Editorial on Democracy

গণতন্ত্র রক্ষার রায়

সম্পাদকীয় বিভাগ

বি‍‌শ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র’ বা ‘গণতন্ত্রের জননী’ বলে যত বড়াই করা হোক না কেন গণতন্ত্রের আসল সাফল্য তার প্রয়োগে। ভারতের বর্তমান বাস্তবতায় গণতন্ত্রের ঠাঁটবাট বজায় থাকলে ক্রমাগত বিপন্নতা ও ঝুঁকির দিকেই ধাবিত হচ্ছে। বিশেষ করে গত নয় বছরের মোদী শাস‍‌নে গণতন্ত্রের মৌলিক ধারণা ও চরিত্রটাই বদলে ফেলার সচেতন প্রয়াস চলছে। আধুনিক বিজ্ঞান চেতনা এবং যুক্তিবাদ গণতন্ত্রের যে অবয়ব ও বিন্যাস গড়ে দিয়েছে তাতে বহু দলীয় সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পাশাপাশি জাতি, ধর্ম,বর্ণ, ভাষা, সংস্কৃতি ‍‌নির্বিশেষে সকল নাগরিকদেরই সমান অধিকার দিয়েছে। ভারতের সংবিধান ভারতীয় গণতন্ত্রের যে কাঠামো বানিয়েছে তাতে প্রতিটি ভারতবাসীর ভারতবাসীর জন্য এই অধিকারগুলি মৌলিক অধিকার রূপে স্বীকৃতি পেয়েছে। এইগুলি যদি সুরক্ষিত না থাকে তাহলে গণতন্ত্র অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ে। সংবিধান প্রদত্ত গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা ও প্রসারিত করা এবং গণতান্ত্রিক ধ্যান ধারণাকে আরও জীবন্ত ও অর্থবহ করে তোলাই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচিত সরকারের দায়বদ্ধতা। মোদী জমানায় এই দায়বদ্ধতাই সরকারের আচরণ থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে। বদলে তারা একদলীয় গণতন্ত্র তথা শাসকের গণতন্ত্রের এক সঙ্কীর্ণ আধিপত্যবাদী সংস্করণকে প্রোমোট করছে।
আরএসএস-বিজেপি যেহেতু বিজ্ঞান চেতনা ও যুক্তিবাদে বিশ্বাস করে না তাই বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস গবেষণাকে অস্বীকার করে। ধর্মান্ধতায় বিশ্বাস থেকে তারা আশ্রয় করে কল্পনাশ্রয়ী বেদ উপনিষদ পুরানের কাহিনিকে। বহুমাত্রিকতা ও বহুত্ববাদের বিপরীতে তারা এক ধর্ম, এক ভাষা, এক চিন্তা, এক ভাষ্য, একমতের শৃঙ্খলে দেশ ও মানুষকে বেঁধে ফেলতে চায়। এক দলীয় গণতন্ত্র ও একদলীয় শাসন তাদের লক্ষ্য। তাই পদে পদে সংবিধানকে লঙ্ঘন করে তারা দলীয় হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্ত আধিপত্যবাদকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। দেশ, রাষ্ট্র, সরকারের সর্বত্র শাসকের অনুশাসন প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। ভিন্নতা, স্বাধীন, নিরপেক্ষতা বলে কোনও কিছুই তারা সহ্য করে না। তাই গণতন্ত্রের মূল স্তম্ভগুলিকে তারা দলীয় মতাদর্শ অনুসারে নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়। দেশের প্রতিটি সাংবিধানিক স্বতন্ত্র ও স্বাধীন সংস্থাকে তারা নিয়ন্ত্রণে আনতে চায়। অর্থাৎ দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক, ভিজিলেন্স কমিশন, সিএজি, সিবিআই, ইডি, লোকায়ুক্ত থেকে শুরু করে নির্বাচন কমিশন, এমনকি বিচার ব্যবস্থাকেও দলীয় নিয়ন্ত্রণে বন্দি করতে চায়। বশংবদ করে ফেলতে চায় স্বাধীন নিরপেক্ষ সংবাদমাধ্যমকেও।
এই একদলী হিন্দুত্ববাদী আধিপত্যের অভিযানে ভারতের গণতন্ত্র অস্তিত্বের সঙ্কটে নিমজ্জিত। পরিস্থিতি যেভাবে এগচ্ছে তাতে অচিরেই ফ্যাসিস্ত শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়ে যেতে পারে। তাই শাসকের এই অপচেষ্টা আটকে দিয়ে গণতন্ত্র রক্ষাই প্রথম ও প্রধান কর্তব্য হিসাবে হাজির হয়েছে। গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষ সেই কর্তব্য পালনে লড়া‍ইয়ের ময়দানে বেশি বেশি করে শামিল হবেন এটাই প্রত্যাশিত। দিল্লিতে ক্ষমতাসীন শক্তিকে যদি গণতন্ত্রের জন্য লড়া‍‌ইয়ের মহাপ্লাবনে উৎখাত করা না যায়, গণতন্ত্রের বিপদ কমবে না।
সংবিধান রক্ষা এবং গণতন্ত্রকে প্রাণবন্ত রাখার প্রধান ভূমিকা শাসকের। স্বাধীন ও নিরপেক্ষ ব্যবস্থাপনায় যদি শান্তিপূর্ণ অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে শাসক নির্বাচিত না হয় তাহলে সেই শাসকের হাতে গণতন্ত্র কখনও নিরাপদ নয়। জনতার রায়ের যথার্থ প্রতিফলন ঘটে তখন যখন স্বাধীন, সৎ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন নির্বাচন পরিচালনা করে। তাই শাসকের পছন্দের লোক নিয়ে কমিশন গঠনের ব্যবস্থা তুলে দিয়ে নিরপেক্ষ ও সৎ কমিশন গঠন করতে হবে। দেশের গণতান্ত্রিক শক্তির দীর্ঘদিনের এই দাবির পক্ষে সর্বোচ্চ আদালত রায় দিয়েছে। মোদীরা নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ করতে পারবেন না। প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলনেতা এবং দেশের প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে গঠিত কমিটি মুখ্য নির্বাচন কমিশনার ও অন্য কমিশনারদের নিয়োগ করবে।

Comments :0

Login to leave a comment