Editorials on Morbi

কোথাকার জল কোথায় গিয়ে দাঁড়ালো

সম্পাদকীয় বিভাগ


৩০ অক্টোবর, ২০২২, গুজরাটের মোরবিতে মাচ্ছু নদীর ওপর ব্রিটিশ আমলে নির্মিত ঝুলতা পুল ভেঙে পড়ে। শ’দেড়েক মানুষ মারা যান। শতাধিক আহত। গুজরাট নির্বাচনের আগে এ নিয়ে বিপুল হইচই হলেও, নির্বাচনে জিতেছে বিজেপি।
গুজরাটে বিজেপি’র আরও ভালোভাবে বললে আরএসএস’র মজবুত বুনিয়াদ তৈরির পিছনে এই মোরবির ভূমিকা অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য। হাজার হাজার মৃতদেহের ওপর দিয়ে তৈরি এই হিন্দুত্বর শক্তপোক্ত অবস্থান কীরকম!
ভারতবর্ষের ইতিহাসে যে’কটা প্রলয়ঙ্কর দুর্ঘটনা ঘটেছে তার মধ্যে একটি হলো ১৯৭৯ সালে ঐ ‘মাচ্ছু’ নদীর ওপরকার বাঁধ ভেঙে যাওয়া। বাঁধটি ছিল  মোরাবিতে। যার ধাক্কায় শহরটাই মুছে যেতে ব‍‌সেছিল। চারদিকে শুধু কাদাবালি আর মৃতদেহের স্তূপ।
সালটা মনে রাখবেন, ১৯৭৯। মাত্র দেড় বছর আগে ইন্দিরা গান্ধীর কংগ্রেস সরকারের পতন হয়েছে। দিকে দিকে জনতা পার্টির জয়যাত্রা। জয়প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বে সারা ভারতের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে চতুর সমাবেশ ঘটিয়েছে আরএসএস এবং তাদের তৎকালীন রাজনৈতিক সংগঠন জনসঙ্ঘ। জনতা পার্টির ভিতরে মিশে রয়েছে জনসঙ্ঘ, যারা মাত্র আট বছর আগে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ বিজয়ের সময় শ্রীমতী গান্ধীকে দেবী দুর্গার সাথে তুলনা করেছিল। যেমন মমতা ব্যানার্জি হলেন অগ্নিকন্যা। সাত বছর বাদে তারাই হলেন ইন্দিরা-বিরোধী।
রাজনীতিতে অনেক  সর্পিল বাঁক থাকে। তাই কোনও দলের নির্দিষ্ট অভিমুখ একটিমাত্র  ঘটনা দিয়ে বোঝানো সম্ভব নয়। বিজেপি এবং আরএসএস-কে বুঝতে হলে দীর্ঘদিন ধরে তাদের  চলনকে খুঁটিয়ে দেখা  প্রয়োজন। ২০২২ সালে গুজরাট বিধানসভায় বিজেপি ’র রেকর্ডসংখ্যক আসনে জয়লাভকে দেখতে হলে ফিরে যেতে হবে ১৯৭৯ সালের মোরাবিতে।
তখন গুজরাটে কিন্তু কংগ্রেসই দোর্দন্তপ্রতাপশালী। সাতাত্তরের নির্বাচনে ঐতিহাসিক পরাজয়ের পরেও। চলে যাচ্ছি মোরবিতে। ১৯৭৯ সালের ১১ আগস্ট। যেদিন এই ঘটনাটি ঘটে সেদিন গুজরাটে কংগ্রেস পরিচালিত সরকারের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন বাবুভাই প্যাটেল। বিধ্বস্ত শহরটি ছিল সৌরাষ্ট্রে এবং এটি হচ্ছে গুজরাটের অতি-প্রভাবশালী ‘পতিদার’ জাত সম্প্রদায়ের মুখ্যভূমি। পতিদার সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক ক্ষমতা কতদূর, সেটা বোঝার জন্য মাত্র দুটি উদাহরণ দিচ্ছি।
সর্দার বল্লবভাই প্যাটেলের বিশাল মর্মরমূর্তি তৈরি হলো, নর্মদা বাঁধের উচ্চতা বৃদ্ধি হলো। প্রায় ২৩৫টি গ্রাম, যার মধ্যে ১৯৩টি মধ্য প্রদেশের, ৩৩টি মহারাষ্ট্রের এবং ১৯‍‌টি গুজরাটের গ্রাম জলের তলায় চলে গেল। এদের মধ্যে বেশিরভাগই হলো গরিব আদিবাসীদের। লক্ষণীয় যে এর মধ্যে যাদের ‘পতিদার’ অঞ্চলের গ্রাম, তাদের কিন্তু সবাই পুনর্বাসন সরকারি আর্থিক সহায়তা পেল। কিন্তু বাকি গরিব আদিবাসী গ্রামের মানুষরা জলের তোড়ে ভেসে গেল। খড়কুটো ধরে অসহায় সংগ্রাম করে তারা কিছুই পেল না।
দ্বিতীয়ত, ঘটনা হলো এই নির্বাচনের আগের নির্বাচনে ‘বিজেপি’র পরাজয় প্রায় হয়ে যাচ্ছিল। কারণ ঐ পতিদার সম্প্রদায়ের বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে অসন্তোষ। হার্দিক প্যাটেল তখন এই বিক্ষোভের মুখে। এখন আবার হার্দিক ফিরে গেছে বিজেপি-তে। পতিদার দেবতরা প্রধানরাও প্রসাদে সন্তুষ্ট।  কোন দেবতা কিসে সন্তুষ্ট হয়, সেটা ভালো জানে অমিত শাহ-আরএসএস।
১৯৭৯ সালের ‍‌ঐ ভয়াবহ দুর্ঘটনার পর মুখ্যমন্ত্রী বাবুভাই প্যাটেল পরবর্তী তিন মাসের জন্য গোটা মন্ত্রীসভা নিয়ে বসেছিলেন। ছুটে এসেছিলেন মোরাবিতে। একটানা কাজ করে গেছেন প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত মোরবি শহরের পুনর্গঠনে।
ঠিক এই সময়ই কাজটি করে আরএসএস। তারা তখনও  সংগঠনগতভাবে দুর্বল। শত শত আরএসএস ক্যাডার এসে এই সরকারি ত্রাণ ও পুনর্বাসনের কাজে হাত লাগান। একঢিলে দুই পাখি গেল।
এখনও অসহায় মানুষের কাছে এই সমস্ত আরএসএস কর্মীরা গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠলো হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শের জন্য নয়, যেন আন্তরিক কাজের মানুষ হিসাবে। সেটাকে পরবর্তীতে কাজে লাগায় আরএসএস, তাদের কট্টর মতবাদ প্রচারে।
‘চিত্রলেখা’ পত্রিকা। তৎকালীন গুজরাটের সুপরিচিত ম্যাগাজিন। তাতে ছাপা হয়েছিল ছবি। ইন্দিরা গান্ধীর নাম ছাপা হয়েছিল ইন্দিরাবেন ‍‌নামে। মৃতদেহের দুর্গন্ধ ঢাকতে নাকে রুমাল দিয়ে হাঁটছেন মোরবিতে পাশাপাশি ছাপা হয়েছিল আরএসএস কর্মীদের ছবি। যাদের মাথায়‍ ছিল গান্ধী টুপি। কাদার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। আরএসএস কতটা খতরনাক এটা কিন্তু জানতেন ইন্দিরা গান্ধী। সেকারণে উনি খুব বেশি আমল দিতেন না। কিন্তু জরুরি অবস্থার স্বৈরাচার, মিসা-এসমা অজস্র কালাকানুন (পশ্চিমবাংলায় যা কার্যত ৭০ সাল থেকেই শুরু হয়। ৭২ সাল থেকে শুরু আধা-ফ্যাসিস্ত সন্ত্রাস)— এসবের কারণে উনি যখন সারা ভারতবর্ষে জনধীকৃত এবং জনতার রায়ে পর্যুদস্ত।
কৌশলটা বোঝার জন্য আরেকটা তথ্য, তৎকালীন গুজরাটের আরএসএস’র তিনজন প্রধান নেতা হলেন চিমনভাই শুক্লা, কেশুভাই প্যাটেল এবং প্রবীণ মনিয়ার। লক্ষণীয় এরমধ্যে কেশুভাই প্যাটেল ছিলেন তৎকালীন সরকারের সেচমন্ত্রী। সরকার চালাচ্ছে কংগ্রেস, মন্ত্রী হচ্ছে আরএসএস। উনি ১৯৭২ সালেও কংগ্রেসের প্রার্থী হয়ে ‘ওয়ানকানা’র বিধানসভা থেকে নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালে যে কংগ্রেস সরকার তৈরি হয় তাকে বাইরে থেকে সমর্থন করে জনসঙ্ঘ। গুজরাটের মানুষের মুখে ঘুরতো একটি কথা— সংস্থা কংগ্রেস। জরুরি অবস্থার সময় অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তামূলক আইনে গ্রেপ্তার ও জেলবন্দি হন কেশুভাই। ইন্দিরা গান্ধী  জেনেও কিছু করেননি কারণ উনি তখন ‘এশিয়ার মুক্তিসূর্য’। সবমিলিয়ে এটাই দাঁড়ালো— কায়দা করে সরকারের টিকি নাচাবো আর তলায় তলায় জমি খুঁড়বো। সাধে কী ভারতবর্ষের অসংখ্য ফিল্ম ডিরেক্টররা বলেন— আরএসএস হচ্ছে হিন্দু টেররিস্ট।
সুরেশ মেহতা, পরবর্তীকালে কিছুদিনের জন্য গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হন, উনিও আরএসএস ক্যাডার হিসাবে মোরবিতে কাজ করেছিলেন। উনি তখন জনসঙ্ঘে যুক্ত ছিলেন না।
নরেন্দ্র মোদী। তখন তাকে খুব বেশি লোকে চিনতো না। কিন্তু আরএসএস বিশেষ সংগঠক মোদী বিশেষভাবে, বাছাই করা অন্ধ্র প্রদেশের ক্যাডারদের নিয়ে এসে মোরবি পূনর্গঠনের কাজে হাত লাগান। ধ্বস্ত সময়ে চতুর আরএসএস যে কাজ করল তাই পরবর্তীতে গুজরাটের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জেলা সৌরাষ্ট্রকে আরএসএস’র গড়ে পরিণত করল। ১৯৮০ সালে জনসঙ্ঘকে বাতিল করে তৈরি হলো বিজেপি। ভারতীয় জনতা পার্টি। জনতা পার্টি নামটা রাখা প্রয়োজন। কারণ কংগ্রেসী অপশাসনকে পরাস্ত করেছে জনতা পার্টি এবং বামপন্থীরা মতাদর্শগতভাবেই চিরশত্রু, বামপন্থীদের নয়, জনতা পার্টিকেই প্রয়োজন।
বাবরি মসজিদ মাত্র তিন ঘণ্টার মধ্যে ভেঙে ফেলেছিল আরএসএস। ৫০০ বছরের পুরানো মসজিদকে জলদি ভাঙা তখনই সম্ভব, যখন তার কাঠামো সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকে। একাজে দরকার কারিগরি জ্ঞান সম্পন্ন জনক। পরবর্তী তদন্তে প্রকাশ হয়েছিল যে, এই প্রশিক্ষিত ক্যাডাররা এসেছিল অন্ধ্র প্রদেশ থেকে। চারিদিকের নাকাবন্দি, অজস্র নিরাপত্তারক্ষী থাকা সত্ত্বেও তারা পৌঁছে গিয়েছিল সঠিক মূহুর্তে সঠিক জায়গায়, আদবানি, বাজপেয়ী, কল্যাণ সিং, উমা ভারতী, স্বাধী খতম্ভরা, যোগী আদিত্যনাথ এদের অনেকের নাম সমস্ত প্রচারমাধ্যমে থাকলেও— নরেন্দ্র মোদী কোথাও ছিলেন না?
আরএসএস’র এই ধুরন্ধর মতলব যারা সঠিকভাবেই ধরতে পেরেছিলেন তাদের মধ্যে অনেকেই পরে পদ্মশিবিরে আনাগোনা করলেও দু’জন সর্বভারতীয় নেতা ছিলেন অবিচল। প্রথমজন শারদ যাদব, যিনি সম্প্রতি চলে গেলেন। কঠিন সময়ে উনি জয়প্রকাশ নারায়ণের প্রথম মনোনীত প্রার্থী হিসাবে ১৯৭৪ সালে মধ্য প্রদেশের জব্বলপুর লোকসভা কেন্দ্রের উপ-নির্বাচনে জয়ী হন। দ্বিতীয়জন লালুপ্রসাদ, জেলে রয়েছেন। কিন্তু হাত মেলাননি, আরেকজন জয়প্রকাশ নারায়ণের পাশে থাকা তরুণ নীতীশকুমার অবশ্য আপাতত বিজেপি শিবিরের বাইরে। কিন্তু অনেক কিন্তু আছে।
কিন্তু এখন আর কোনও কিন্তু নেই নরেন্দ্র মোদীকে নিয়ে। সেদিনের গোপন সংগঠক, সাংগঠনিক কাজিয়ায় জীর্ণ গুজরাট বিজেপি’তে লালকৃষ্ণ আদবানির হাত ধরে ২০০২ সালে হলেন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী, আর এখন, প্রধানমন্ত্রী।

 

Comments :0

Login to leave a comment