বেড়িয়ে ঘুরে: মেঘে ঢাকা ‘তাহারা’ শেষ পর্ব

বিশেষ বিভাগ

(গতকালের পর) 

ফালুট

বেড়াতে গেলে যা হয়। আড্ডা ছাড়া বাঙালী- সেই পুরান থেকে শুরু করে টেনিদা পর্যন্ত- কল্পনাতীত! তাছাড়া রাত ৮.৩০-এর মধ্যে নৈশাহার সেরে বিছানায় যাওয়ার বান্দা আর যারাই হোক- বাঙালী জাতি নয়। কিন্তু পাহাড়ে এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে মারাত্মক। কতটা মারাত্মক তা পরের দিন ভোরবেলায় টের পাওয়া গেল। ঘড়ি ধরে সকাল আটটার সময় হাজির গাড়ির চালকেরা। অথচ আমাদের তখন সবে মধ্যরাত্রী। একসময় তাদের চিলচিৎকার এবং গাড়ি নিয়ে চলে যাওয়ার ‘হুমকি’তে নাজেহাল হয়ে কোনোরকমে নাওয়া (পড়ুন মুখ ধোয়া) খাওয়াটুকু সেরে প্রায় সাড়ে এগারোটা নাগাদ বেরোলাম ফালুটের উদ্দেশ্যে। সবার মনেই একটা চাপা উত্তেজনা। আলো আঁধারি আঁকাবাঁকা উঁচুনিচু পাহাড়ি রাস্তা কোথাও সটান নিচে নেমে গেছেকোথাও আবার দুম করে ওপরে উঠে গেছে। উত্তরপূ্র্বে উঁচু বরফাবৃত পাহাড়ে মাথায় সূর্যদেব ডানা মেলছেন। 

সবরগ্রাম

চলন্ত গাড়ির মধ্যে থেকেই ফুসফুস ভরে ভোরের ঠান্ডা হাওয়া আর শেষ রাতের নিথর রিক্ত পাহাড়ি বনের গন্ধ নিতে নিতে এগিয়ে চলা পাহাড়ের বুক চিরে। ঠান্ডায় কালো ও কুঁকড়ে যাওয়া পাতা খসখস শব্দ চাকার নিচে। পালক ফুলিয়ে ঘুমিয়ে থাকা রঙবাহারি পাখি- পাহাড় পাহাড় আমেজ অবশেষে। চারিদিকে নেড়া পাহাড়চূড়ায় বরফ ঢাকা। 

জিটিএ ট্রেকার্স হাট

 

তুষারপাত নেইকিন্তু কনকনে ঠান্ডা হাওয়া ধারালো সূঁচের মতো বিদ্ধ করবে চামড়াযদি ঠিকমতো শীত পোশাক না থাকে গায়ে। হিমালয় পর্বতের কোলে অবস্থিত সুদৃশ্য ফালুট সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১১ হাজার ৭৯০ ফুট উঁচুতে অবস্থিত। মেঘ না থাকলে একই সাথে কাঞ্চনজঙ্ঘা এবং এভারেস্ট- দুই’ই দেখা যায়। 

ভিউ পয়েন্ট থেকে

নভেম্বর থেকে মে মাসের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত এলাকাটি পুরোপুরি বরফাবৃত থাকে। নীল আকাশনীল জলপেঁজা তুলোর মতো বরফ ঢাকা পাহাড়বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো ইতস্তত ছড়িয়ে থাকা ছোটবড় পাথর- সব মিলিয়ে ফালুট এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। সান্দাকফুর হোটেলে ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় ৮টা বাজল। হোটেলটা পাহাড়ের খাঁজে অবস্থিত। মেঘের আলখাল্লা একেবারে নেমে এসছে ভূপৃষ্ঠে। একটা নতুন গন্ধ আসছে। পাহাড়ি কোনও গাছের পাতা জ্বালিয়ে স্থানীয়রা সন্ধ্যার ধূপের মতো ব্যবহার করে। 

ফালুট থেকে সূর্যাস্ত

 পরের দিন মিরিক হয়ে নিউ জলপাইগুড়ি। এখান থেকে বেরিয়ে ঘণ্টা খানেক এগোনোর পর শুরু ঘন পাইন বন এবং চা বাগানের সারি। মেঘের চাদরে ঢাকা। দেখে মনে হবে দু’দিকের পাহাড় জুড়ে কেউ বা কারা ধূপ ছড়িয়ে দিয়ে গেছে। আঁকাবাকা পাহাড়ি রাস্তার ধার ঘেঁষে খানিক পরপর ছুটে যাচ্ছে স্থানীয় ট্যাক্সি। কাছেই গোপালধারা টি-এস্টেট। স্থানীয় চা শ্রমিকরা চা বিক্রি করছেন। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে পাহাড়ের ওপর থেকে নিচের জনবসতির দিকে তাকালে মনে হবে হাজার হাজার হীরের কুঁচি ছড়িয়ে রেখেছে কারা। অবশেষে এনজিপি স্টেশন। ট্রেনে উঠে রাতের খাওয়ার শেষে যে যার বার্থ-এ ঘুমোতে চলে যাওয়া। রওনা কলকাতার উদ্দেশ্যে। ফিরে যেতে হবে আবার সেই গতে বাঁধা জীবনে।

 

পোস্ট স্ক্রিপ্ট

বৈশ্বিক মহামারী পেরিয়ে কতটা স্বাভাবিক ছন্দে ফিরেছে পাহাড়ি মানুষের জীবন? ছোট্ট এই উপত্যকায় এক রাশ বিষন্নতা এখনও বহমান। যেন অনেকটা শূণ্যতা পাঁজরে বয়ে চলেছেন এখানকার মানুষ। অচিরেই জানা হল পর্যটন ব্যাতীত অন্য কোনো রুটিরুজির বালাই নেই এখানকার ‘কেয়ারটেকারদের’। সরকারি প্রকল্পের কথা পারতেই বিদ্রুপ ঝরে পড়ে এরকমই এক ‘কেয়ারটেকারের’ গলায়, ‘‘ইতনা ইতনা দে রহা হে দিদি কে রাখনে কী জাগা হি নেহি হে...স্কুল কলেজ হাসপাতাল...লক্ষ্মী কা ভান্ডার...কিষান সাথী...খাদ্য সাথী...পয়সা রাখনে কী জাগা নেহি হে...ইতনা জাদা হো গ্যায়া হে কে দিদি কো বোল রহে হে থোড়া সা পাড়োসান নেপালকো কো ভি দে দিজিয়ে’’। প্রথমে বুঝতে না পারলেও খানিকক্ষণ বাদেই ক্ষোভে ফুঁসে ওঠেন ‘কেয়ারটেকার’।  

পর্যটকরা এলে কিছু ‘টিপস’ মেলে, মেলে হোটেলের থেকে কিছু টাকা। অন্যথায় বছরের বাকি সময়টুকু চলে জঙ্গল থেকে ‘লকড়ি’ কেটে এনে হোটেলগুলিতে বিক্রি করে কিছু কামাই। এখানকার ট্রেক ‘গাইড’দেরও অবস্থা তথৈবচ। পর্যটক না থাকলে হোটেলগুলিতে ঝাড়াপোছা বা সেই জঙ্গল থেকে কাঠ কেটে এনে বিক্রি। সামান্য জ্বর হলেও  ২৬ কিমি পাহাড়ি পথ অতিক্রম করে ছুটে যেতে হয় দার্জিলিং। নেই কোনো স্বাস্থ্য কেন্দ্র। মানেভঞ্জং-এ যদিও কিছু আছে; তা যথেষ্ট নয়। ফলত চিকিৎসা করতে, ধার-দেনা করে হলেও, তাদের ভরসা হায়দরাবাদ। পর্যাপ্ত স্কুল-কলেজ নেই বলে ক্লাস ১১তেই লেখাপড়া ছেড়ে রাধুনীর কাজে হাত পাকিয়েছে সান্দাকফুর ‘রিঙ্গো’ (নাম পরিবর্তিত)। ‘‘দিদি কো যা কে বোলিয়ে হামলোগকো মাহিনে ভিখ কী মে ৫০০-১০০০ নেহি চাহিয়ে...কুছ পার্মটনেন্ট সোল্যুশন কিজিয়ে’’। চাকরি বাকরি কিছু হয়না এখানকার লোকজনের? ‘‘হা... হোতা হে না! সিভিক পুলিশ মে বহুত নৌকরি হুয়া হে...’’ কিন্তু ওগুলো তো সেই অর্থে চাকরি না, টেম্পোরারি! ‘‘ইয়েহি তো মজা হে সাব। ইয়ে সিভিক পুলিশ কৌন হে? টিএমসি কা ভাড়ে কা টাট্টু! ইলেকশন কি টাইম পে ইয়ে সব লোগ হি তো টিএমসিকা হোকে ভোট ‘করতে’ হে। বদলে মে কুছ ক্যাশ, একদিন কা খানা ওউর দারু মিলতা হে। আগার এয়সা কারনে সে মানা করতে হে তো ‘জব’ রিনিউয়াল রোখ দে তা হে দিদি কা পার্টি’’। পশ্চিমের পাহাড়ে কোলে টুপ করে ডুবে যায় সূর্য। চোখকে আরাম দেওয়া এই মনোরম দৃশ্য কার্যত বিষাদ লাগে। বাড়ি ফেরার তোড়জোড় শুরু করে ‘রিঙ্গো’। পাহাড়ি পথ হেঁটে অনেকটা নিচে, যেতে হবে বাড়ি। 

 

শেষ...

Comments :0

Login to leave a comment