EDITORIAL

বৃদ্ধির মাকাল ফল

সম্পাদকীয় বিভাগ

রাজ্যসভায় দে‍‌শের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার সময় বিরোধীদের সমালোচনার জবাব দিতে গিয়ে শাসকদলের পক্ষ থেকে জোর গলায় বলার চেষ্টা হয়েছে, যদি মোদী সরকার অর্থনীতির অগ্রগতি না ঘটিয়ে থাকে তাহলে রাজ্যে রাজ্যে মানুষ বিজেপি’কে জেতাচ্ছেন কেন? কেউ কেউ আবার আ‌ইএমএফ’র কিছু তথ্য এবং বিদেশি মূল্যায়ন সংস্থার ভাষ্য হাজির করে বলতে চেয়েছেন দেশের অর্থনীতি চরচর করে উন্নত হচ্ছে। এর প‍‌ক্ষে আরও জোরালো তথ্য হিসেবে হাজির করা হয়েছে চলতি অর্থবর্ষের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিক জিডিপি বৃদ্ধির হার ৭.৬ শতাংশকে। তাৎপর্যপূর্ণভাবে বিরোধীরা যে গুরুতর বিষ‌য়গুলি উত্থাপন করে জোরালো প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন তার স্পষ্ট কোনও জবাব সরকার পক্ষের থেকে মে‍‌লেনি। অবশ্য সেইসব প্রশ্নের জবাব দেবার উপায়ও তাদের নেই।
যেমন, যদি প্রশ্ন ওঠে অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে সরকার ব্যর্থ কেন? গত ৯ বছরে চালের দাম ৫৬ শতাংশ, গম ৫৯ শতাংশ, দুধ ৬১ শতাংশ, ডাল ১২০ শতাংশ বেড়েছে। এমন বর্ধিত মূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কেনার সামর্থ্য থাকে রুজি-রোজগার বেশি হলে। কিন্তু তথ্য বলছে কর্মসংস্থানের শোচনীয় অবস্থা এবং মজুরির হারও নিতান্তই কম। সরকারি সমীক্ষা রিপোর্ট অনুযায়ী মোট জনসংখ্যার ৪৬ শতাংশ কর্মপোযোগী। এদের অর্ধেক কার্য ক্ষেত্রে কাজ করছে। অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার এক চতুর্থাংশও কর্মে নিযুক্ত নয়। জনসংখ্যার বিপুল অংশের শ্রম উৎপাদনের কাজে ব্যবহার হয় না। ন্যূনতম সংখ্যক মানুষের কষ্টার্জিত সীমিত আয়ের উপর নির্ভরশীল বিপুল মানুষ। গত ৯ বছরে এই অবস্থার বিশেষ হেরফের হচ্ছে না।


মানুষের কাজ না থাকায় এবং মূল্যবৃদ্ধি তথা জীবনযাপনের ব্যয়‌ বে‍‌ড়ে যাওয়ায় পারিবারিক সঞ্চয় উদ্বেগজনকভাবে কমে গেছে। মোদী জমানায় পারিবারিক সঞ্চ‌য় গত ৫০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। একই কারণে কমেছে ক্রয় ক্ষমতা। বাধ্য হয়ে ঋণ বেড়েছে আর বাড়ছে ঋণ শোধের ক্ষমতা। বিশ্বের সব থেকে বেশি গরিব মানুষের সংখ্যা ভারতে। তেমনি অপুষ্টির শিকার শিশুও সর্বাধিক ভারতে। বিজেপি দাবি করেছে তারা দেশের ৮০ কোটি মানুষকে বিনামূল্যে খাদ্য বিতরণ করছে। কিন্তু এই প্রশ্ন কৌশলে এড়িয়ে গেছে কেন প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষকে বিনামূল্যে খাদ্য দিতে হচ্ছে। অর্থনীতির যদি সত্যিসত্যি অগ্রগতি ঘটে থাকে এবং যদি পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান তৈরি হয়ে থাকে, বেকারি কমে গিয়ে থাকে, মানুষের আয় বেড়ে থাকে তাহলে এত মানুষকে বিনামূল্যে খাদ্য বিতরণ করতে হচ্ছে কেন?
বিজেপি দাবি করছে তাদের আমলে ভারত বিশ্বের দশম অর্থনীতি থেকে পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি হয়েছে। কিন্তু এড়িয়ে যাচ্ছে অর্থনীতির আয়তনটা ঠিক কতটা বেড়েছে সেটা। মনে রাখা দরকার ১০০-র মধ্যে ৭০ পেয়ে কেউ প্রথম হয় আবার ৯৯ পেয়েও কেউ প্রথম হয়। প্রথম হওয়াটা বড় কথা নয়, নম্বরটা বড়। তেমনি দশম না পঞ্চম সেটা অর্থহীন, আসল অর্থনীতির আয়তন। তেমনি বৃদ্ধি হার ৬ না ৭ শতাংশ সেই বিতর্কের থেকে বেশি জরুরি মাথাপিছু জিডিপি। এক্ষেত্রে জি-২০’র মধ্যে ভারত সকলের শেষে। সামাজিক সূচকে ভারত প্রতিবেশী দেশগুলির পেছনে। আর্থিক বৈষম্যের দিক থেকে বাংলাদেশ, নেপাল থেকে খারাপ অবস্থায় ভারত। বৃদ্ধির হার দিয়ে মানুষের অগ্রগতি হয় না। জিডিপি’র বণ্টন দিয়ে অগ্রগতি বোঝা যায়। মোদী জমানায় বণ্টন উপরমুখী। উপরের এক শতাংশ জিডিপি’র অর্ধেকের বেশি হস্তগত করে। নিচের ৫০ শতাংশের হাতে কিছুই আসে না। তাই তাদের বিনামূল্যে খাদ্য, দান-খয়রাতি করে ভোট কেনা ছাড়া উপায় কি?

Comments :0

Login to leave a comment