Post editorial on RSS

দুরাত্মার ছল

সম্পাদকীয় বিভাগ


আরএসএস’র ভাঁড়ারে নেতার বড় আকাল। বল্লভভাই প্যাটেলকে বগলদাবা করেও কলকে মিলছে না। তাই এবার নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুকে নিয়ে টানাহ্যাঁচড়া শুরু করে দিয়েছেন সঙ্ঘকর্তা মোহন ভাগবত। জন্মের পর থেকে কোনোদিন নেতাজীর নামোচ্চারণ করেনি যে আরএসএস এবার হঠাৎ করে তাঁর জন্মদিন ঘটা করে উদ্‌যাপন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আর তার জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে কলকাতাকে। হিসাব একেবারে পাক্কা। নেতাজীকে নিয়ে বাংলা এবং বাঙালিদের আবেগ যেহেতু ব্যাপক। তাই সেই আবেগে খানিক ভাগ বসিয়ে রাজ‍‌নৈতিক ফায়দা তোলার সুচতুর কৌশল।
আসলে আরএসএস এমন একটি সংগঠন এবং তাদের রাজনৈতিক শাখা বিজেপি এমন একটি দল ভারতের ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে গর্ব করার মতো কিছু তাদের ভাঁড়ারে নেই। দু’শো বছর ব্যাপী ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং স্বাধীন-সার্বভৌম-ধর্মনিরপেক্ষ ভারত নির্মাণে তাদের কণামাত্র অবদান বা ভূমিকা নেই। বরং স্বাধীনতা সংগ্রামে ব্রিটিশদের দালালি করার বিস্তর নজির রয়েছে। পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়ে একটা দেশের নিজের পায়ে দাঁড়াবার পেছনে যাদের অনন্য অবদান থাকে তারাই দেশবাসীর মননে স্মরণীয় হয়ে থাকেন। ভারতে এমন স্মরণীয় মানুষের অভাব নেই। নেতাজী তাদেরই অগ্রগণ্য। কংগ্রেস, কমিউনিস্ট সহ বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে কমবেশি জড়িয়ে আছেন এইসব স্মরণীয় বরণীয় জাতীয় নায়করা। একমাত্র আরএসএস-বিজেপি’র ঘরে একজনও স্বাধীনতা সংগ্রামী নেই। একজন কলঙ্কিত নায়ক আছেন যাকে ঘিরে আরএসএস দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাবার চেষ্টা করে এবং তার ‘মহান’ কীর্তি প্রচার করার চেষ্টা করে। কিন্তু আদতে তিনি ছিলেন ব্রিটিশদের অনুকম্পাপ্রার্থী। সেলুলার জেলে বন্দী থাকলেও কোনও ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে অংশ না নেবার এবং ব্রিটিশদের সবরকম সাহায্য করার মুচলেখা দিয়ে মুক্তি পেয়েছিলেন। এহেন ব্যক্তিরা আর যাইহোক জাতীয় গৌরব বাড়ায় না। জাতি তাদেরকে নিয়ে গর্ব করে না।
এমতাবস্থায় অন্য শিবির থেকে নেতা ধার করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। অথবা অন্য শিবিরে অবস্থানকারী জাতীয় নায়কদের সঙ্গে নিজেদের সম্পর্ক দেখানোর কল্পিত গল্প বানানো ছাড়া উপায় নেই। ভারতে নিজেদের প্রাসঙ্গিকতা তুলে ধরতে আরএসএস এখন সেই চেষ্টাই প্রাণপণে করে যাচ্ছে। কলকাতায় ঘটা করে নেতাজীর জন্মদিন পালন সেই চেষ্টারই অঙ্গ। নেতাজীর সঙ্ঘযোগের হাস্যকর দাবি প্রমাণের জন্য বিবৃতি দিয়ে একটি বানানো গল্পও হাজির করা হয়েছে। নেতাজী নাকি আজাদ হিন্দ বাহিনীকে আরএসএস’র সঙ্গে মিশিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। গল্পের গোরু আকাশে উড়তে বাধা কোথায়! কিন্তু অর্বাচীনদের কে বোঝাবে নেতাজী ও আরএসএস’র অবস্থান সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে। আরএসএস দাঁড়িয়ে আছে হিন্দুত্ব নির্ভর উগ্র জাতীয়তাবাদী জমিতে। নেতাজী ধর্মনিরপেক্ষ ভারত ভাবনার দিশারী। নেতাজী শুধু রাজনৈতিক স্বাধীনতা চাননি, একই সঙ্গে চেয়েছে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা। চেয়েছেন সকল ধর্ম, বর্ণ, জাত, ভাষার এক উদার ভারত। আর এস এস’র ভাবনার ত্রিসীমানায় এসব নেই। ভারতবাসীকে এক এবং অভিন্ন চোখে দেখতেন নেতাজী। আরএসএস’র লক্ষ ধর্মীয় বিভাজন ও সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের মাধ্যমে বিভেদ-বিদ্বেষ-ঘৃণার বিস্তার ঘটানো।
এরপরও কেন নেতাজীকে দরকার আরএসএস’র ? বাংলায় রাজনৈতিক জমি পেতে হলে বাংলার হৃদয়ে অবস্থান করে এমন একজনকে দরকার। তারা খুঁজে নিয়েছে নেতাজীকে। কংগ্রেসের মূলস্রোতের সঙ্গে যাদের কিছুটা ভিন্নতা ছিল সঙ্ঘ চাইছে তাদের ব্যবহার করতে। এই লক্ষ্যে আগে প্যাটেলকে হাইজ্যাক করা হয়েছিল। এবার চাইছে নেতাজীকে। কিন্তু চাইলেই সবকিছু পাওয়া যায় ? নেতাজীকে পেতে হলে আগে নিজেদের বদলে নেতাজীর আদর্শ গ্রহণ করতে হবে। দাঁড়াতে হবে ধর্মবিরপেক্ষতার পক্ষে। গ্রহণ করতে হবে যুক্তিবাদী চিন্তা এবং বিজ্ঞান চেতনা। এর কোনও কিছুই আরএসএস’র ভাঁড়ার নেই।
 

Comments :0

Login to leave a comment