Post Editorial on village

গ্রামে অবাধ লুটের বিরুদ্ধেই এই ক্ষোভ

সম্পাদকীয় বিভাগ

এক অর্থে ছাপোষা মানুষ। পুজো-আচ্চা করে দিনযাপন করে তাঁর সংসার চলে। বাড়ি আছে। তবে কাঁচা নয়। বহুকালের জীর্ণ ভাঙাচোরা এক বাড়ি। এমনই এক গ্রামের মানুষের আবাস যোজনায় ঘরের অগ্রাধিকার তালিকায় নাম ছিল ৮ নম্বরে।
সেই নাম কেন থাকবে, অভিযোগ জমা পড়ে বিডিও’র কাছে। তদন্তে যান পঞ্চায়েত কর্মচারী। পলেস্তারা কবেই খসে গেছে দেওয়াল থেকে। কোনোরকমে দাঁত বার করে আছে চুন-সুরকির ইটের দেওয়াল। আইন অনুযায়ী ঘর পাওয়ার কথা নয়। তদন্তে বাতিল হয়ে যায় ঘর প্রাপ্তি। 
কাহিনীর শেষ এখানেই নয়। যাঁর ঘর বাতিল করা হলো, তিনি পঞ্চায়েতের তৃণমূল সদস্য। বাতিল হওয়ার খবর শুনে মিনমিনে গলায় পঞ্চায়েতের তদন্তকারী কর্মচারীর কাছে ঘর যাতে পাওয়া যায়, তার দরবারও করেছিলেন। কিন্তু হয়নি। 
এরপরই আসল কাহিনীর শুরু। তৃণমূল কংগ্রেসের সদস্য পঞ্চায়েত সদস্যের ঘরটা যাতে পাওয়া যায় তার জন্য পঞ্চায়েত অফিসে এসে সওয়াল করেন গ্রামেরই এক মান্য ব্যক্তি। কথায় কথায় তখনই জানা যায়, বিডিও অফিসে ঘর বাতিলের যিনি আবেদনকারী ব্যক্তি তিনি শাসকদলেরই এলাকার দাপুটে নেতা। ব্লক প্রশাসনে তাঁর প্রভাব বিস্তর। ঘর বাতিলের আবেদন সফল হওয়ার পর ওই প্রভাবশালী নেতাই নিজের দলের পঞ্চায়েত সদস্যকে জানিয়েছিল, আবেদন তুলে নেবে। তবে শর্ত একটাই। ঘরের টাকা পাওয়ার পর ৪০হাজার টাকা তার হাতে দিতে হবে! 
এটাই তৃণমূল কংগ্রেস। আবাস বিক্ষোভে ঘর পাওয়ার বিরোধিতা করে অভিযোগ করা যাবে, এমন সরকারি নির্দেশ ঘিরে রাজ্য যখন তোলপাড় তার ফাঁক দিয়েও কাটমানির টাকা তুলে নিতে তৎপর তৃণমূল। বাদ যাচ্ছে না নিজের দলের তুলনামূলকভাবে সৎ ব্যতিক্রমী সদস্যও।   
রাজ্যজুড়ে গ্রামীণ জনতার ক্ষোভের আঁচ এখন ঘরে আটকে নেই। রাস্তায় আছড়ে পড়েছে। ফি দিন বিক্ষোভ হচ্ছে পঞ্চায়েত দপ্তরে। ক্ষোভের আগুনে পুড়ছে তৃণমূল পঞ্চায়েত সদস্যের বাড়ি। সদস্যদের নিয়ে একজোট হয়ে ক্ষোভ থেকে বাঁচতে গণইস্তফা দিতে হয়েছে তৃণমূল পরিচালিত গোটা পঞ্চায়েতকে। এই ক্ষোভ কি শুধু গরিব মানুষের ঘর না পাওয়ার জন্যই?
গণঅসন্তোষ যে দানা বাঁধবে তা আগাম জানতেন রাজ্য প্রশাসনের শীর্ষকর্তারা। তাই গত ৬ ডিসেম্বর নবান্ন থেকেই জেলা শাসকদের হুঁশিয়ার করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সামাল দেওয়া যায়নি। বছর শেষের দিনগুলিতেও মানুষের ক্ষোভ আছড়ে পড়ছে পথে। আসলে এই ক্ষোভ শুধু ঘরের নয়। গত এক দশকে এরাজ্যের পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে সামনে রেখে বিপুল পরিমাণ লুটের বিরুদ্ধে মানুষের এই গণক্ষোভ। আবাস যোজনার দুর্নীতি সেই ক্ষোভের আগুনে ঘি ঢেলেছে মাত্র।
গত এক বছর ধরে ১০০দিনের কাজ নেই। গত ডিসেম্বর থেকে কাজ করে মজুরির টাকা পায়নি মানুষ। কোভিড মানুষের জীবন যন্ত্রণাকে আরও কয়েক গুণ খাদের কিনারায় ঠেলে দিয়েছে। কাজ হারিয়ে ঘরে ফিরেছে গ্রামীণ পরিযায়ী শ্রমিকরা। কাজ চলে গেছে। মজুরিতে টান পড়েছে। আর উলটোদিকে সম্পদের পাহাড়ে বসেছে তৃণমূল নেতারা। পঞ্চায়েত প্রধান থেকে উপপ্রধান, দলীয় পদে থাকা নেতারা। ফি দিন দুর্নীতির টাকায় ফুলে ফেঁপে ওঠা নেতাদের দেখেছেন গ্রামের মানুষ। আগে প্রধান, উপপ্রধানদের সাইকেল নিয়ে পঞ্চায়েতে আসতে দেখেছে মানুষ। বামফ্রন্ট সরকারের আমলের কথা নয়। হাল আমলেও সাইকেল নিয়ে, হাতে ফোন বলতে আদ্যিকালের মোবাইল নিয়ে সদস্যরা আসতো পঞ্চায়েত অফিসে। 
আর সেই প্রধান এখন চার চাকার গাড়ির সওয়ারি হয়ে আসেন পঞ্চায়েত অফিসে। সদস্যরা আসেন বাইকে। হাতে আইফোন। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া গ্রামের গরিব স্রেফ আতঙ্কে মুখ খুলতে পারেননি। আবাস যোজনার সমীক্ষা পর্বে সেই বাঁধ ভেঙে গেছে। 
২০১৮সালে এরাজ্যে পঞ্চায়েত ভোটের ঠিক আগেই আবাস যোজনার যোগ্য তালিকা তৈরির সময় সমীক্ষা হয়েছিল। কারা ঘর পাবে, সেই সমীক্ষার কাজ করানো হয়েছিল। ভিআরপি, ঠিকায় নিযুক্ত কর্মীদের দিয়ে সমীক্ষা করানো হলেও শেষ পর্যন্ত সমীক্ষায় শেষ কথা বলেছিল এলাকার তৃণমূল নেতারা। ফলে পাঁচ বছর আগে সেই সমীক্ষাতেও ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল অযোগ্যদের নাম। পাকা বাড়ি, মোজাইক করা মেঝে, মার্বেল করা প্যালেসের মালিকের নামও ছিল তালিকায়। আসল লক্ষ্য ছিল, টাকা এলে ভাগাভাগি করে ভাগ করে নেওয়া। আর গরিব মানুষকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া ছিল, ভোট দিলে মিলবে ঘর।
২০১৯সালের লোকসভা ভোটেও দেওয়া হয়েছিল আবাস যোজনার ঘরের প্রতিশ্রুতি। এমনকি ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটের আগেও ছিল, আবাস যোজনার টাকা আসা শুধু সময়ের অপেক্ষা। এলেই মিলবে ঘর। তার আগে ভোট দিতে হবে তৃণমূলকেই। এর মধ্যে ২০১৯সালে লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূলের ১৮টি আসন বিজেপি’র জয়লাভের পর গ্রামে একদফা অশান্তির আগুন জ্বলেছিল। ওই সময় প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার টাকা লুটের বিরুদ্ধে গ্রামে সভা বসিয়ে তৃণমূল নেতাদের কাছ থেকে টাকা ফেরত নেওয়ার ঘটনা ঘটেছিল। সেই টাকা ছিল ২০১৮সালের আগের আবাস যোজনার টাকা। 
কোভিড পর্বে থমকে যায় অর্থনীতি। লকডাউনে বন্ধ হয়ে যায় প্রকল্পের গতি। ২০১৮সালে যে গরিবের নাম ছিল তালিকায় তাঁরাও মাথার ওপর ছাদের নিশ্চয়তা হারিয়ে কেউ চড়া সুদে ঋণ নিয়ে, কেউ বা পরিবারের সোনাদানা সম্পদ বন্ধক রেখে ঘর তৈরির টাকা জোগাড় করে নেয়। এখন সমীক্ষায় সেই গরিব মানুষকেই বাদ দেওয়া হচ্ছে। তারা মানবে কেন? 
রাজ্যজুড়ে আবাস যোজনার বিক্ষোভের আসল মুখ হচ্ছেন এঁরাই। একদিকে গ্রামের গরিব। যাঁদের মাথায় ন্যূনতম ছাদ নেই। আদিবাসী পাড়া, বাউরি পাড়ার তফসিলি এলাকার নিরন্ন মানুষ। যোগ্যতার সব মাপকাঠি পূরণ করার পরও বাদ দেওয়া হয়েছে। কিংবা যোগ্য হিসাবে বিবেচিত হয়ে থাকার পরও গত দু-তিন বছরে ঘরের টাকা না আসায় ধার দেনা করে কোনোরকমে বাঁচার জন্য দু’দিকে পাকা ইটের দেওয়াল তুলে নিয়েছেন, তাঁরাই এখন অযোগ্যের তালিকায়। তাঁরা তাই রাস্তায়। এখানেও সেই ক্ষোভ আসলে তৃণমূল শাসনের লুটেরাদের দিকেই। সব খুইয়ে দুটো পাকা ইটের গাঁথুনি দিয়ে আমরা বাদ, আর সম্পদের পাহাড় গড়ে প্রধান বহাল তবিয়তে কী করে? সেই মানুষ রাস্তায় নেমে প্রতিবাদে।

এরাজ্যে পঞ্চায়েত ব্যবস্থার গণতন্ত্রকে সুরক্ষিত রাখার জন্য মানুষের অংশগ্রহণকে আরও নিশ্চিত করার পথ ছিল গ্রাম সংসদ। যে সভা থেকে গ্রামের মানুষ চিহ্নিত করতে পারতেন কারা হবেন প্রকৃত আবাস পাওয়ার জন্য উপযুক্ত। গ্রামসভার বৈঠক থেকে তৈরি হতে পারত অগ্রাধিকার তালিকা। কিন্তু গত এক দশকে সেসব উধাও। যে রাজ্যে পঞ্চায়েত সদস্যরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে অভ্যস্ত, তারা কীভাবে সুরক্ষিত করবে মানুষের অংশগ্রহণের গণতন্ত্রকে? তাই আবাস যোজনা নিয়ে গ্রামসভার নিদান থাকলেও কোথাও হয়নি। হয়নি বললে ভুল হবে। যে গ্রামসভা হয়েছে সেটাও লোক দেখানো। ভুয়ো। গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রকের পোর্টালে আপলোড করার জন্য কাগজেকলমে দেখানো হয়েছে গ্রামসভার বৈঠক। আবার যেখানে বৈঠকের আয়োজন হয়েছে সেখানে গ্রামের মানুষ নয়, সভা ভন্ডুল হয়েছে তৃণমূল কংগ্রেসের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে। 
তাই পুলিশ এখানে তদন্তে নামে আবাস যোজনার ঘর পাওয়ার যোগ্য কারা। গ্রামসভার বৈঠকে পুলিশ এসে দাঁড়িয়ে থাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার তাগিদে। মানুষের ওপর ভরসা হারিয়ে এরাজ্যের গ্রামীণ স্বায়ত্তশাসন এখন বেয়নেট নির্ভর। 


আগামী মার্চের মধ্যে ১১লক্ষ ঘরের অনুমোদন দেওয়ার কথা। সেই অনুমোদন দিতে হবে ৩১ডিসেম্বরের মধ্যে। কারা পাচ্ছে ঘর তার তালিকা প্রকাশ্যে টাঙিয়ে রাখার কথা। কিন্তু কেউ জানতে পারবে না শেষ পর্যন্ত কাদের নাম অনুমোদিত হলো। রাজ্য সরকারের তাড়া আছে। কারণ, কেন্দ্রের কাছে দুর্নীতি কবুল করে, শিরদাঁড়া বেঁকিয়ে ঘরের ৮হাজার ২০০কোটি টাকা এসেছে। হকের টাকা বলার সাহস নেই মমতা ব্যানার্জির। টাকা দেওয়ার শর্ত মানতে গিয়ে নবান্ন থেকে মুখ্যসচিবকে মুচলেকা পর্যন্ত দিয়ে বলতে হয়েছে, কোনোভাবেই প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার নামকে পরিবর্তন করে বাংলা আবাস যোজনা করা হবে না। কেন্দ্রের প্রতিটি নির্দেশ পালন করার লিখিত মুচলেকা দেওয়ার পরই রাজ্যে এসেছে টাকা।


চার দশক আগে এরাজ্যের পঞ্চায়েত ব্যবস্থা গোটা দেশকে পথ দেখিয়েছিল। এক দশকে সেই পঞ্চায়েতে মানুষ এখন পণ্য। লুটের হাতিয়ার। উপভোক্তা সাজিয়ে কাটমানি আদায়ের যন্ত্র। আশার কথা, এবারই প্রথম সেই লুটের বিরুদ্ধে ক্ষোভ নেমেছে রাস্তায়।
ঘরের দাবিতে ক্ষোভ আসলে শাসকের লাগামছাড়া দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ট্রিগার।

Comments :0

Login to leave a comment