‘রাম লালা’ সবার। আপামর ভারতবাসীর যাবতীয় সমস্যা আজ থেকে খতম! রাম মন্দির উদ্বোধনকালে গদগদ ঘোষণায় টপটপ করে চুঁইয়ে পড়ল ভক্তির টনিক। ‘রাম আপামর ভারতবাসীর’, প্রধানমন্ত্রীর এই দাবি কি রাম অবতার, স্বপ্না মধুকর এবং মহম্মদ উমরের মতো যাঁদের উচ্ছেদ করা হয়েছে তাঁদের যন্ত্রণার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ?
কারণ পুরনো শহরকে অবশ্যই 'নতুন অযোধ্যা'র জন্য পথ ছেড়ে দিতে হয়েছে, কারণ সেখানে একটি নতুন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, সাত তারা কমিউন, বিলাসবহুল হোটেল, মাল্টি-লেভেল পার্কিং কমপ্লেক্স এবং অন্যান্য সমস্ত পর্যটন পরিকাঠামো স্থাপিত হবে যা নিয়ে বাজারি মিডিয়া যারপরনাই উত্তেজনায় উচ্ছ্বসিত। কিন্তু তাদের নজর থেকে বাদ গেছে জমি হারানো মানুষের যন্ত্রণার কথা। অযোধ্যার ‘সংস্কার’ এবং ‘নতুন আজাদি’ হিসেবে নিজেকে জাহির করা এই রাজনৈতিক তৎপরতায় ধর্মমত নির্বিশেষে আস্তাকুঁড়ে ঠাই পেতে হয়েছে অসংখ্য দরিদ্র মানুষকে।
এদিনের ভাষণের নির্যাস এবং লক্ষ্য ছিল অযোধ্যার ঐতিহ্যবাহী জীবনযাত্রা, স্পন্দনশীল, প্রাচীন সংস্কৃতি যা শহরের শান্তিপূর্ণ সাম্প্রদায়িক সংহতির উত্তরাধিকার সংরক্ষণ করেছিল তা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করা। যে সাংস্কৃতিক সংহতি এবং সৌহার্দ্য উচ্চারণ করে গান্ধীজীর ‘রঘুপতি রাঘব রাজা রাম...ঈশ্বর আল্লাহ তেরো নাম’ তাকে নিশ্চিহ্ন করতেই আজকের ভাষণ।
পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীতে ভক্তি আন্দোলনের আবির্ভাবের সাথে রামচন্দ্র বাংলার ধর্মীয় মানচিত্রে আবির্ভূত হন, প্রধানত মহাপ্রভু চৈতন্যের নেতৃত্বে যিনি কৃষ্ণ ও রামকে ঈশ্বরের মানব অবতারের সর্বোচ্চ প্রকাশ হিসাবে উপাসনা করেছিলেন। পরবর্তী পাঁচ শতাব্দী ধরে, চৈতন্য নিজেই রামের চেয়ে বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে অনেক বেশি জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন, অন্যদিকে কৃষ্ণ রাজ্যের অন্যতম জনপ্রিয় দেবতা হিসাবে অব্যাহত থাকেন।
বিজেপি তথা সংঘের রাজনৈতিক ভাষ্যে ‘রাম’ চরিত্রের পরিচিত নমনীয়তা হারিয়ে ক্রুদ্ধ, হিংশ্র, পেশিবহুল, অতিমানবীয় চরিত্র। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের মৌলবাদী, আগ্রাসি বোঝপড়ার এক টাটকা নিদর্শন।
‘ঘরে ফিরলেন রাম’, বলেছেন প্রধানমন্তরী নিজে। যার অর্থ, মসজিদ ভাঙাকে বৈধতা দিচ্ছেন সরবে। সুপ্রিম কোর্টের শুনানিতে কোথাও প্রমাণিত হয়নি মন্দির ভেঙে গড়া হয়েছিল বাবরি মসজিদ। এই তথ্যকে ভাষণে ঢেকে দিচ্ছেন নরেন্দ্র মোদী।
তাঁর বিভিন্ন লেখায় গান্ধী একটি নিখুঁত রাষ্ট্রের ধারণা বর্ণনা করেছেন। ১৯২৯ সালে হিন্দ স্বরাজ পত্রিকায় তিনি লিখেছিলেন, ‘‘রামরাজ্য বলতে আমি হিন্দুরাজ বোঝাচ্ছি না। রামরাজ্য বলতে আমি ঈশ্বরের রাজ্য বুঝি। আমার কাছে রাম ও রহিম এক ও অভিন্ন দেবতা। আমি সত্য ও ধার্মিকতার একমাত্র ঈশ্বর ব্যতীত অন্য কোন ঈশ্বরকে স্বীকার করি না’’।
গান্ধীর "রামরাজ্য" শব্দটি এমন একটি সময়কাল, স্থান এবং সংস্কৃতির উদ্দীপনার কথা উচ্চারণ করে যেখানে সমস্ত নাগরিক ন্যায়বিচার পাবে এবং এমনকি রাজকীয় প্রজারাও - যারা নির্বাচিত গণতন্ত্রের নাগরিক নহলেও রাজাকে প্রশ্ন ও সমালোচনা করতে পারবে। গান্ধীর রামরাজ্য কার্যত ‘পরস্পর প্রীতি, সুখ, শান্তি এবং বিকেন্দ্রীভূত গণতন্ত্রের ধারণাকে লালন করে।
বিজেপি-আরএসএস-এর ‘রামরাজ্য’ আসলে সেই চিন্তার মৃত্যুঘণ্টা। ‘‘মন্দির ওহিঁ বানায়েঙ্গে’’ (মসজিদ যেখানে আগে ছিল ঠিক সেখানেই মন্দির তৈরি করলাম) এর মতো ভাষণ কার্যত ইতিহাসের প্রতিমুখে নির্লজ্জ বিজয়োল্লাস।
উত্তরপ্রদেশ সরকারের একটি বিজ্ঞাপনে পুরনো শহরের গৌরব পুনরুদ্ধারের কথা বলা হয়েছে। উচ্ছেদের শিকার সব অংশের কাছে এই বিজ্ঞাপন আসলে ‘বুলডোজার গণতন্ত্র’। উত্তরপ্রদেশ সরকারের বিজ্ঞাপনটি উপরে তালিকাভুক্ত সমস্ত অতিরিক্ত স্থান সহ অযোধ্যাকে একটি পর্যটন ‘স্বর্গে’ রূপান্তরিত করার দিকেই ইঙ্গিত করে। দেশের দ্রুততম সড়কপথ এবং ভ্রমণের সময় হ্রাসকে মুখ্য বিন্দু করা হচ্ছে প্রচারে। তাতে মানব উন্নয়নের যাবতীয় সূচক যদি বিশ্বে সর্বনিম্নও হয়, তাতেও কিছু যায় আসে যায় না বিজেপি এবং আরএসএস’র।
অযোধ্যা মাস্টার প্ল্যান ২০৩১-এ আগামী দশ বছরে ৮৫,০০০ কোটি টাকার পরিকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের কথা বলা হয়েছে। প্রশ্ন হল কোন ধরণের পরিকাঠামো? এবং কাদের অধিকার খর্বের বিনিময়ে? যারা তাদের বাড়ঘর হারিয়েছে বা ছোট ব্যবসাদার এবং দোকানদারদের রাস্তা চওড়া করার জন্য উচ্ছেদ হতে হয়েছে?
অযোধ্যার গোন্ডা, শ্রাবস্তী, বাহরাইচ এবং বারাবাঁকির মতো দরিদ্র প্রতিবেশী জেলাগুলির সাথে এই ‘বিকাশের’ কথা বিবেচনা করা জরুরি বলেই মনেকরছে বিভিন্ন অংশ।
Comments :0