Bhangor documents burnt

ভাঙড়ে নথি পোড়ানোর জমির পাশেই মুখ্যমন্ত্রীর ভাইয়ের জমি

জেলা

রবিবার রাত থেকে নথি পোড়ানোর আয়োজন চলে ভাঙড়-১ নম্বর ব্লকের তাড়দহ গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার আন্দুলগাড়ি মৌজায়। মঙ্গলবার সকালে তা জানতে পেরে ঘটনাস্থলে যায় সিবিআই। দু’দিন ধরে পুড়তে থাকা নথির মধ্য থেকে শেষপর্যন্ত কিছু কাগজ, ফাইল, চেকবই, পাসবুক, সরকারি নথি উদ্ধার করে সিবিআই।
শহর থেকে কিছু দূরে প্রায় জনবিহীন একটি এলাকায় পাঁচিল দেওয়া ফাঁকা জমিতে কী নথি পোড়ানো হলো, কোন তথ্য লোপাট করতে এই বহ্নুৎসব চলল তা নিয়ে রাজনৈতিক মহলেও প্রবল চাঞ্চল্য। 
তারই মধ্যে এবার সামনে এল আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য। ফের সামনে এল মুখ্যমন্ত্রীর পরিবার!
ক্যানিং পূর্ব বিধানসভার মধ্যেই পড়ে ভাঙড়-১ নম্বর ব্লকের এই আন্দুলগাড়ি মৌজা। এলাকার বিধায়ক অভিষেক ব্যানার্জির ঘনিষ্ঠ শওকত মোল্লা। 
সরকারি তথ্য বলছে এই তাড়দহ গ্রাম পঞ্চায়েতের এই আন্দুলগাড়ি মৌজাতেই জমি রয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর ভাই কার্তিক ব্যানার্জির নামে! যেখানে নথি পোড়ানো হয়েছে সেখানেই দু’বছর আগে ১০ কাঠা ২ ছটাক ২.৫ বর্গফুট জমি কিনেছেন মুখ্যমন্ত্রীর ভাই সমীর ব্যানার্জি ওরফে কার্তিক ব্যানার্জি।
বুধবার দুপুরেই নবান্নে বসে কার্যত দলনেত্রীর সুরেই মুখ্যমন্ত্রী সাংবাদিক বৈঠকে ভাঙড়ে নথি পোড়ানোর ঘটনার প্রসঙ্গে বলেছেন— ‘ আমার কাছে এ ব্যাপারে কোনও তথ্য নেই। আমি শুনিনি বিষয়টি নিয়ে। এ সব বিজেপি, সিপিএম, আইএসএফ’র নতুন চক্রান্ত হতে পারে। সিবিআই সেখানে গিয়েছিল। নথি সংগ্রহ করেছে’। মুখ্যমন্ত্রীর কাছে ‘তথ্য’ না থাকলেও সিপিআই(এম), আইএসএফ, বিজেপি’র চক্রান্ত বলে জানতে পেরেছেন মুখ্যমন্ত্রী!
কিন্তু কলকাতা পুলিশের অন্তর্গত কেএলসি থানা এলাকার আন্দুলগাড়ি গ্রাম বলছে অন্য কথা। সন্ত্রাস কবলিত এলাকা। গায়ের জোরে পঞ্চায়েতও তৃণমূলের দখলে। বিরোধী দলের প্রকাশ্য মিটিং, মিছিল করারও ‘অধিকার’ নেই এই তল্লাটে। একচ্ছত্র দখলদারির সেই তল্লাটেই কেএলএসি থানা থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে তিনদিন ধরে গাড়ি করে নথি এল, তা পোড়ানো হলো অথচ তৃণমূলের পঞ্চায়েত থেকে পুলিশ প্রশাসন কেউ তা জানতে পারল না? নাকি সব জেনেই মুখ্যমন্ত্রী বিভ্রান্তি বাড়াতেই এমন দাবি করলেন? দ্বিতীয় সম্ভাবনাটাই যে বেশি তা এদিন সকালে ঘটনাস্থলে গিয়েও স্পষ্ট হলো গ্রামবাসীদের কথায়। 
সিবিআই যখন মঙ্গলবার দুপুর বারোটা নাগাদ খবর পেয়ে কেএলসি থানা এলাকার এই আন্দুলগাড়িতে পৌঁছায় তখন চারিদিকে পাঁচিল দিয়ে ঘেরা ঐ জমিতে ঢুকতে প্রাথমিক ভাবে বাধাও পায়। গেটে ছিলেন নিরাপত্তারক্ষীরা। তাঁদের কাছ থেকেই জানা যায় এই তল্লাটে এরকম একাধিক বড় বড় জমির প্লট পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। তৃণমূল নেতা ও পঞ্চায়েত উপপ্রধান রাকেশ রায়চৌধুরি এবং গৌতম মণ্ডলের অধিকাংশ জমি। তাদের মাধ্যমেই হাত বদল হয়। গৌতম মণ্ডলকে এলাকার লোকজন শওকত মোল্লার ঘনিষ্ঠ তৃণমূল নেতার পাশাপাশি জমির কারবারি হিসাবেই চেনেন। সিবিআই তলব করলেও গৌতম মণ্ডল মঙ্গলবার ঘটনাস্থলে এসে দেখা করেননি গোয়েন্দা আধিকারিকদের সঙ্গে। রাকেশ সিং যদিও দেখা করেন, সিবিআই আধিকারিকদের কাছে জানান, ‘এই জমিটির মালিক আমি নই, শুনেছি ১১’র সময় ক্যাপ্টেন তিওয়ারি বলে একজন জমিটি কেনেন, পরে তা আবার রাজেশ সিংহকে বেচে দেন।’
তবে এলাকার বাসিন্দাদের দাবি রামসার সাইটের অন্তর্গত এসব জলাভূমি এলাকা বুজিয়ে তা দেদার বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে। গৌতম মণ্ডলও রয়েছে জমির কারবারে।
আর সরকারি তথ্য বলছে ২০২১ সালের জুলাই মাসে, অর্থাৎ তৃণমূল তৃতীয়বারের জন্য সরকারে আসার পরেই মুখ্যমন্ত্রীর ভাই কার্তিক ব্যানার্জি এই আন্দুলগাড়ি মৌজায় জমি কেনেন। যদিও ২০২১ সালের ডিসেম্বর কলকাতা কর্পোরেশন ভোটের সময় কার্তিক ব্যানার্জির স্ত্রীর হলফনামায় তাঁর স্বামীর সম্পত্তির হিসাব দেওয়া হলেও ভাঙড়ের তাড়দহ পঞ্চায়েতের এই জমির উল্লেখ নেই! স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে তথ্য গোপনেরই চেষ্টা হলফনামায়।
ভূমি ও ভূমি রাজস্ব দপ্তরের তথ্য বলছে ভাঙড়ে নথি পোড়ানোকাণ্ডে নাম জড়ানো সেই তৃণমূল নেতা গৌতম মণ্ডলের মাধ্যমেই জমি কেনাবেচা হয়েছে। কার্তিক ব্যানার্জি এই জমির রেজিস্ট্রি করেছেন ২০২১ সালের ৩০ জুলাই। কিন্তু ডিসেম্বরে স্ত্রী কর্পোরেশন ভোটে তৃণমূলের প্রার্থী হওয়ার পরে হলফনামায় তার উল্লেখ নেই। দেখা যাচ্ছে গৌতম মণ্ডলের মাধ্যমে ছয়জন (প্রত্যেকেই রাজারহাটের বাসিন্দা) একযোগে জমিটি বিক্রি করেছেন সমীর ব্যানার্জি ওরফে কার্তিক ব্যানার্জিকে। গৌতম মণ্ডল এখানে অ্যাটর্নি সেলার। বাইয়ার হলেন কার্তিক ব্যানার্জি। ঐ প্লটের নম্বর- ০০৭৩৫, খতিয়ান নম্বর- ০০৪২২। ঐ একই প্লট, খতিয়ান নম্বরের জমিও ঐ একই ছয়জন গৌতম মণ্ডলের মাধ্যমে (অ্যাটর্নি-সেলার) ৭ বিঘা জমি বিক্রি করেন জনৈক কৌশল কুমার সিংয়ের সংস্থা সেন্টি ডেভেলপার্স প্রাইভেট লিমিটেডকে। ঐ জনৈক সিং আবার ১৪টি কোম্পানির ডিরেক্টর!
কলকাতায় ঝটিকা তল্লাশিতে বালিগঞ্জে একটি রিয়েল এস্টেট সংস্থার অফিস থেকে প্রায় ১ কোটি ৪০ লক্ষ কালো টাকা উদ্ধারের ঘটনার পরে ইডি সংবাদমাধ্যমে বিবৃতি দিয়ে জানায় এক অতি প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তি (‘হাইলি ইনফ্লুয়েন্সিয়াল পলিটিক্যাল পার্সন’) তাঁর ঘনিষ্ঠ মনজিৎ সিং গ্রেওয়াল ওরফে জিট্টি ভাইয়ের মাধ্যমে কয়লা পাচারের টাকা নয়ছয় (লন্ডারিং) করার চেষ্টা চালাচ্ছে! মানি লন্ডারিংয়ে অভিযুক্ত সেই জিট্টি ভাইয়ের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর ভাই কার্তিক ব্যানার্জির স্ত্রী তৃণমূলী কাউন্সিলর কাজরী ব্যানার্জির দু’টি যৌথ সম্পত্তির হদিশ সামনে এসেছে। এছাড়াও হরিশ মুখার্জি রোডে কাজরী ব্যানার্জি ও জিট্টি ভাইয়ের স্ত্রী দলজিৎ কাউরেরও যৌথ সম্পত্তি রয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর বিধানসভা কেন্দ্রে কয়লা পাচারকাণ্ডে মানি লন্ডারিংয়ে অভিযুক্ত ব্যক্তির সঙ্গেই একের পর এক যৌথ সম্পত্তি মুখ্যমন্ত্রীর পরিবারের সদস্যদের।
আবার নিয়োগকাণ্ডেই ধৃত তৃণমূলী বিধায়ক জীবনকৃষ্ণ সাহা বোলপুরে রূপপুর পঞ্চায়েতের যে মৌজায় জমি কিনেছিলেন ঠিক সেই তালগোড় মৌজাতেই জমি রয়েছে সেই কাজরী ব্যানার্জির।
আবার যেখানে রাতের অন্ধকারে আগুনে নথি পোড়ানো হলো ভাঙড়ে সেই আন্দুলগাড়ি মৌজাতেই মিলল মুখ্যমন্ত্রীর ভাইয়ের নামে জমি!
সবই কী ‘কাকতলীয়’?
 

Comments :0

Login to leave a comment