Israel

গাজা চিরকালের জন্য দখল করতে চায় ইজরায়েল

আন্তর্জাতিক

ইজরায়েল যে শুধু গাজায় ‘হামাসের বিরুদ্ধে অভিযান’ চালাচ্ছে না, তা স্পষ্ট করে দিলেন প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। তিনি জানিয়েছেন, এই যুদ্ধ শেষ হলেও গাজায় ‘অনির্দিষ্ট কালের জন্য’ ইজরায়েল থাকবে। তাঁর ভাষায়, গাজার সামগ্রিক নিরাপত্তার দায়িত্ব থাকবে ইজরায়েলের হাতেই। এবিসি নিউজে সাক্ষাৎকারে তাঁর এই মন্তব্য পরিষ্কার করে দিয়েছে গাজা দখলে আনতে চায় ইজরায়েল। ১৯৬৭ সালে রাষ্ট্রসঙ্ঘের তৈরি সীমানা লঙ্ঘন করে গত ৫৬ বছর ধরেই নিজেদের এলাকা বাড়িয়েছে ইজরায়েল। প্যালেস্তাইনের জমি দখল করতে সেনা আগ্রাসন চালিয়েছে। ইজরায়েলের অধিকৃত এলাকা ক্রমশ বেড়েছে আর প্যালেস্তাইন পরিণত হয়েছে কার্যত কয়েকটি ছিটমহলে। সেখানেও ইজরায়েলের সেনারা মোতায়েন রয়েছে, পাঁচিল রয়েছে, নজরদারি চেকপোস্ট রয়েছে। ২০০৫ সালে গাজা থেকে সেনা সরিয়ে নিলেও ইজরায়েল গাজাকে অবরুদ্ধ করে রেখেছে সীমান্ত-পাঁচিল দিয়ে। সঙ্গে চলেছে খাদ্য পানীয় জল, বিদ্যুৎ, জ্বালানি, ওষুধের অবরোধ। গত এক মাস ধরে ইজরায়েল দাবি করছে, তারা ‘সন্ত্রাসবাদী’ হামাসের বিরুদ্ধে লড়ছে। অথচ প্রাণ গেছে ১০ হাজারের বেশি নাগরিকের। যার ৪০ শতাংশই শিশু। এদিন সম্প্রচারিত নেতানিয়াহুর সাক্ষাৎকারে প্রমাণিত লড়াই হামাসের বিরুদ্ধে নয়, গাজাকে ভৌগোলিক-রাজনৈতিক ভাবে দখল করার। সেই লক্ষ্যেই গাজার জনসংখ্যার উল্লেখযোগ্য অংশকে ইজরায়েল প্রাণে মারতে চায়, হাসপাতাল-স্কুল-শরণার্থী শিবির এবং পরিকাঠামো গুঁড়িয়ে দিয়ে গাজাকে মানুষের বসবাসের অযোগ্য করে তুলতে চায়। ইজরায়েল চেষ্টা চালাচ্ছে গাজার মানুষকে মিশরের সিনাইয়ে পাঠিয়ে দিতে, যাতে গাজা প্যালেস্তিনীয়-মুক্ত ভুখণ্ডে পরিণত হয়। আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক মহলে আলোচনা চলছিল, যুদ্ধ-পরবর্তী গাজার চেহারা কী হবে। নেতানিয়াহু ইজরায়েলের বক্তব্য স্পষ্ট করে দিয়েছেন এই বলে যে প্যালেস্তাইন কর্তৃপক্ষ (যারা ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে সীমায়িত শাসন চালায়) গাজায় আর ঢুকবে না। গাজা ইজরায়েলের অংশ হয়ে যাবে। 
ইজরায়েলের আক্রমণ আরও তীব্র হয়েছে। তাদের সেনাবাহিনী সূত্রে দাবি করা হয়েছে, কয়েক দশকের মধ্যে এই প্রথম তারা গাজা শহরের মধ্যে ঢুকেছে। প্রচুর বাড়িঘর ভাঙতে তারা সক্ষম হয়েছে। আকাশ থেকে বোমাবর্ষণের সঙ্গেই ট্যাঙ্ক থেকে গোলাবর্ষণ চলছে। তবে তাদেরও ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে বলে তারা স্বীকার করেছে। প্যালেস্তিনীয় প্রতিরোধ বাহিনী জানিয়েছে, ইজরায়েলের সাতটি ট্যাঙ্ক তারা উড়িয়ে দিয়েছে। সাঁজোয়া গাড়ি উড়িয়ে দিয়েছে। ইজরায়েলী ফৌজকে লক্ষ্য করে মর্টার ও মিসাইল ছুঁড়ে তাদের আটকে দিয়েছে। 
ইজরায়েল বারংবার ঘোষণা করছে উত্তর গাজা থেকে দক্ষিণে চলে গেলে অধিবাসীরা রক্ষা পাবেন। এটি আদ্যন্ত অসত্য প্রচার বলে বারবার প্রমাণিত হচ্ছে। সংবাদসংস্থা এপি’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যে রাস্তা ছিল ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যস্ত রাস্তা সেখান দিয়েই এখন চলেছে প্রাণ বাঁচানোর জন্য মানুষের স্রোত। কারোর পিঠে পোশাকের বস্তা, কারো হাতে ধরা সন্তানের হাত, কেউ গাধার পিঠে মাল চাপিয়ে চলেছেন অজানা ঠিকানার খোঁজে। অনেকেই বলেছেন, ইজরায়েলী সেনারা তাঁদের ওপরে গুলি চালিয়েছে। রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মৃতদেহের পাশ দিয়েই তাঁরা চলেছেন। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রকের মুখপাত্র বলেছেন, ইজরায়েলের নিরাপদে চলে যাবার প্রচার আসলে কিছুই নয়, মৃত্যুর একটি করিডর তৈরি করা। স্তূপীকৃত মৃতদেহ পড়ে রয়েছে ওই রাস্তায়। অন্তত মৃতদের সরিয়ে নিতে আন্তর্জাতিক রেড ক্রসের সাহায্য চেয়েছে তারা। 
গাজার দৃশ্য এখন এইরকম: বোমাবিধ্বস্ত বাড়ি থেকে মৃত শিশুকে বের করে আনা হচ্ছে, সাদা চাদরে মোড়া সার সার মৃতদেহের সামনে এক মহিলার আর্ত কান্না, ইতিমধ্যেই ভিড়ে উপচে পড়া হাসপাতালে এসে পৌঁছাচ্ছে আরো একদল আহত, এক লিটার জল পাওয়ার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা দীর্ঘ সারিতে দাঁড়িয়ে আছেন মানুষ। খান ইউনিসে একটি বাড়িতে বোমাবর্ষণে মারা গিয়েছিলেন ১১জন। বেঁচে রয়েছেন আহমেদ আয়েশ। সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ‘আমরা সাধারণ নাগরিক। তথাকথিত ইজরায়েলের বীরত্ব এমনই যে তারা শিশু, বৃদ্ধদের মেরে বেড়াচ্ছে। আমরা মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছি। যে জীবনে বেঁচে আছি তার থেকে মৃত্যু অনেক ভালো। প্রত্যেক মূহূর্তে মৃত্যুর অপেক্ষা করছি। আসলে মৃতের মতোই রয়েছি’। 
রাষ্ট্রসঙ্ঘের খান ইউনিস ট্রেনিং সেন্টার এখন আশ্রয় শিবির। রয়েছেন ২২ হাজার। প্রতি ৬০০জন পিছু একটি শৌচাগার। নিকাশি ব্যবস্থা বলে কিছু নেই। কলেরা ও অন্য সংক্রামক রোগের প্রকোপের আশঙ্কা করছেন রাষ্ট্রসঙ্ঘের দায়িত্বপ্রাপ্তরা। 
এযাবৎ গাজায় নিহতের সংখ্যা ১০,৩২৮। এর মধ্যে ৪২৩৭ শিশু। ২৭১৯ মহিলা। ৮৮জন রাষ্ট্রসঙ্ঘের সংস্থার কর্মী, যা কোনোদিন কোনও যুদ্ধে ঘটেনি। ৪৮জন সাংবাদিক, যা-ও নজিরবিহীন। 
রাষ্ট্রসঙ্ঘকে কাজ করা থেকে আটকে রেখেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। নিরাপত্তা পরিষদের বর্তমান সভাপতি হিসাবে ‘মানবিক সঙ্কট’ নিরসনে বৈঠক ডেকেছিল চীন। সেই বৈঠকে সদস্যরা মানবিক কারণে যুদ্ধবিরতি চাইলেও মার্কিন প্রতিনিধি আপত্তি জানান। মার্কিন প্রতিনিধি রবার্ট উড বলেন, আমরা ‘মানবিক বিরতি (পজ)’ চাই, যুদ্ধবিরতি না। ‘এই শব্দ ব্যবহার নিয়ে আমরা লড়ে যাব’, তাঁর মন্তব্য।

Comments :0

Login to leave a comment