Olympics 2024

ফসকে যাওয়া পদক

ফিচার পাতা

সুমিত গাঙ্গুলি 

ক্রীড়াজগতে প্রায়শই বলা হয় যে অলিম্পিকে চতুর্থ স্থান অর্জন করা চরম যন্ত্রণার একটি বিষয়। এমনকি প্রতিযোগিতার শেষ ব্যক্তিও বলতে পারেন যে তিনি কেবল অংশগ্রহণ করতে গিয়েছিলাম, কিন্তু চতুর্থ হওয়া যেন কাছাকাছি এসেও হলো না। হয় এই ঘটনা ক্রীড়াবিদের কেরিয়ার শেষ করে দেয় বা ভবিষ্যতের উন্নতির দিকে নিয়ে যায়। 
খেলাধুলার সর্বশ্রেষ্ঠ মঞ্চে এই ঐতিহ্য ঘটনাচক্রে ভারতের সঙ্গে ১৯৫৬ সালে শুরু হয়েছিল। একবার সেই ঘটনাগুলোয় নজর করা যাক। 
১৯৫৬, মেলবোর্ন
ভারতীয় ফুটবল দল কোয়ার্টার ফাইনালে অয়োজক অস্ট্রেলিয়াকে ৪-২ গোলে পরাজিত করে সেমিফাইনালে উঠেছিল, এশিয়ার প্রথম ফুটবলার হিসেবে নেভিল ডি'সুজা অলিম্পিক গেমসে হ্যাটট্রিক করার কৃতিত্ব অর্জন করেন। এরপর শেষ চারে যুগোস্লাভিয়ার মুখোমুখি হয় ভারত। ৫২ মিনিটের মাথায় নেভিল ডি'সুজার গোলে এগিয়ে গেলেও ৫৪, ৫৭, ৬৫ ও ৭৮ মিনিটের মাথাব গোল হজম করে বিদায় নেয়। ব্রোঞ্জ পদকের ম্যাচে, ভারত বুলগেরিয়ার কাছে ০-৩-এ হেরে যায়। জীবনের শেষ পর্যন্ত পিকে ব্যানার্জি এই কথা মনে করে হতাশা ব্যক্ত করেছেন।
১৯৬০, রোম
কিংবদন্তি মিলখা সিং সেবার শুরু করেছিলেন ৪০০ মিটার দৌড়ে ৪৭.৬০ সেকেন্ডে। দ্বিতীয় রাউন্ডে তিনি সময় করেন ৪৬.৫ সেকেন্ড। সেমি ফাইনালে ৪৫.৯, আর ফাইনালে ৪৫.৬ সেকেন্ড। সবাই ধরেই ফেলেন যে তিনি পদক পাবেন। যদিও মিলখা সিং ওটিস ডেভিস ছাড়া অন্য সমস্ত  প্রতিযোগীকে পরাজিত করেছিলেন এবং তার ভালো ফর্মের কারণে একটি পদক প্রত্যাশিত ছিল। যাই হোক, তিনি ২৫০ মিটার অবধি দৌড়ে এগিয়ে থেকেও শেষ পর্যন্ত চতুর্থ হন। দেশভাগের পর বাবা-মাকে হারানোর পর এই ঘটনা ছিল তাঁর জীবনের সবথেকে খারাপ স্মৃতি। 
১৯৮০, মস্কো
নেদারল্যান্ডস, অস্ট্রেলিয়া এবং গ্রেট ব্রিটেনের মতো শীর্ষ হকি দেশগুলি সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরোধিতা করে মস্কো গেমস বয়কট করার সঙ্গে সঙ্গে, ভারতীয় মহিলা হকি দলের প্রথম প্রচেষ্টাতেই পদক জেতার দুর্দান্ত সুযোগ ছিল। প্রথমে অস্ট্রিয়াকে ২-০ গোলে তারপর পোল্যান্ডকে ৪-০ গোলে জিতে ভারত হেরে যায় চেকোস্লোভাকিয়ার বিরুদ্ধে। জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে ১-১ গোলে ড্র শেষে সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে ১-৩ গোলে হেরে চতুর্থ হয় মেয়েরা।

১৯৮৪, লস এঞ্জেলেস
লস অ্যাঞ্জেলেস অলিম্পিকে ঠিক সেই ঘটনা ঘটে পি টি ঊষার সঙ্গে, যা রোমে ঘটেছিল মিলখা সিংয়ের সঙ্গে। ৪০০ মিটার হার্ডলসে ঊষা হিটে ৫৬.৮১ সেকেন্ড সময় করেন। সেমি ফাইনালে ৫৫.৯৪। ফাইনালে ৫৫.৪২ করলেও চতুর্থ হন। রোমানিয়া ক্রিশ্চিয়েনা ব্রোঞ্জ পেয়েছিলেন ৫৫.৪১ সেকেন্ড সময়। 
২০০৪, এথেন্স
২০ বছরের দীর্ঘ ব্যবধানের পর, আবার চতুর্থ স্থান এল ভারতীয় দলে। লিয়েন্ডার পেস এবং মহেশ ভূপতির বিখ্যাত জুটি এথেন্স গেমসে পোডিয়াম থেকে বাদ পড়েন।
তর্কাতীতভাবে টেনিসে ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ দ্বৈত জুটি, পেস এবং ভূপতি একটি ম্যারাথন ম্যাচে ক্রোয়েশিয়ার মারিও অ্যানসিক এবং ইভান লুবিসিকের কাছে ৬-৭, ৬-৪, ১৪-১৬-এ হেরে চতুর্থ স্থান পাওয়ার ফলে ব্রোঞ্জ পদক থেকে বঞ্চিত হন। তার আগে, ভারতীয় জুটি ফেভারিট হিসাবে সেমিফাইনালে গিয়েছিল কিন্তু নিকোলাস কিফার এবং রেনার শুটলারের জার্মান জুটির কাছে অবিশ্বাস্য ভাবে ২-৬,৩-৬ স্ট্রেট সেটে হেরে যায়।
একই গেমসে, কুঞ্জরানি দেবী মহিলাদের ৪৮ কেজি ভারোত্তোলন প্রতিযোগিতায় চতুর্থ স্থান অর্জন করেছিলেন, কিন্তু তিনি পদকের প্রতিযোগিতায় ছিলেন না।
ক্লিন অ্যান্ড জার্ক বিভাগে ১১২.৫ কেজি তোলার চূড়ান্ত প্রচেষ্টায় ব্যর্থ, কুঞ্জরানি ১৯০ কেজির মোট প্রচেষ্টায় শেষ করলেও, ব্রোঞ্জ-পদকজয়ী থাইল্যান্ডের আরি উইরাথাওর্নের থেকে ১০ কেজি কম তোলেন। 
২০১২, লন্ডন
শ্যুটার জয়দীপ কর্মকার এই লন্ডন অলিম্পিক গেমসে ব্রোঞ্জ পদক হারান। আবার সেই চতুর্থ স্থানের ধাক্কা। জয়দীপ পুরুষদের ৫০ মিটার রাইফেল প্রোন ইভেন্টের কোয়ালিফিকেশন রাউন্ডে সপ্তম স্থানে ছিলেন এবং ফাইনালে তিনি ব্রোঞ্জ পদক বিজয়ীর থেকে মাত্র ১.৯ পয়েন্ট পিছিয়ে ছিলেন।
২০১৬, রিও ডি জেনিরো
জিমন্যাস্ট দীপা কর্মকার গেমসে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা প্রথম ভারতীয় মহিলা জিমন্যাস্ট হন। মহিলাদের ভল্ট ইভেন্টের ফাইনালে খেলার পর, তিনি ১৫.৬৬ স্কোর নিয়ে সার্বিকভাবে চতুর্থ স্থান অর্জন করেন এবং ০.১৫০ পয়েন্টে ব্রোঞ্জ পদক মিস করেন। ভারত থেকেও যে জিমন্যাস্ট হওয়া যায় সেই বার্তা তিনিই দিয়েছেন। 
এই সেই গেমস, যেখানে অভিনব বিন্দ্রার বর্ণাঢ্য কেরিয়ার রূপকথার সমাপ্তির দিকে রওনা হয়েছিল। যদিও তাঁর মানের একজন শুটারও অলিম্পিক গেমসের চতুর্থ স্থান পাওয়ার ধাক্কা থেকে রেহাই পায়নি। তিনি তার ঐতিহাসিক স্বর্ণপদকের আট বছর পর, সামান্য কারণে ব্রোঞ্জ পদক হারান ।  

২০২০, টোকিও
১৯৮০ সালের মস্কো গেমসের চার দশকেরও বেশি সময় পরে, ভারতীয় মহিলা হকি দলের সদস্যরা আবারও টোকিও অলিম্পিকে একই রকম যন্ত্রণা সহ্য করে, ব্রোঞ্জ থেকে বঞ্চিত হয়। গ্রুপ পর্বে নেদারল্যান্ডসের কাছে ১-৫ গোলে প্রথম ম্যাচে হেরে যায়। দ্বিতীয় ম্যাচে হারে জার্মানির কাছে ০-২ গোলে। এরপর গ্রেট ব্রিটেনের কাছে ১-৪ গোলে হেরে যখন বিদায় নিশ্চিৎ তখন আয়ারল্যান্ডকে ১-০ গোলে ও দক্ষিণ আফ্রিকাকে ৪-৩ গোলে হারিয়ে ভারত গ্রুপ পর্বে চতুর্থ হয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে ভারতীয় দল ক্ষমতার বাইরে গিয়ে একপ্রকার অবিশ্বাস্যভাবে তিন বারের অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়াকে ১-০ গোলে হারিয়ে দেয়। সেমিফাইনালে আর্জেন্টিনার কাছে ০-১ গোলে পরাজিত হলেও ব্রোঞ্জের সুযোগ ছিল। রানি রামপালের নেতৃত্বে ব্রিটেনের বিপক্ষে ৩-২ ব্যবধানে এগিয়ে থাকায় মনে হচ্ছিল এবার পদক আসবে, কিন্তু ব্রিটেন দু’বার গোল করে ৪-৩ এ এগিয়ে যায় এবং পদক জয় করে। ভারতীয় দল কান্নায় ভেঙে পড়ে। 
একই গেমসে, গলফার অদিতি অশোকও একটি ঐতিহাসিক হারানোর যন্ত্রণা অনুভব করেছিলেন। বিশ্বের ২০০ তম স্থানের গলফার, ২৬ বছর বয়সী বিশ্বের সেরা গলফারদের সঙ্গে প্রতি মুহূর্তে লড়েছেন। যদিও, তিনি শেষ পর্যন্ত চতুর্থ স্থান অর্জন করেন।
আশা করা যায় এবার আর এই যন্ত্রণা থাকবে না।
 

Comments :0

Login to leave a comment