Ganga Aarti

সরকারি টাকায় গঙ্গা আরতি নজর ঘোরানোর খেলা

রাজ্য

Ganga Aarati

 

 

গৌতম রায় 

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি কলকাতায় গঙ্গার ঘাটে সরকারি উদ্যোগে গঙ্গা আরতি শুরু করবার জন্য প্রশাসনিক স্তরে বৈঠকের পর নির্দেশ জারি করেছেন। কলকাতার কোন গঙ্গার ঘাটে সরকারি উদ্যোগে এই আরতি পর্ব সম্পাদন করা যায়, সে ব্যাপারে তিনি তাঁর দলীয় সতীর্থ তথা মন্ত্রীসভার সহকর্মী ফিরহাদ হাকিম এবং পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের নির্দেশ দিয়েছেন। পাশাপাশি পার্ক সার্কাস অঞ্চলে আলিয়া মাদ্রাসার জমি, যেটি আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বামফ্রন্ট সরকারের আমলে ব্যবহারের জন্য নির্দিষ্ট হয়েছিল, সেখানকার জমি অধিগ্রহণ করে ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের সম্প্রসারণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছেন।

 


এই গোটা কর্মকাণ্ডের দুটি পর্যায়ে রয়েছে। একটি হলো, সরকারি কোষাগারের টাকায় হিন্দু ধর্মের আচার অনুষ্ঠান সম্বলিত গঙ্গা আরতির প্রচলন। দ্বিতীয়টি হচ্ছে ,ওয়াকফ বোর্ডের জমি ব্যবহার। যে জমি অবিভক্ত বাংলায় এ কে ফজলুল হক প্রিমিয়ার থাকাকালীন উদ্ধার করা হয়েছিল। তারপর দীর্ঘদিন সেটি অব্যবহৃত অবস্থায় পড়েছিল। একুশ শতকের প্রথম পর্বে রাজ্যের তৎকালীন সংখ্যালঘু উন্নয়ন মন্ত্রী মহম্মদ সেলিমের সময়ে সেই জমিগুলোকে উদ্ধার করা হয়। সেই জমিতে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্প্রসারণ করা। কেবলমাত্র  মুসলমান সম্প্রদায়ের জন্যই শুধু নয়, গোটা পশ্চিমবঙ্গবাসীর স্বার্থ সমন্বিত নানা উন্নয়নমূলক কাজের জন্য সেটি ব্যবহারের জন্য চিন্তা ভাবনার শুরু ও তখন হয়েছিল।
স্বাধীনতার ৭৫ বছর অতিক্রান্ত। তার আগেও দীর্ঘ সময় যখন হিন্দু জাতীয়তাবাদের ভাবাবেগে অবিভক্ত বাংলাকে প্লাবিত করবার চেষ্টা হয়েছিল সেই সময়েও কেউ কলকাতার গঙ্গার ঘাটে, গঙ্গা আরতির কোনো রকম ভাবনা-চিন্তা তাদের মাথাতেই আনেননি। বস্তুত উত্তরপ্রদেশের বারাণসীর গঙ্গার ঘাটের আরতির অনুকরণে কলকাতার গঙ্গার ঘাটে, গঙ্গা আরতির উপক্রম। আরএসএসের অদৃশ্য বন্ধু মমতা ব্যানার্জি পশ্চিমবঙ্গের বুকে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের নতুন দিক খুলে দেওয়ার চেষ্টা করছেন।    

 

 


হিন্দু সম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শক্তি বাবরি মসজিদ ধ্বংস করার পর থেকে বারাণসীর দশাশ্বমেধ ঘাটে গঙ্গা আরতির হয়। তার আগে একমাত্র অবিভক্ত উত্তর প্রদেশ, বর্তমান উত্তরাখণ্ডের হরিদ্বারের হর কি পেয়ারিতেই এই গঙ্গারতির প্রচলন ছিল। গোটা উত্তরপ্রদেশের আর কোনো গঙ্গার ঘাটে এই ধরনের গঙ্গা আরতির কোনো প্রচলন ছিল না ।
দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের সময়কাল থেকে যখন ধীরে ধীরে বিজেপি পরবর্তী ২০১৪ লোকসভা নির্বাচনকে পাখির চোখ করে শুরু করে। সেই সময় থেকেই বারাণসীর গঙ্গার ঘাটে আরতির শেষে দশাশ্বমেধ ঘাটে মাইক থেকে এমন কিছু শ্লোগান দেওয়া হতো, যে স্লোগানগুলি একেবারেই আর এস এর বিভিন্ন শাখা সংগঠন, বিশেষ করে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের ধর্মীয় বিভাজনের স্লোগানের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ। 

 

 

নরেন্দ্র মোদি ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিজেপির প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হওয়ার বেশ কিছু আগে থেকেই উত্তরপ্রদেশের বারাণসীর দশাশ্বমেধ ঘাটের গঙ্গারতীর শেষে মাইকে ঘোষণা করা হতো; 'গো হত্যা বন্ধ্ করো'। হরিদ্বারের হর কি পেয়ারিতে যে গঙ্গা আরতি হয়, সেখানে যদিও কোনো রাজনৈতিক অভিসন্ধি দেখতে পাওয়া যায়নি আজ পর্যন্ত। 
২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে একক গরিষ্ঠতা নিয়ে বিজেপি আবার ফিরে আসার পর,  পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি ১৮টি আসন জেতার দৌলতে, যে এলাকাগুলিতে তখন বিজেপি দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, তৃণমূল কংগ্রেস একটু কোণঠাসা, সেইসব এলাকা গুলির কিছু কিছু গঙ্গার ঘাটে এই গঙ্গা আরতীর প্রচলন দেখতে পাওয়া গিয়েছিল। ব্যারাকপুর লোকসভা কেন্দ্রের ভাটপাড়া বিধানসভা কেন্দ্রের বলরাম সরকার ঘাটে এই ধরনের গঙ্গা আরতিতে তখন নামে-বেনামে আরএসএসের বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে সংগঠিত হওয়ার কথা বলা যায়। বিজেপি এবং তৃণমূল উভয়দলের লোকজনেরাই ধর্মীয় জিগির  দিয়ে অংশগ্রহণ করেছে সক্রিয়ভাবে ।

 

 


মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখে স্বীকার না করলেও সেই কার্যক্রমকেই পশ্চিমবঙ্গের বুকে স্থায়ীভাবে স্থাপন করতে তিনি এই সরকারি টাকায় গঙ্গা আরতির উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। তাঁর প্রতিযোগিতামূলক সম্প্রদায়িক নীতির প্রচলন ,প্রয়োগ, প্রসার-  সর্বক্ষেত্রেই তাঁর প্রধান পরামর্শদাতা, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘকে অন্ধের মত অনুসরণ করেন।    

পশ্চিমবঙ্গে কী এমন ব্যাপার ঘটেছে যার জন্য ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের নামে শপথ নেওয়া একটি রাজ্য সরকার সাধারণ মানুষের করের টাকায়, একটি বিশেষ ধর্মের, ধর্মীয় আচরণ পালনে এভাবে এগিয়ে আসছে? গোটা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে শিক্ষায় ভয়াবহ সঙ্কট। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যে ক্ষমতাসীন হওয়ার সময় কাল থেকে শিক্ষক নিয়োগ সহ সমস্ত ধরনের সরকারি নিয়োগেই ব্যাপক চলছে। চাকরি পরীক্ষায় উত্তীর্ণরা চাকরি পাচ্ছে না,  তার জায়গায় তৃণমূলকে ঘুষ দিয়ে অযোগ্য লোকজনেরা চাকরি পাচ্ছে। নিজেদের পছন্দে বদলি কিনছে।
মমতার সম্পর্কে ব্যাপক ক্ষোভ তৈরি হয়েছে, সেই ক্ষোভকে অন্য খাতে বইয়ে দেবার লক্ষ্যেই সাম্প্রদায়িকতার ঢাকে কাঠি দিতে, আরএসএসের নির্দেশে, জনগণের করের টাকায় এই উদ্যোগ। এই সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণভাবে ভারতের সংবিধানকে অবমাননা করা। কারণ, দেশের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের নামে শপথ নেয়া কোনো সরকার কোনো অবস্থাতেই বিশেষ কোন ধর্মের পক্ষাবলম্বন করতে পারে না। মমতা সরকারি কোষাগারের টাকায় বছরের পর বছর দুর্গাপুজোয় বিভিন্ন ক্লাবকে হাজার হাজার টাকা দিয়েছেন। 

 

 


রাজনৈতিক মমতা চাইছেন, তাঁর রাজনৈতিক কেরিয়ারের ধারক বাহক আরএসএস যাতে সামাজিক বিভাজনের অবাধ মৃগয়াক্ষেত্র হিসেবে পশ্চিমবঙ্গকে ব্যবহার করতে পারে। তিনি নরেন্দ্র মোদী কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার আগেই ইমাম ভাতার নাম করে শুধু হিন্দু মুসলিমের বিভাজন তৈরি করেননি, মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যেও নানা ধরনের সামাজিক ব্যবধান তৈরি করেছেন। এই ইমাম ভাতার নামে মুসলমানদের হকের টাকা থেকে সামান্য দু চার পয়সা দিয়ে সংখ্যালঘু প্রেম দেখাতে চান মমতা। অথচ, মমতার শাসনকালে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ ক্রমশঃ সমস্যাদীর্ণ হয়েছেন। পূর্বতন বামফ্রন্ট সরকার মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার আধুনিক সংস্কার করেছিল। গোটা মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থাটাকেই ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।
মাদ্রাসায় কার্যত নিয়োগ বন্ধ। মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশনকে মমতা নিজের দলের লোকেদের  টাকা রোজগারের একটা যন্ত্রে পরিণত করতে উৎসাহী হয়েছেন। এসএসসি উত্তীর্ণ থেকে শুরু করে, মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষা উত্তীর্ণ ছেলে-মেয়েরা দিনের পর দিন কলকাতার রাজপথে অনশন করেছে, অবস্থান করেছে। নারকীয় তান্ডবের মাধ্যমে পুলিশ দিয়ে সেই সব অবস্থান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তুলে দিয়েছেন। 

 

 


এইচএসসি উত্তীর্ণ চাকরি না পাওয়া অনশনরতদের উপর বর্বরোচিত আক্রমণ সকলেরই জানা। মানুষের দৃষ্টিকে ঘুরিয়ে দিয়ে, মানুষকে একটা সাম্প্রদায়িক বিভাজনের রাজনীতির মধ্যে ঘুরপাক খাওয়ানোর তাগিদ থেকেই, আরএসএসের নির্দেশে মমতা একইসঙ্গে কলকাতার গঙ্গার ঘাটে আরতির নির্দেশ দিচ্ছেন, সরকারি কোষাগারের টাকায়। আবার আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের  জমি গ্রাস করতে চাইছেন ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের সম্প্রসারণের নাম করে।
ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের সম্প্রসারণের প্রয়োজনীয়তার সঙ্গে আমরা কেউ দ্বিমত পোষণ করি না। কিন্তু ওই জমিগুলিতে উচ্চপদস্থ আমলাদের আবাসন করার উদ্যোগ দীর্ঘদিন ধরে মমতা চালাচ্ছেন। কিন্তু সম্মিলিত নাগরিক সমাজের প্রবল প্রতিরোধের কারণে সেই কাজে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আজ পর্যন্ত সফল হতে পারেননি। সমস্ত কিছুরই দায়িত্বভার বকলমে তৃণমূল কংগ্রেসের লোকজনদের হাতেই যে মমতা তুলে দেবেন তা আর বলবার অপেক্ষা রাখে না ।
২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে, লোকসভায় পশ্চিমবঙ্গে আসন বাড়াতে আরএসএস’র ভরসা মমতা। তার জন্যই মমতার এমন দ্বৈত কৌশল।

Comments :0

Login to leave a comment