Cheatfund scam

চিটফান্ড কাণ্ডে ইডি’র হাতে শাসক-ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী গ্রেপ্তার

কলকাতা

 রাতের অন্ধকারে কখনও খুন হওয়া ছাত্রনেতার বাবাকে টাকার লোভ দেখিয়ে কেনার চেষ্টা কখনও বা রাতের অন্ধকারেই বোমা কারখানায় বিস্ফোরণে নিহতদের পরিবারে পুলিশি নিরাপত্তা নিয়ে অভিযান চালাতে দেখা গেছে তাঁকে!
নিজেকে ‘মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিনিধি’ পরিচয় দিয়েই আনিস খানের বাড়ি কিংবা এগরায় তৃণমূল নেতার বোমা কারখানায় বিস্ফোরণের ঘটনাস্থলে পৌঁছে গিয়েছিলেন তিনি।
সেই ‘মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিনিধি’ কলকাতা টিভির কর্ণধার, তৃণমূল ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী কৌস্তভ রায় এবার চিট ফান্ড কাণ্ডে গ্রেপ্তার ইডি’র হাতে। 
পাঁচ বছর আগে ব্যাঙ্কের আর্থিক প্রতারণার মামলায়, ৫০০ কোটি টাকা নয়ছয়ের মামলায় সিবিআই তাঁকে গ্রেপ্তার করেছিল। দিল্লি পুলিশের হাতেও গ্রেপ্তার হতে হয়েছিল তাঁকে। অথচ তিনিই হয়ে উঠেছিলেন মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিনিধি! শাসক দলের অন্দর থেকে নবান্ন, সর্বত্র ছিল তাঁর অবাধ গতিবিধি।
সোমবার বিকাল চারটে থেকে সিজিও কমপ্লেক্সে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার দপ্তরে টানা জেরার পরে রাত ১টা ৫মিনিট নাগাদ তাঁকে গ্রেপ্তার করেন ইডির আধিকারিকরা।
চিট ফান্ড সংস্থা পিনকন গ্রুপের মামলাতেই তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা ইডি। তাঁর সঙ্গে পিনকন গ্রুপের কর্ণধার মনোরঞ্জন রায়ের বিপুল পরিমাণ আর্থিক লেনদেনের তথ্য সামনে এসেছে। শুধু তাই নয়, চিট ফান্ডের কালো টাকা সাদা করার কারবারেও যুক্ত ছিলেন এই তৃণমূল ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী। এমনকি তাঁর সঙ্গেও বিপুল টাকার প্রতারণা করেছে কৌস্তুভ রায়, জেলবন্দি থাকাকালীন চলতি মাসেই ইডির কাছে এমন বয়ান দিয়েছেন ধৃত পিনকন গ্রুপের কর্ণধার মনোরঞ্জন রায়।
আদালতে দায়ের করা রিমান্ড কপিতে ইডির দাবি, শাসক দল ও সরকারের সঙ্গে তাঁর সখ্যের দাবি করেই এই প্রতারণার কারবার চালিয়েছেন ধৃত কলকাতা টিভির কর্ণধার, আর পি গ্রুপ্রের চেয়ারম্যান কৌস্তুভ রায়। খোদ জেলবন্দি, পনজি স্কিমের কারবার চালানো পিনকন গ্রুপের মালিক মনোরঞ্জন রায় তাঁর বয়ানে জানিয়েছিলেন ২০১৩ সাল থেকে ২০১৭’র মধ্যে কৌস্তুভ রায় তাঁর কাছ থেকে দেড় কোটি টাকা নিয়েছিলেন। তাঁর তিনটি সংস্থা আরপি টেলিভিশন প্রাইভেট লিমিটেড, আরপি ব্যাপার প্রাইভেট লিমিটেড এবং আরপি ইনফোসিস্টেম লিমিটেডের নামে এই টাকা নিয়েছিলেন কৌস্তভ রায়। পনজি স্কিমের টাকাই ঢুকেছিল তাঁর সংস্থায়। শুধু তাই নয়, এরপর সেই টাকা ফেরত চাইলে মনোরঞ্জন রায়কে পুলিশ দিয়ে গ্রেপ্তার করানোর হুমকি দেয় কৌস্তভ রায়। শাসক দলের ঘনিষ্ঠ দাবি করেই তিনি এই ভয় দেখাতেন।
আদালতে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা ইডির দাবি, চিট ফান্ড কারবারে পিনকন গ্রুপ বাজার থেকে কোটি কোটি টাকা তুলেছিল। সেই টাকার একটা বড় অংশ, ৪ কোটি ৬৫ লক্ষ ৫০ হাজার ৭১২ টাকা পিনকন গ্রুপ থেকে নিয়েছিল কৌস্তভ রায়। মূলত, তাঁর মিডিয়া সংস্থায় বিজ্ঞাপন বাবদ এই টাকা নেওয়া হয়েছিল বলে কৌস্তভ রায় দাবি করলেও তদন্তকারী সংস্থার কাছে কোন নথি হাজির করতে পারেননি। বারেবারে সেই নথি তলব করেছিল ইডি।
তৃণমূল ঘনিষ্ঠ এই প্রতারককে এর আগেও একাধিকবার তলব করা হয়েছিল। সোমবার তাঁকে সকালে তলব করা হয়। যদিও তিনি ব্যস্ত থাকার কথা জানিয়ে বিকালে হাজিরা দেন ইডি দপ্তরে। এরপর শুরু হয় ম্যারাথন জেরা। ইডি সূত্রে জানা যায়, তাঁকে একাধিক নথি নিয়ে হাজিরা দিতে বলা হয়েছিল। তাঁর কোম্পানির আয় ব্যয়ের হিসাবও চাওয়া হয়েছিল। যদিও পিনকন গ্রুপের সঙ্গে তাঁর আর্থিক লেনদেনের কোনও নথি পেশ করতে পারেননি কৌস্তভ রায়। জেরা প্রক্রিয়াতেও অসহযোগিতা শুরু করেন। অবশেষে রাত ১টা ৫মিনিট নাগাদ তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়।
ইডির দাবি, চিট ফান্ড কাণ্ডে মানি লন্ডারিংয়ের নির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে এই ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে। প্রিভেনশন অব মানি লন্ডারিং অ্যাক্টের (পিএমএলএ) ১৯(১) ধারায় কৌস্তভ রায়কে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানানো হয়েছে ইডির তরফে। ২০১৭ সালে খেজুরি থানায় পিনকন গ্রুপের বিরুদ্ধে দায়ের করা এফআইআর’কে ধরেই চিটফান্ড কাণ্ডে এই সংস্থার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছিল ইডি।
এদিন ব্যাঙ্কশাল কোর্টে ইডির বিশেষ এজলাসে ধৃত কৌস্তভ রায়কে পেশ করে তাঁর ১৪ দিনের হেপাজতের আবেদন জানায় ইডি। ‌আইনজীবীরা থাকলেও এদিন তাঁর পক্ষে নিজেই সওয়াল করেন কৌস্তভ রায়। আদালত তাঁকে ১০দিন ইডি হেপাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছে। আদালতে দায়ের করা লিখিত রিমান্ড রিপোর্টে ইডি জানায়, ২০০৯ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত পিনকন গ্রুপের সঙ্গে কৌস্তভ রায়ের তিনটি সংস্থার মধ্যে ৪ কোটি ৬৫ লক্ষ টাকার লেনদেন হয়েছে। তারমধ্যে এখনও পর্যন্ত আড়াই কোটির বেশি টাকা আরপি গ্রুপের কাছে বকেয়া রয়েছে চিট ফান্ড সংস্থা পিনকন গ্রুপের। 
জেরায় সোমবার রাতে কার্যত তা স্বীকারও করেছেন কৌস্তুভ রায়। জেরায় ধৃত এই ব্যবসায়ী জানান, তাঁর সঙ্গে পিনকন গ্রুপের কর্ণধার মনোরঞ্জন রায়ের ব্যবসায়িক লেনদেন ছিল। মনোরঞ্জন রায় তাঁকে নগদে এবং ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা দিয়েছিলেন। মূলত তাঁর মিডিয়া বিজ্ঞাপন সংক্রান্ত। যদিও সেই বিজ্ঞাপনের নথি দেখাতে পারেননি তিনি। এদিন ইডি আদালতে জানায়, ধৃত ব্যক্তি খুবই প্রভাবশালী, সরকার ও শাসক দলের শীর্ষ মহলের সঙ্গে তাঁর যোগ রয়েছে। এহেন ব্যক্তি এখন বাইরে থাকলে তদন্তের তথ্য প্রমাণ নষ্ট হবে।
গত বছর ১৮ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে বাড়িতে পুলিশি হানায় খুন হয়েছিলেন আনিস খান। দুদিন বাদে ২১ ফেব্রুয়ারি রাতে ‘মুখ্যমন্ত্রীর পিএ’ পরিচয় দিয়েই এই কৌস্তভ রায় গিয়ছিলেন নিহত ছাত্রনেতার পরিবারকে কিনতে! সরাসরি আনিস খানের বাবাকে টাকার লোভ ও চাকরির প্রলোভন দেখানো হয়েছিল। পরে ক্যামেরার সামনেই তা জানিয়েছেন খুন হওয়া আনিস খানের বাবা সালেম খান। 
‘কলকাতা টিভি’র কর্ণধার নিজে ‘মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিনিধি’ হয়ে বিরাট পুলিশবাহিনী নিয়ে মধ্যরাতে গেছেন নিহত ছাত্রনেতার পরিবারকে কিনতে! বাংলার সাংবাদিকতার দীর্ঘ ইতিহাস, ঐতিহ্যের সঙ্গেও চরম বেমানান এই ছবি। 
এরপর গত মে মাসে এগরায় তৃণমূল নেতা ভানু বাগের বোমা কারখানায় বিস্ফোরণের ঘটনার একদিন পরেই রাতের অন্ধকারে তাঁকে গ্রামে দেখা যায়, পুলিশি নিরাপত্তায়। একাংশের ক্ষুব্ধ গ্রামবাসীদের ম্যানেজ করার দায়িত্ব বর্তেছিল তাঁর ওপর। এই খবর গণশক্তিতে প্রকাশিত হওয়ায় মামলার হুমকি দিয়ে চিঠিও দিয়েছিলেন ধৃত কৌস্তভ রায়। 
এই প্রতারকই মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ বৃত্তে রয়েছেন দীর্ঘ কয়েকবছর ধরে।
যদিও আবার কয়েক বছর আগেই তিনি গ্রেট ইস্টার্ন হোটেল সংলগ্ন এলাকা থেকে গ্রেপ্তার  হয়েছিলেন। দিল্লিতে চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের একটি  প্রতারণা মামলায় কৌস্তুভ রায়কে গ্রেপ্তারির নির্দেশ দিয়েছিল। তার ভিত্তিতে দিল্লি পুলিশের গোয়েন্দা দল কলকাতায় এসে অভিযান চালালেও সেই সময় পালিয়ে যান কৌস্তভ রায়। তারপরেই দিল্লি পুলিশ আদালতে আবেদন জানায়। তার ভিত্তিতে আদালত কলকাতা পুলিশকে নির্দেশ দেয় এই ব্যবসায়ী আরপি গ্রুপ্রের চেয়ারম্যান কৌস্তুভ রায়কে গ্রেপ্তার করার।
 

Comments :0

Login to leave a comment