জাতীয় সুরক্ষার নামে ঘৃণার চাষ করে বিজেপি দেশবাসীর কাউকেই সুরক্ষা দিতে পারবে না। শুক্রবার রানিগঞ্জে প্রবীণ কমিউনিস্ট নেতা কমরেড বিবেক চৌধুরির স্মরণসভায় একথা বলেছেন সিপিআই(এম)’র রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। বিজেপি এবং তৃণমূল যেভাবে ধর্ম, জাতি, ভাষার নামে মানুষে মানুষে বিভাজন তৈরি করছে তার বিপদ সম্পর্কে সচেতন করতে সেলিম বলেছেন, ওদের লুটের রাজনীতিতে মানুষের জীবনজীবিকা বিপন্ন। সেগুলি আড়াল করতে জাতীয় সুরক্ষার নাম করে দেশবাসীর এক অংশকে আরেক অংশের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তোলার চেষ্টা হচ্ছে।
সেলিম বলেন, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো সুরক্ষিত না হলে, রাজ্যগুলি সুরক্ষিত না হলে জাতীয় সুরক্ষা কীভাবে হবে? ঘৃণা বিদ্বেষ ছড়িয়ে জাতিতে জাতিতে ধর্মে ধর্মে মারামারি হলে কীসের সুরক্ষা? ঘৃণার চাষ করে মণিপুরের মতো একদল মানুষকে আরেক দলের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দিলে কে সুরক্ষিত থাকবে? জাতীয় সুরক্ষার নামে এভাবে কেবল বিপদকেই ডেকে আনা হচ্ছে। কে কী পোশাক পরে, কী খায়, কী ভাষায় কথা বলে, এই বৈচিত্রকে দেখিয়ে ‘ওরা আমাদের মতো নয়’ বলে প্রচার করা হচ্ছে। ভয় ভীতি জাগানো হচ্ছে বিভাজন সৃষ্টি করতে। এরাজ্যে তৃণমূলও তাই করছে, বিধায়কদের কে তৃণমূলে কে বিজেপি’তে তার ঠিক নেই, ওরা হিন্দু মুসলিম, বাঙালি- বিহারি ফারাক চেনাচ্ছে। অথচ ভারতের বৈচিত্রই ভারতের শক্তি।
কমরেড বিবেক চৌধুরির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সেলিম বলেন, বিবেক চৌধুরি শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলনের নেতা ছিলেন, তিনি শ্রমিকের মুক্তির চেতনা দিয়ে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে সচেষ্ট ছিলেন। মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার সমাজ ভাবনায় তিনি কাজ করেছেন। সমাজকে বদলের জন্য আজীবন লড়াই করেছেন। তাঁকে শ্রদ্ধায় স্মরণ করতে হলে আজকেও বিভাজনের রাজনীতির বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই করতে হবে। কোভিড মহামারীর সময় থেকে মানুষকে পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন ও অসহায় করে তোলা হচ্ছে। এই বিচ্ছিন্নতার প্রবাহিত স্রোতের বিরুদ্ধে কমিউনিস্টদের কাজ হলো সমস্ত অংশের মানুষের মধ্যে সেতু তৈরি করা। তার জন্য সমস্ত মজদুরকে ঐক্যবদ্ধ করার সেনানী কমরেড বিবেক চৌধুরিকে স্মরণে রাখতে হবে।
এদিন রানিগঞ্জের গির্জাপাড়া বার্নস রিফ্রাক্ট্রি অ্যা ন্ড সিরামিক ইউনিয়ন অফিস প্রাঙ্গণে সিপিআই(এম)’র পশ্চিম বর্ধমান জেলা কমিটি এই স্মরণসভার আয়োজন করে। কমরেড বিবেক চৌধুরির প্রতিকৃতিতে মাল্যদান করে স্মরণ অনুষ্ঠানের সূচনা হয়। শোকপ্রস্তাব পাঠ করেন পার্টির রাজ্য কমিটির সদস্য পার্থ মুখার্জি। দেশের কয়লা শ্রমিক সংগঠনের নেতা বিবেক চৌধুরি গত ৩১ অক্টোবর রানিগঞ্জে প্রয়াত হন। তিনি ১৯৮৩ সালে রানিগঞ্জে এসে শ্রমিক সংগঠনের কাজ শুরু করেন। জীবনযাপন ও আচার আচরণে কয়লাঞ্চলের মানুষের আপনজন হয়ে উঠেছিলেন তিনি। তাই স্মরণসভাতেও ছিল উপচে পড়া ভিড়।
সভায় দুর্নীতি ও লুটের রাজত্ব চালানোর জন্য মোদী সরকার এবং তৃণমূল সরকার উভয়কেই দায়ী করে বলেছেন, আরএসএসের নেতৃত্বে বিজেপি যেভাবে নিয়োগ দুর্নীতিতে মধ্য প্রদেশে প্রথম ব্যাপম কেলেঙ্কারি করে, পশ্চিমবঙ্গে মমতা ব্যানার্জি সরকারও সেভাবেই দুর্নীতিকে ব্যাপক করে তুলেছে। খনি, জল, জমি, জঙ্গল, পাহাড় লুট করার লক্ষ্য নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে লুট দুর্নীতির ফ্র্যাঞ্চাইজি দেওয়ার রাজনীতি প্রয়োগ হচ্ছে। মমতা ব্যানার্জির ছবি, সাইনবোর্ড ব্যবহার করে গড়ে তোলা ফ্র্যাঞ্চাইজি, তার প্রচার হচ্ছে বিজ্ঞাপন, টিভি, সংবাদপত্র, সোসাল মিডিয়াতে। সব কিছু হচ্ছে ২৫-৭৫ ভাগ নিশ্চিত করে। সারা দেশ জুড়ে মোদীর লুট, এরাজ্যে দিদির লুট সমান তালে চলছে। মোদী বলেছিলেন, বছরে দু’কোটি বেকারের চাকরি দেবে। এখন কলকারখানা, রেল, খনি কর্পোরেটদের হাতে বিক্রি করে দিচ্ছে। কালো টাকা উদ্ধার তো পরের কথা, নোটবন্দির আগে যত টাকা ছিল তার চেয়ে বেশি টাকা এখন বাজারে রয়েছে। সাধারণ মানুষ একটা ঘর বানাতে পারছেন না, আর বিজেপি –তৃণমূল নেতারা টাকা রাখার জন্য ঘর বানাচ্ছে।
তিনি বলেন, এসবের আড়াল করতে ধর্মীয় বিদ্বেষ ও বিভাজনের প্রচার হচ্ছে। এখন প্রচার করছে দেশে নাকি স্বর্গরাজ্য হয়েছে। তাই গীতাপাঠের আসর বসাচ্ছে। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই জরুরি ছিল বলেই স্বামী বিবেকানন্দ যুবশক্তিকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, গীতাপাঠের চেয়ে ফুটবল খেলা ভালো। আর আজকে জরুরি বিষয়কে আড়াল করতে ধর্মকে টেনে এনে রাজনীতির সাথে যুক্ত করা হচ্ছে। কোটি কোটি মানুষ নিজের ধর্ম বিশ্বাস নিয়ে বরাবর থেকেছেন, সমস্যা হয়নি। কিন্তু ধর্মকে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত করা হলে সেটা আর ধর্ম থাকে না।
সভায় কমরেড বিবেক চৌধুরির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এদিন বক্তব্য রাখেন পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আভাস রায়চৌধুরি, রাজ্য কমিটির সদস্য অচিন্ত মল্লিক, পশ্চিম বর্ধমান জেলা কমিটির সম্পাদক গৌরাঙ্গ চ্যাটার্জি, জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য বংশগোপাল চৌধুরি। সভা পরিচালনা করেন পার্থ মুখার্জি। সভায় পার্টির রাজ্য কমিটির সদস্য দেবাশিস চক্রবর্তী এবং জাহানারা খান উপস্থিত ছিলেন। স্মরণসভায় গণশক্তি পত্রিকার তহবিলের জন্য পাঁচ হাজার টাকার চেক মহম্মদ সেলিমের হাতে তুলে দেন কিংশুক মুখার্জি।
Comments :0