচ্ছে না খেতমজুরদের। বাড়ির মেয়েরা সকাল হলেই বেরিয়ে পড়ছেন কলমি শাক, গুগলি, কাঁকড়া, কচু, শুশুনি শাক, সজনে শাক খুঁজতে। পুরুষরা কাজের সন্ধানে গ্রাম ছাড়ছেন, কারণ এই পোড়া বাংলায় কাজ নেই। একশো দিনের কাজ পুরো বন্ধ। যাঁরা আগে রেগা’র কাজ করেছিলেন, তাঁরাও মজুরি পাননি এখনও!
অভাবের তাড়নায় খেতমজুররা এখন সপরিবারে ধান রুইতে চলে যাচ্ছেন কেরালা, কর্ণাটক, তামিলনাড়ুতে। তাতেও দালালের উৎপাত। গরিবের মজুরির একটা অংশ দালালরা জোঁকের মতো চুষে খাচ্ছে।  কেরালা, তামিলনাড়ুর কফি বাগানেও কাজ করছেন বাংলার বহু গরিব মানুষ। যাঁরা বাইরে যেতে পারছেন না তাঁরা হয় অনাহারে, নতুবা আধপেটা খেয়ে পড়ে আছেন গ্রামে। মওকা বুঝে মাইক্রোফিনান্স কোম্পানির ঋণের জাল অক্টোপাশের মতো জড়িয়ে ধরছে গ্রামের গরিবদের। তাদের থেকে ঋণ নিলেই অত্যাচার শুরু। সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনে সুদের টাকা না দিতে পারলে হুমকি দিয়ে যাচ্ছে মাইক্রোফিনান্সের বাউন্সাররা। 
রুজি-রুটির এই বিপদ থেকে মানুষকে ভুলিয়ে রাখতে শাসকদলের লোকজন গ্রামে গ্রামে গড়ে তুলেছে চোলাই মদের ‘শিল্প’। গ্রাম ঘুরলেই এখন আকছার চোখে পড়বে মদের ভাটি। কুইন্টাল কুইন্টাল মদ প্যাকেট-ভর্তি হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। সঙ্গে ২০টাকার সরকারি মদের পাউচ তো আছেই। চোলাই মদ খেয়ে বিষক্রিয়ায় মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে যখন তখন। এই মদের ওপর ভিত্তি করেই কোটি কোটি টাকা শুল্ক তুলে দান-খয়রাতি চালিয়ে যাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী, অভিযোগ করছেন গরিবপাড়ার মহিলারা।
চাষে এই অনাগ্রহ কেন? কৃষকরাই জানাচ্ছেন, গত কয়েক বছরে ফসল বিক্রি করে লাভের মুখ দেখা যায়নি। অথচ সার, বীজ, কীটনাশক, সেচের জল কিনতে খরচ হয়েছে আগের থেকে অনেক বেশি। আলুচাষের ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, যে ইফকো ১০:২৬:২৬ সারের দাম ছিল বস্তাপিছু ১৪০০টাকা, সেই সার কৃষককে কালোবাজারে কিনতে হয়েছে ২০০০-২২০০ টাকায়। এত দাম দিয়ে সার, কীটনাশক, বীজ কেনার পর আলু যখন উৎপাদন হলো, মাঠে তার দাম মাত্র ২০০-৪০০ টাকা বস্তা!  লাভ তো দূর অস্ত, উলটে মহাজনের ধার করা টাকাও শোধ করা যায়নি। গ্রামে গ্রামে সারের কালোবাজারিদের এই দাপট দেখেও সরকার চোখ বুজে রয়েছে। এই অবস্থায় আলু, ধানে পরপর লোকসান সয়ে শেষপর্যন্ত মধ্যবিত্ত কৃষক চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন, চুক্তিতে গরিবদের হাতে জমি ছেড়ে দিতে শুরু করেন। 
চুক্তিতে চাষ প্রথা গ্রামে একসময় খুবই বেড়ে গিয়েছিল। গরিব খেতমজুররা ভেবেছিলেন, জমিতে গতর খাটিয়ে যদি ২বস্তা ধানও ঘরে আসে, তাহলে ভাদ্র মাসে ছেলে-বউ খেয়ে বাঁচবে। কিন্তু গত ২-৪ বছরে জমি ঠিকে নিয়ে চাষ করার পর গরিব খেতমজুররা দেখছেন, গতরের মজুরির দামই উঠছে না। ফসলের কম দাম, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ফলন কমের দরুন  খেতমজুররাও এখন আর জমির ধারেকাছে যেতে চাইছেন না। জমি পড়ে থাকার আরেক কারণ হলো, আগে বোরোধান চাষের জন্য বিভিন্ন খালের মাধ্যমে সেচের জল দেওয়া হতো। এখন সেসব প্রায় বন্ধ। বিদ্যুতের দাম বেড়েছে, সাবমার্সিবলের জলের দামও। তাই চাষের খরচও আকাশচুম্বী। ফলে চাষের মাঠ এখন ধু ধু। চাষে আগ্রহ নেই কৃষকের, গরিবের কাজও নেই। এই সময়েই বহু ভাগচাষি ঋণের ফাঁসে আত্মঘাতীও হয়েছেন।  
খোঁজখবর করে দেখা যাচ্ছে, গত ছ’মাসে শুধুমাত্র বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গেই জমা পড়েছে ১৫০ জনের বেশি আত্মঘাতী গরিবের দেহ। এই মর্মান্তিক মৃত্যুগুলির পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ, ঋণের ফাঁস আর ভয়াবহ দারিদ্র। যাঁরা আত্মহত্যা করছেন তাঁদের আশি শতাংশই কমবয়সি। এঁদের গড় বয়স ২৫-৪০ বছর। এছাড়াও গত বারো বছরে শুধুমাত্র পূর্ব বর্ধমান জেলায় ১৮০ জনের বেশি কৃষক আত্মহত্যা করেছেন। কিন্তু গত ছ’মাসে পূর্ব বর্ধমান জেলায় ১৫০’র বেশি গরিব খেতমজুর, দিনমজুরের আত্মহত্যার ঘটনা রীতিমতো ভাবিয়ে তুলেছে প্রশাসনকে। যদিও আত্মহত্যার এসব ঘটনাগুলিকে ‘পারিবারিক অশান্তি’, ‘মানসিক অবসাদ’ ইত্যাদিতে দাগিয়ে দিতে চাইছে রাজ্য সরকার। গ্রামবাংলায় ছড়িয়ে পড়া চাষের সঙ্কটকে আড়াল করাই একমাত্র উদ্দেশ্য সরকারের, বলছেন কৃষকরা।
 

Comments :0

Login to leave a comment