Post Editorial migrated labour

এরাজ্যে কফিনবন্দি হয়ে ফেরাই এখন বাস্তব

বিশেষ বিভাগ

গত অক্টোবরে দুর্গাপুজোর সময় ভিনরাজ্য থেকে বাড়ি ফিরে এসেছিল ওরা। পুজো কাটিয়ে আর যাওয়ার ইচ্ছা ছিল না ভিনরাজ্যে। এলাকা থেকেই কাজ জুটিয়ে বাড়িতে আর থাকা হয়নি ওঁদের।
হরিপালের পানিশেওলা গ্রাম থেকে পাঁচ জন তরতাজা আদিবাসী যুবক উঠেছিলেন করমণ্ডল এক্সপ্রেসে। তার পরের ঘটনা আমাদের সকলেরই জানা। পাঁচ তরতাজা যুবক আহত হয়ে এখন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। ২২ বছরের গোপাল হেমব্রমের এখনও কোনো খোঁজ নেই। 
আদিবাসী পরিবারের ছেলে রোহিত হেমব্রম। দুর্ঘটনার পর আহত হয়ে প্রথমে বালেশ্বর, পরে ভর্তি আছেন হুগলীর হরিপালের সরকারি হাসপাতালে। পায়ে চোট। এখনও হাঁটতে, চলতে সমস্যা। পাঁচজনের দলে ওই যুবক ছিলেন। করমণ্ডল এক্সপ্রেস চড়ে প্রথমে চেন্নাই। সেখান থেকে কেরালা যাওয়ার কথা ছিল। ফার্নিচারের কাজের জন্য এবারও সে গ্রাম ছেড়েছিল স্রেফ একটা কাজের জন্য। বাবা স্থানীয় হিমঘরের শ্রমিক। অনটনের মধ্যেও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা করে এরাজ্যে তাঁর কোনো কাজ জোটেনি। তাই এবারই প্রথম সে রওনা দিয়েছিল কাজের সন্ধানে। ‘এখানে তো বাড়িতে বসেছিলাম। তাই ভাবলাম, যাই কোনো কাজ যদি পাওয়া যায়।’ হাসপাতাল থেকে বলছিলেন যুবক। এখানে কাজ জোগাড় করার সব চেষ্টা করেও কোনো কাজ না পাওয়ার জন্য যেতে বাধ্য হয়েছিল বাড়ির বড়ছেলে। দুর্ঘটনার পরদিনই বালেশ্বরের হাসপাতালে গিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়ে, শরীরে দুর্ঘটনার চোট আঘাতের চিহ্ন নিয়ে হাসপাতালের ইমারজেন্সিতে থিকথিকে ভিড়ে এরাজ্যের পরিযায়ী শ্রমিকদের কাছে একটি চমকপ্রদ আশ্বাস দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁদের কাছে মমতা ব্যানার্জি বলেছিলেন,‘‘ কী দরকার ওখানে কাজ করতে যাওয়ার। এখানে তো কাজ আছে অনেক।’’ ফ্যালফ্যাল করে মমতা ব্যানার্জির কথা শুনেছিলেন বাসন্তী থেকে বাঘমুন্ডির পরিযায়ী শ্রমিকরা।
কোভিড তখন গোটা দেশে ঝাঁকিয়ে বসেছে। মোদী সরকারের অপরিকল্পিত আকস্মিক লকডাউনের সিদ্ধান্তে লক্ষ, লক্ষ কাজ হারানো পরিযায়ী শ্রমিকের ঘরে ফেরার স্মৃতি আমাদের এখন শিউরে দেয়। কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে লোকসভায় দেওয়া তথ্যে বলা হয়েছিল, কোভিড পর্বে পশ্চিমবঙ্গে ওই সময় কাজ হারিয়ে ঘরে ফেরা পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ১৪ লক্ষেরও বেশি। সবার শীর্ষে ছিল যোগী আদিত্যনাথের উত্তরপ্রদেশ। তারপরে বিহার। কাজ হারিয়ে ঘরে ফেরা পরিযায়ী শ্রমিকের তালিকায় তিনে ছিল এরাজ্য। এই হিসাব নথিভুক্ত শ্রমিকদের। তার বাইরেও লক্ষাধিক শ্রমিকের কাজ হারিয়ে ঘরে ফেরার ঘটনা আছে। কোভিড পর্বেই প্রকাশ্যে এসেছিল এরাজ্যে কাজের হাহাকার কতটা তীব্র। 
কোভিডের রেশ কিছুটা কাটার পর রাজ্য প্রশাসনের সদর দপ্তর নবান্নে এসেছিলেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দোপাধ্যায়। কোভিডকালে রাজ্যের অর্থনীতিকে কীভাবে চাঙ্গা করা যায় তারজন্য রাজ্য সরকার তৈরি করেছিল একটি গ্লোবাল অ্যাডভাইসরি কমিটি। পরিকল্পনা মহৎ, তা নিয়ে কোনো সমালোচনার প্রশ্ন নেই। সেই অ্যাডভাইসরি কমিটির সভাতে এসে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিল এরাজ্যের অর্থনীতির মূল সমস্যা চিহ্নিত করেছিলেন পরিযায়ী শ্রমিকদের। কোভিডে কাজ হারিয়ে ঘরে ফেরা শ্রমিকদের আয় নিশ্চিত করার ওপর কীভাবে জোর দেওয়া যায় তার পরামর্শ দিয়েছিলেন অভিজিৎ বিনায়ক বন্দোপাধ্যায়। তাঁর আক্ষেপ ছিল,‘‘আমাদের রাজ্যে বিশেষ সমস্যা পরিযায়ী। রাজ্যের আয়ের অনেকটা আসে পরিযায়ীদের কাছ থেকে। আমাদের মানুষরা বাইরে কাজে চলে যায়।’’ 
দু’বছর আগে সরকারকে দেওয়া পরামর্শ মেনে কি পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি? আসলে হওয়ার কথাও ছিল না। এরাজ্য সরকারকে পরামর্শ দেবেন অর্থনীতিবিদ! সেই পরামর্শ রাজ্য মানবে? পশ্চিমবঙ্গের যাবতীয় অনুপ্রেরণার এপিসেন্টার তো কালীঘাট। শিক্ষা, চিকিৎসা, ললিতকলা, সঙ্গীত সব কাজেই দক্ষতার সঙ্গে যিনি অকাতরে জ্ঞান বিতরণ করতে পারেন সেদিনও অর্থনীতিবিদের পরামর্শ শেষ না হতেই তিনি জানিয়ে দিয়েছিলেন, আমাদের এখানে ফ্রি রেশন, ফ্রি চিকিৎসা, সব বিনা পয়সায়। কাজের কোনো অভাব নেই। ফলে ওই সভাতেই পরামর্শদাতা কমিটির বিশেজ্ঞদের কথা চাপা পড়ে যায়। তার ফল যা হওয়ার তা দেখছে রাজ্যের মানুষ।
গোটা দেশের যে প্রান্তেই এখন দুর্ঘটনা ঘটছে, সেখানেই মৃত্যুর তালিকায় যুক্ত হয়ে পড়ছেন এরাজ্যের মানুষ। পিক আপ ভ্যান উল্টে ভিনরাজ্যে মারা গেলে দেহ আসে কুলতলির গ্রামে। নির্মীয়মাণ বাড়ি তৈরির সময় লিফট ছিঁড়ে পড়ে গেলে কফিনবন্দি দেহ আসে মালদহে।
বালেশ্বরের ট্রেন দুর্ঘটনা ২৭৫ জনের জীবন কেড়েছে। গত কয়েক দশকের মধ্যে এত বড় দুর্ঘটনা ঘটেনি। গত ২০২২সালের জানুয়ারি মাসে জলপাইগুড়ির দোমহনিতে বিকানির থেকে গুয়াহাটি যাওয়ার পথে এক ট্রেন দুর্ঘটনায় ৯জনের মৃত্যু ঘটেছিল। মৃতের তালিকায় থাকা এরাজ্যে কোচবিহারের বাসিন্দা ছিলেন পাঁচজন। ওই পাঁচজনই ছিলেন পরিযায়ী শ্রমিক। গ্রামে কাজ না পেয়ে কোচবিহার থেকে রাজস্থানে পাড়ি দিতে হয়েছিল যুবকদের। মমতা ব্যানার্জির বিনামূল্যের স্বাস্থ্যসাথী কার্ড থাকা সত্ত্বেও কাজে দেয়নি দুর্ঘটনায় মৃত ২৭ বছরের চিরঞ্জিত বর্মনের। গল ব্লাডারে স্টোন অপারেশনের খরচের টাকা তুলতে তাঁকে যেতে হয়েছিল ভিনরাজ্যে। কাজ করে টাকা নিয়ে ফেরার পথে বাড়ির অদূরেই রেল দুর্ঘটনা কেড়ে নেয় যুবকের প্রাণ।
তখন রাজ্যে কোনো নির্বাচন আসন্ন ছিল না। তখনও ১০০দিনের কাজ আটকে রেখেছিল কেন্দ্রীয় সরকার। কিন্তু পাঁচজনের দিকে তাকাতে পারেনি সরকার। আর এখন রাজ্যে সামনে পঞ্চায়েত ভোট। দলের দ্বিতীয় ব্যক্তি কালীঘাটের বাড়ি ছেড়ে দিনে দুপুরে রাজ্যের মানুষের হাল হকিকতের খোঁজ নিতে বেরিয়েছেন। রাতে থাকছেন শীতাতপনিয়ন্ত্রিত তাঁবুতে। সরকারও তাই পথে। ১৪তলা থেকে নেমে মমতা ব্যানার্জি দাঁড়াচ্ছেন বিদ্যাসাগর সেতুর টোল প্লাজায়। তার আগে ওডিশা থেকে আসা অ্যাম্বুলেন্সে ভরিয়ে দেওয়া হচ্ছে রুম ফ্রেশনার দিয়ে। মমতা ব্যানার্জি মালা দিচ্ছেন। 
এরাজ্যের মৃত্যু মিছিলও সরকারি অনুপ্রেরণায় ইভেন্টের মর্যাদা পেয়েছে। বুধবার সেই ইভেন্টের শুভ উদ্বোধন করবেন মমতা ব্যানার্জি। ট্রেন দুর্ঘটনায় নিহত-আহত পরিবারকে আনা হয়েছে কলকাতায়। শোকসন্তপ্ত পরিবারকে পাশে নিয়ে মৃত্যু উৎসবে শামিল হবে রাজ্য সরকার। নিঃশব্দে কোনো কাজ এরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর ঘোর অপছন্দ। তাই সে দুর্ঘটনা হোক বা দুর্নীতি, গলা ফাটিয়ে পাশে দাঁড়ানো এরাজ্যের এখন দস্তুর হয়ে গেছে। বুধবার তাই শোকের ইভেন্ট রাজ্যের। নির্মাণ শ্রমিকদের কল্যাণ তহবিলের টাকায় গোটা ইন্ডোর স্টেডিয়ামে শোকাতুরভাবে সাজিয়ে তোলা হয়েছে। আর সেই শোকাতুর পরিবেশে দরদি হয়ে মঞ্চে অবতীর্ণ হলেন মমতা ব্যানার্জি। 
সাত মাস ধরে মাথা খুঁড়েও রাজ্যে কাজ না পাওয়া যুবকদের কেন ভিনরাজ্যে যেতে হয়, তার সুলুক সন্ধান করার দায় নিতে চান না মমতা ব্যানার্জি। বাসন্তীর গ্রাম থেকে এক পরিবারের তিনজনের মৃত্যুর দায় নিশ্চিতভাবেই রেল মন্ত্রকের অপদার্থতাকেই ইঙ্গিত করবে। কিন্তু কেন, গ্রাম বাংলা থেকে স্রেফ ধান কাটার কাজের জন্য সুদূর অন্ধ্রপ্রদেশে পাড়ি দিতে হচ্ছে, তার কোনো জবাব বর্তমান রাজ্য সরকারের কাছ থেকে পাওয়া যাবে না। 
ভয়াবহ রেল দুর্ঘটনার এই মৃত্যুর দায় রেল মন্ত্রকের। রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব কানপুর আইআইটি’র প্রাক্তনী, তিনি দুর্ঘটনার পর থেকে ঠায় রেললাইনের ধারে বসেছিলেন, এসব প্রচার করেও মোদী সরকার তার দায় এড়াতে পারবে না। গত এক দশকে ভারতীয় রেলের যাত্রী সুরক্ষা উপেক্ষিত হতে হতে এখন শেষ পর্যায়ে গেছে। মন্ত্রকের কাজ এখন রেলের দায় সরকারের ওপর থেকে কমিয়ে আনা। চলছে তাই ঢালাও বেসরকারিকরণ। মুনাফার পিছনে রেলকে নিয়ে যাওয়ার জন্য ঘুরপথে পকেট কাটা হচ্ছে যাত্রীদের। দূরপাল্লার প্যাসেঞ্জার ট্রেনের গায়ে এক্সপ্রেসের লেবেল সেঁটে বাড়ানো হচ্ছে ভাড়া। এক্সপ্রেস ট্রেন বদলে যাচ্ছে সুপার ফাস্টে। ‘আপনার যাত্রা শুভ হোক’ টিকিটের সঙ্গে লেখা এই আপ্তবাক্য ভুলতে বসছে মন্ত্রক। 
দুর্ঘটনার কবলে পড়া ট্রেনযাত্রীদের এই মৃত্যুর সরাসরি দায় মোদী সরকারের। অনিচ্ছাকৃত মৃত্যুর দায় এড়াতে পারবে না রাজ্য সরকারও।
 

Comments :0

Login to leave a comment