Spare Sports

রঙরূপের স্পেয়ার স্পার্টস এই সময়ের দলিল নাটক

রাজ্য

Spare Sports

ঋত্বিক ঘটক দেশভাগ জনিত কারণে ছিন্নমূল মানুষের সমস্যা লিপিবদ্ধ করেছিলেন ‘দলিল’ নাটকে। ১৯৫২ সালে যখন এই নাটকটি ঋত্বিক লেখেন এবং তার পরবর্তী সময় থেকে এখন পর্যন্ত এই ছিন্নমূল মানুষের সমস্যার সঠিক সমাধান হয়নি। বরং সারা বিশ্বজুড়েই শরণার্থীদের সমস্যা মূলত একই। স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পরেও ছিন্নমূল মানুষের যন্ত্রণার শরীক বাংলা নাটক। এমনই এক ছিন্নমূল মানুষের স্বপ্ন, উচ্চাশা আর ক্ষমতার অন্দরে তার রূপকে খুঁজে পাওয়া যায় রঙরূপ প্রযোজিত সাম্প্রতিক নাটক ‘ স্পেয়ার পার্টস’ –এ। স্বপ্নময় চক্রবর্তী এই সময়ে দাঁড়িয়ে ‘স্পেয়ার পার্টস’ যখন লেখেন তখন আমাদের দেশের মানচিত্রে অনেক রাজনৈতিক পালাবদল ঘটে গেছে। কিন্তু দেশ বিক্রির চক্রান্তকারীদের বিরুদ্ধে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সোচ্চারে সেকথা বলার হিম্মত কারও দেখা যায়নি।


নাটক সময়ের দর্পন। আর সেই দর্পনে ধরা পড়েছে কেন্দ্র রাজ্যের বেলাগাম দুর্নীতি আর ক্ষমতার দুরবৃত্তায়ন। মানবদেহের প্রয়োজনীয় অঙ্গগুলি যদি অতিরিক্ত সুখের আশায় বিক্রি হয়ে যায় তাহলে মানুষের বেঁচে থাকার অর্থ পালটে যেতে বাধ্য। অন্যদিকে দেশের সম্পদ যদি বিক্রি হয়ে যায় সেক্ষেত্রে দেশের সার্বভৌম চরিত্র, অর্থনৈতিক বুনিয়াদ ভেঙে পড়তে বাধ্য। বর্তমান সময়ে নাট্যকার যা দেখছেন আর যেভাবে দেখছেন তার সঙ্গে দেশের অধিকাংশ মানুষের দেখার মধ্যে কোন অমিল নেই। এখানেই স্পেয়ার পার্টসের অন্তর্নিহিত শক্তি বিরাজ করছে। কিডনি, হার্ট, চোখ, কান, কণ্ঠের মতনই ইস্পাত, বিমা, বন্দর, রেল, ব্যাঙ্ক তথা যা কিছু রাষ্ট্রায়ত্ব শিল্প সবই দেশ ও দশের জন্য প্রয়োজনীয়। উদারনীতির হাত ধরে এসবই বেঁচে দেওয়ার চক্রান্ত চলছে।

 

 


নির্দেশক সীমা মুখোপাধ্যায় সময়ের অলিন্দে দাঁড়িয়ে দেশ বিক্রির বিরুদ্ধে মানুষের সংগ্রামের রেখাচিত্র স্পেয়ার স্পার্টস নাটকে মেলে ধরেছেন। শুধু দেশ বিক্রিই নয় রাজ্যে রাজনৈতিক পালাবদলের পর যে স্বৈরাচারী শক্তি মানুষের মৌলিক অধিকারগুলি কণ্ঠরোধ করে ধ্বংস করতে সচেষ্ট, রাজনৈতিক অঙ্গণে রঙবদের যে সুবিধাবাদী নীতি তার বিরুদ্ধে মানুষের চেতনাকে জাগ্রত করতে অত্যন্ত মুন্সিয়ানার সঙ্গে খুব সাধারণ একটি গল্পের মোড়কে প্রতিবাদ ধ্বনিত করেছেন।
সাম্প্রতিক সময়ের রাজনীতি, অর্থনীতি, শিল্প-সংস্কৃতি, দর্শন নিয়ে কথা বলার বাংলা নাটকের যে ঐতিহ্য, সেই ধারাতে নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্রে একজন সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ মধু বসাকের কথা বলেছেন। আবার ক্ষমতার অধিকারী হয়ে এই মধু বসাকের যে রূপ নাটকে ডানা মেলেছে, তার ভয়াবহতা দেখে শিউড়ে উঠতে হয়। 

 

বুদ্ধি আর সংগ্রামকে কাজে লাগিয়ে একজন সাধারণ মানুষ থেকে মধু আজ ক্ষমতার শীর্ষে অবস্থান করছে। ক্ষমতা অর্থ আর সামাজিক সম্মান ধরে রাখতে ক্রমশ তার মনুষ্যত্ব বিকিয়ে যেতে থাকে। লোভ লালসা ব্যভিচারে জীর্ন হতে থাকে তার জীবন। একদিকে ক্ষমতা অর্থ অন্যদিকে সব হারানো মানুষের যন্ত্রণা ছবি নাটকের ক্যানভাসে রঙরূপের নির্দেশক সুনিপুনভাবে এঁকেছেন।
মধুর মতন মানবঅঙ্গের ব্যবসায়ীরা কিভাবে ধীরে ধীরে ক্ষমতার সোপান বেয়ে রাজনীতির ছত্রধর হয়ে ওঠে সে দৃশ্য তো আমরা প্রতিদিনের সমাজ জীবনে দেখছি। কিন্তু তাকে নাটকে রূপাবণ করা সহজ কাজ নয়। সেই কাজটাই করে দেখিয়েছে রঙরূপের শিল্পীরা। মধু বসাকের মতন গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে কমল চট্টোপাধ্যায় অভিনয়ের সৃজনীশক্তি দিয়ে উপস্থিত করেছেন। 

 

 

শুধু তাই নয় সহশিল্পীদের সঙ্গে তার বোঝাপড়া মনে রাখার মতন। রবীন্দ্রনাথের ‘তাসের দেশ’ নাটকের চরিত্রের মতন অন্যান্য চরিত্রগুলি সাংকেতিক। অভিনয়ে অনন্য শঙ্কর দেবভূতি, অপূর্বকুমার সাহা, অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়, আর্য সেন, দেবব্রত ঘোষ, অনুভব মুখোপাধ্যায়, কুনাল সাহা, প্রজ্বল হালদার, ঋত চট্টোপাধ্যায়, স্নিগ্ধভাষ কাঁড়ার, প্রিয়াঙ্কা তালুকদার, আরাত্রিকা মুখোপাধ্যায়, পৌলমী তালুকদার, রিমি চক্রবর্তী, বিজিতা রায়রা প্রতিটি দৃশ্যপটে নিজেদের বুদ্ধি ও মেধার সংমিশ্রনে অভিনয়ের সাক্ষর রেখেছেন। বাদল দাসের আলোর জাদুতে, অসীম জানা ও দেবব্রত ঘোষের মঞ্চ পরিকল্পনা এবং অনুভব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গীত ভাবনায় রঙরূপের ‘স্পেয়ার স্পার্টস’ এই সময়ের প্রয়োজনীয় দলিল নাটক হয়ে উঠেছে। যে নাটক সময়কে চিহ্নিত করতে মানুষকে ভাবাবে।
 

Comments :0

Login to leave a comment