পবিত্র সরকার
ওই আসে ওই আসে, আসে ওই। অযোধ্যাতে শ্রীযুক্ত রামলালার মন্দিরের প্রতিষ্ঠা। কে প্রতিষ্ঠা করবেন? না, ভারতের ছাপ্পান্ন ইঞ্চি বুকের ছাতির প্রধানমন্ত্রী। সংবিধান অনুসারে এ দেশ ধর্মনিরপেক্ষ, এর শাসকেরা কোনও ধর্মের প্রকাশ্য আচরণ বা সমর্থন করতে পারেন না। ‘হিন্দু বৌদ্ধ শিখ জৈন পারসিক মুসলমান খ্রিস্তানি’র মিলিত বাসস্থান এই দেশে শাসকদের নিজেদের ব্যক্তিগত আর পারিবারিক ধর্ম যাই হোক, তাঁদের কোনও ‘সরকারি’ ধর্ম নেই। তবু আমাদের প্রধানমন্ত্রী শ্রীশ্রীনরেন্দ্র মোদীজী তাঁর নিজস্ব তাজমহল, ওই রামমন্দির উদ্বোধন করতে বদ্ধপরিকর।
আপনারা অনেকেই শিবরাম চক্রবর্তীর ‘দেবতার জন্ম’, কিংবা নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘জুতিয়া বাবা’ গল্পদু’টি পড়েছেন। প্রথমটিতে গাছতলায় পাথরে সিঁদুর লাগানো থেকে শুরু হয়েছিল দেবতার জন্ম, দ্বিতীয়টিতে একপাটি ছেঁড়া বুটজুতো কীভাবে দেবতা হয়, আর সেই জুতো-ভেজানো জল চন্নামৃত হিসেবে ভক্তদের (এমনকি জুতোর মালিককেও) খেতে হয়েছিল তা দেখি আমরা। দেশের নানা জায়গায়, শহরের ফুটপাথে নানা মন্দির-মসজিদ বা রিকশো স্ট্যান্ডে শীতলার থান গজিয়ে ওঠে—সেগুলি কারও বা কোনও দলের উপার্জনের জন্য। কিন্তু ইতিহাসের রাম তো ফুটপাথের দেবতা নন, তো এমন ভুঁইফোঁড় দেবতা নন, তিনি বহুদিনকার বনেদি দেবতা। ভারতের হিন্দুদের পাঁচটি প্রধান সম্প্রদায়— শাক্ত, শৈব, বৈষ্ণব, গাণপত্য (গণেশপূজক) আর সৌর (সূর্যপূজক), তাদের মধ্যে শৈব আর সৌররা একটু দুর্বল হয়ে পড়েছে। বৈষ্ণবদেরও আবার দু’টি শাখা—কৃষ্ণপন্থী আর রামপন্থী। দাক্ষিণাত্যে রামায়েত শাখাটি মূলত রামপন্থী। কিন্তু রাম দেবতা হিসেবে সারা ভারতেই পূজিত। মহাত্মা গান্ধী তাঁর প্রিয় রামধুন গানটিতে রামকে ঈশ্বর বলেছেন, আল্লাও বলেছেন। তিনি রামভক্ত ছিলেন, তাই তাঁকে যখন নাথুরাম গডসে হত্যা করে তখন তিনি ‘হে রাম!’ বলে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।
উত্তর ভারতের যে অংশ ‘গোবলয়’ নামে খ্যাত, সেখানে রামভক্তি খুবই গভীর ও বিস্তারিত। অবধি ভাষায় লেখা তুলসীদাসের ‘রামচরিতমানস’ সেখানে প্রতিটি হিন্দুর ঘরে ঘরে পঠিত হয়। যদিও গোরুর সঙ্গে কৃষ্ণের যোগই বেশি, তিনিই গোরু চরাতেন। রামের সঙ্গে গোরুর বিশেষ সম্পর্কের খ্যাতি নেই। রামের জন্মস্থান বলে প্রসিদ্ধ অযোধ্যা শহর অনেকদিন থেকেই তীর্থস্থানের মহিমা পেয়ে এসেছে।
কোটি কোটি মানুষ রামের ভক্ত, তাতে কারও কোনও অসুবিধে নেই। অসুবিধে হলো বর্তমান শাসকদের হাতে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারে। বর্তমান শাসকদলই বা বলছি কেন? গত শতাব্দীর আশির বছরগুলিতে কংগ্রেস আমল থেকে এটা শুরু হয়েছে। শোনা যায়, রাজীব গান্ধীর সময়ে অযোধ্যারই প্রাচীন বাবরি (বাবরের স্থাপিত) মসজিদে একটি রামের মূর্তি স্থাপন করে হয়েছিল, এবং তার পুজো করা শুরু হয়েছিল। এই অনৈতিহাসিক কথা তার আগে থেকেই চাউর করা হচ্ছিল যে, রামের (অচিহ্নিত) জন্মস্থানের উপরে নাকি ওই মসজিদ খাড়া করা হয়েছিল। ফলে ওই ঐতিহাসিক মসজিদটি হয়ে উঠেছিল ইতিহাসজ্ঞানহীন আর কুসংস্কারাচ্ছন্ন হিন্দুদের চক্ষুশূল, আর শাসকেরও হিন্দুভোটের প্রত্যাশয় এই সাম্প্রদায়িক ধারণায় ইন্ধন জোগাতে তৎপর ছিল। শেষে বিজেপি-আরএসএস আর বিশ্ব হিন্দু পরিষদের কর সেবকদের হাতে যখন ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংস হলো তখন নরসিংহ রাওয়ের কংগ্রেসী সরকার হাত গুটিয়ে বসে রইল, কারণ হিন্দুদের ভোট ব্যাঙ্কের লোভ তারও ছিল। তার পরে, ওই ‘সাফল্যে’র অনুসরণে দশবছর পরে গুজরাটে বীভৎস দাঙ্গা ঘটানো হলো, যার ক্ষত এখনও মুছেছে কি না সন্দেহ।
এখনকার রামমন্দির সেই একই ‘সাফল্যে’র অনুবৃত্তি বলা যায়। এখনকার শাসকেরা তাদের ‘হিন্দি, হিন্দু, হিন্দুস্তান’ এই সমীকরণ কিছুতেই ভুলতে পারেন না, তাঁরা এখনও ভারতের সংখ্যাগুরু ভোটার হিন্দু—এই আশ্বাসে আশকারা পান, এবং অন্য ধর্মসম্প্রদায়গুলিকে হয় ভারতে অবাঞ্ছিত বলে মনে করেন (বিজেপি’র সমর্থকেরা বড় সংখ্যালঘু গোষ্ঠী মুসলমানদের প্রায়ই ‘বাংলাদেশে বা পাকিস্তানে চলে যাও’ বলে হুমকি দেন), না হয় তাদের পায়ের তলায় থাকতে হবে এ রকম ফরমান জারি করেন। হিন্দু-মুসলমানে বিবাহ, এমনকি বন্ধুত্ব তাঁদের দু’ চক্ষের বিষ, গোমাংস, এমনকি যে কোনও মাংস বা মাছকেও তারা খাদ্য হিসেবে সহ্য করতে রাজি নয়। গোমাংস মনে করে মাংস বয়ে নিয়ে যাওয়া মুসলমানদের তারা হত্যা করতেও পিছপা হয়নি।
রামমন্দির তাই এখন শুধু একটা দেবালয় নয়, হিংস্র ও আক্রমণাত্মক হিন্দুত্বের একটি প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাবরি মসজিদ ধ্বংস আর গুজরাতের দাঙ্গার সঙ্গে তা উদ্দেশ্যের সূত্রে যুক্ত। তাই ভারতের গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষের এই মুহূর্তে অতিশয় সতর্ক আর প্রস্তুত থাকতে হবে, যেন মন্দির প্রতিষ্ঠা নতুন করে কোনও দাঙ্গার প্ররোচনা না হয়ে ওঠে। এখনকার কেন্দ্রীয় শাসকেরা যে গুজরাটের দাঙ্গাকে প্রত্যক্ষ আর পরোক্ষভাবে মদত দিয়েছিলেন তা নথিবদ্ধ সত্য। কাজেই তাঁদের রামমন্দির প্রতিষ্ঠার পিছনে বিশুদ্ধ ভক্তি কাজ করছে, আমাদের মতো অবিশ্বাসীদের অবিশ্বাস তাতে দুর্বল হয় না।
সাধু সাবধান! দেশের সচেতন নাগরিকেরা প্রস্তুত থাকুন, এই ঘটনা যেন কোনওভাবে আমাদের সাম্প্রদায়িক সংহতিকে নষ্ট না করতে পারে।
RAM MANDIR PABITRA SARKAR
রঘুপতি-রাঘব
×
Comments :0