Helpless Calcutta

হাত বাড়িয়ে যন্ত্রণা জানাচ্ছে অসহায় কলকাতা

কলকাতা

Helpless Calcutta ছবি রবীন গোলদার

ক্ষুধার জ্বালায় রাস্তায় ভিক্ষা করতে নেমেছেন সুন্দরীর মা, হালেমা বিবিরা। সাম্প্রতিককালের সমীক্ষা অনুযায়ী ক্ষুধা সূচকে আরও খানিকটা নেমে গেছে ভারত। বর্তমানে ১২১টি দেশের মধ্যে ১০৭ তম স্থানে অবস্থান করছে আমাদের দেশ। আর তার চোখ ধাঁধানো বিবিধ নমুনা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে কলকাতার ফুটপাতগুলিতেও। কলকাতায় ভিখারি আগেও ছিল, কিন্তু রাজ্যের অর্থনৈতিক বৃদ্ধি, কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তা কমার কথা। আশঙ্কার কথা হলো এই যে কলকাতার রাস্তায় ভিখারির সংখ্যা বাড়ছে, নতুন করে মানুষ ভিক্ষাবৃত্তিতে নামছেন বলে জানা যাচ্ছে।
যাদবপুর বাস স্ট্যান্ড এলাকার অন্যতম পরিচিত ব্যক্তিত্ব সুন্দরীর মা। কে তিনি? ভিখারি হিসাবেই পরিচিত। অনেক দিন ধরেই ভিক্ষে করেন? মোটেই না। তাহলে?  কদিন আগেও তিনি ঘরেই থাকতেন, উনুনে ভাত ডাল রান্নার পরে খাবার বেড়ে বরের অপেক্ষায় বসে থাকতেন নিজের বাড়িতে। আজ সেই সমস্ত রান্না-বান্নার পালা চুকে গেছে তাঁর। সারাদিন ভিক্ষে করে আর সময় কই ওসব করার! তাঁর আদব-কায়দা এখনও পাকা ভিখিরিদের মতন হয়ে ওঠেনি, ফুটপাতের কৌশল এখনও রপ্ত করতে পারেননি তিনি, কিন্তু চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন ভিক্ষে করেই আয় বাড়ানোর। আর কোনও পথ খুঁজে পাচ্ছেন না যে! 
১বছর আগে মারা গিয়েছেন তাঁর স্বামী। কলকাতা কর্পোরেশনে ১০০দিনের কাজের প্রকল্পে নিযুক্ত ছিলেন তিনি। যা পেতেন তাতে কোনোরকমে সংসারটা চলে যেতো। কিন্তু লকডাউনের সময় কাজ চলে যায় তাঁর। তারপর আর কোনও উপায় হয়নি। লড়াই চালিয়ে গিয়েছিলেন বেশ কিছুদিন। যা পেতেন তাই করতেন। শাসকদলের স্থানীয় নেতাদের সঙ্গেও যোগাযোগ করেছিলেন বহুবার। তাঁরা বরাবরই আশ্বাস দিয়ে পালিয়ে গেছেন। শেষ পর্যন্ত দুই মেয়ে রানি ও সুন্দরী এবং স্ত্রীকে ফেলে রেখে আত্মহত্যা করেন তিনি। তারপর থেকেই সব দায়ভার এসে পড়েছে সুন্দরীর মায়ের ওপর। সুন্দরীর মা তেমন লেখাপড়া জানেন না। কিন্তু ভিক্ষে করতে হবে কখনো ভাবেননি, তেমনভাবে বড়ও হননি। যে সমাজে পুরুষ মানুষ হয়েও তাঁর স্বামী কাজ পাননি সেখানে তিনি কী করে মেয়েদের পেট ভরাবেন? তিনি বললেন, ‘সুন্দরীর বাবা মারা যাওয়ার পর জীবন অন্ধকার হয়ে গেছিল আমাদের। বাড়ন্ত দুই মেয়েকে নিয়ে কী করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। কী করে পেট চালাবো? শেষমেষ পাড়ার লোকেরা ‘উপদেশ’ দিল ভিক্ষা করার। সেই থেকে এই রাস্তায় বসছি আমি। নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো। এভাবে যদি কিছু রোজগার করা যায়, সেই চেষ্টায় আছি।’


গড়ফার হালেমা বিবিও হঠাৎ করেই ভিখারিতে পরিণত হয়েছেন। তিনি ছিলেন পরিযায়ী শ্রমিক। ঝাড়খণ্ডে ইটভাটায় কাজ করতেন। আহামরি কিছু রোজগার কোনোদিনই ছিল না, তবুও কোনোরকমে চলছিল জীবন। মহামারীর আকালে তিনিও কাজ হারালেন। সেই সময়ে কোনোমতে বাড়ি ফিরতে পেরেছিলেন। কিন্তু ফেরার পরে জোটেনি কোনও কাজ। সরকার কোনোদিনও তাঁর দিকে ভ্রূক্ষেপ করেনি। তাই বাধ্য হয়ে আজ তিনিও কলকাতার রাস্তায়। কিন্তু গড়ফার ফুটপাতে স্বাভাবিকভাবেই তেমন কিছু পাওয়া মুশকিল। কাজেই কোলের ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে ক্ষুধার্ত অবস্থাতেই দিনগুজরান করতে হয় তাঁকে। শ্যামবাজারের পাঁচমাথার মোড়ে গোলবাড়ির পাশেও দেখা যাচ্ছে ভিখারির সংখ্যা বেড়ে গিয়েছে। শহরতলির নানা জায়গা থেকে তাঁরা এসে জড়ো হচ্ছেন কিছু রোজগারের আশায়। ট্রাফিক সিগন্যালে গাড়ি দাঁড়ালেই কেউ জানলার সামনে এসে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন, কেউ একটা ছেঁড়া কাপড় দিয়ে নিজের থেকেই গাড়ির বনেট মুছে দিয়ে হাত পাতছেন। কেউ বাসে উঠে ভিক্ষা করছেন তো কেউ লোকাল ট্রেনে, কেউ সাদা কাপড় পরে বাবা মারা গেছে বলে শ্রাদ্ধের জন্য টাকা চাইছেন, কেউ সোজাসুজি লকডাউনে কাজ চলে গেছে বলে একবেলা খাবারের জন্য সাহায্য চাইছেন। শিশুদের দিয়ে ভিক্ষা করানোও চলছে দেদার। সঙ্গে ব্যাটারি চালিত সাউন্ড বক্স দিয়ে তাদের বাসে তুলে দেওয়া হচ্ছে, অপুষ্ট কালিমাখা হাত বাড়িয়ে শিশুরা ভিক্ষা চাইছে।


এরকম কত যে ঘটনা আমাদের শহর ও শহরতলির বুকে উঁকি মারছে কে জানে! কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী ভারতে এখন ৪লাখেরও বেশি ভিখারি বাস করে। রাজ্যের প্রেক্ষিতে সর্বোচ্চ ভিখারি সংখ্যা পশ্চিমবঙ্গেই- ৮১২২৪জন। মহিলা ভিখারির সংখ্যাও সবচেয়ে বেশি এই রাজ্যেই। এরাজ্যে পুরুষের চেয়ে মহিলা ভিখারিই বেশি। কথা বললেই দেখা যাচ্ছে যে এঁদের বেশিরভাগ শুধু নিজেদের জন্য নয়, নিজেদের সন্তানের মুখ চেয়ে ভিক্ষা করতে বাধ্য হচ্ছেন। কলকাতার রাস্তায় ফুটপাতবাসীর সংখ্যা, ভিখারির সংখ্যার সাম্প্রতিক তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না সরকারের কাছ থেকে, বিগত জনগণনার রিপোর্টের ভিত্তিতেই তথ্য দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু লকডাউনের পরে রাজ্যে ভিখারির সংখ্যা বেড়ে গেছে বলেই মত প্রকাশ করছে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। তাদের মতে, দূরবর্তী জায়গায় গিয়ে পরিযায়ী শ্রমিকের কাজে বিপদ ও ঝুঁকির কারণে বিশেষ করে মেয়েদের দিয়ে ভিক্ষা করানো হচ্ছে। পরিবারের থেকে করানো হচ্ছে, আবার কখনো নির্দিষ্ট টাকার ভাগের বিনিময়ে নির্দিষ্ট এলাকায় তাদের ভিক্ষায় নামানো হচ্ছে। প্রতিবন্ধী, বৃদ্ধ বৃদ্ধা যাদের চেহারায় অসহায়ত্ব তারা তো আছেই, অনেক স্বাভাবিক কর্মক্ষম মানুষও এখন উপায়ন্তর না দেখে ভিক্ষাজীবী হয়ে উঠছেন। 

 


কিন্তু কল্লোলিনী তিলোত্তমার তো এমন হাল হওয়ার কথা ছিল না। মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি যে উন্নয়নের দাবি ফলাও করে প্রচার করে থাকেন তা সত্য হলে কলকাতায় ভিখারির সংখ্যা কমাই স্বাভাবিক ছিল। বাস্তবে তার কিছুই হয়নি। ফলে কর্মসংস্থানের সুযোগহীন মানুষের ভিক্ষাই সম্বল। গরমের দিনে এসি মেশিন চালিয়ে অথবা শীতের রাতে গরম কাপড় গায়ে চাপিয়ে বহু মানুষ যখন আবহাওয়া উপভোগ করছেন তখন আবহাওয়ার ধাক্কায় ফুটপাতে নীরবে মরে যাচ্ছেন বহু বৃদ্ধ বৃদ্ধা। ৬ বছর আগেই কলকাতায় ফুটপাতবাসী মহিলা নির্যাতিতা হওয়ার পরে কলকাতা কর্পোরেশন বলেছিল নাইটশেল্টারে কলকাতার ফুটপাতবাসীদের থাকার ব্যবস্থা করা হবে। কিন্তু বাস্তবে তার ভগ্নাংশও হয়নি। সিপিআই(এম)’র প্রাক্তন কাউন্সলির চয়ন ভট্টাচার্য জানালেন, কলকাতায় যে কয়েকটা নাইট শেল্টার চলে সেগুলিতে চরম অস্বাস্থ্যকর অবস্থা। পুরুষদের থাকার জায়গা নেই। এমনকি মহিলারাও সবাই জায়গা পায় না। আসলে ফুটপাতবাসীরা তো ভোটার নয়, তাই তাদের দিকে তৃণমূলের নজর দেওয়ার সময় নেই। 
তবে ফুটপাত সাফাই করতে মাঝে মাঝে পুলিশ হানা দেয়। সিভিক পুলিশকে দিয়ে তাড়ানো হয় ফুটপাতবাসীদের। যেমন, আমেরিকা থেকে ট্রাম্প আসার সময় মোদী আমেদাবাদের বস্তি আড়াল করেছিলেন পাঁচিল তুলে তেমনই কলকাতার যন্ত্রণাকে সুরাহা দেওয়ার বদলে ঢাকা দেওয়ার চেষ্টা রয়েছে। 


কর্মসংস্থানের অভাবই মূল সমস্যা তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু তার সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত ফুটপাতবাসীদের জন্য আশ্রয়স্থল খুবই দরকারি। কলকাতা কর্পোরেশন সূত্রে জানা গেছে, স্বাস্থ্যসম্মত নাইট শেল্টার তৈরি করতে পারলে সমাধান অনেকটা হতে পারে। আরও নাইট শেল্টার তৈরির জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের প্রকল্প থেকে টাকাও পাওয়া যাবে। 
সেটা করা হচ্ছে না কেন? কর্পোরেশনের বক্তব্য, জমি কোথায়? কলকাতা শহরের বুকে জমির অভাব নাইট শেল্টার তৈরির পক্ষে বড় সমস্যা। 
অথচ এই কলকাতা শহরে ট্রাম ডিপোর জমি, পরিবহণ দপ্তরের জমি চলে যাচ্ছে বাণিজ্যিক সংস্থার কবলে। প্রোমোটার সংস্থাগুলি সরকারি অব্যবহৃত জমিগুলি দ্রুত দখল করে নিচ্ছে, সরকার তাতে অনুমোদনও দিচ্ছে, কিন্তু জমি নেই ফুটপাতবাসীদের সমস্যার সমাধানের জন্য। কলকাতা কি এভাবেই তিলোত্তমা হবে?
 

Comments :0

Login to leave a comment