নারায়ণ কর
আগামী ১৬ ফেব্রুয়ারি ত্রিপুরায় বিধানসভার ৬০ আসনের জন্য নির্বাচন। এই নির্বাচনে বামফ্রন্ট এবং ভারতের জাতীয় কংগ্রেস আসন সমঝোতার ভিত্তিতে একযোগে লড়াই করছে। বামফ্রন্টের শরিক দলগুলো সব মিলিয়ে ৪৬টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। ১৩টি আসনে কংগ্রেসের প্রার্থীরা লড়ছেন। একটি আসনে বামফ্রন্ট এবং কংগ্রেস সমর্থিত নির্দল প্রার্থী ময়দানে রয়েছেন। ত্রিপুরা জনসংখ্যা, আয়তন, বিধানসভার আসন সংখ্যার হিসাবে গোটা দেশের তুলনায় একটি বিন্দুমাত্র। হয়তো চোখেও পড়ে না। কিন্তু ত্রিপুরার এই নির্বাচনের দিকে আজ গোটা দেশই তাকিয়ে আছে। কারণ এই নির্বাচন আসলে একা ত্রিপুরার নয়। এই নির্বাচনী লড়াই গোটা দেশের লড়াই। লড়াই ভারতের সংবিধান, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতাকে রক্ষা করার। লড়াই রাজ্যে আইনের শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতাসহ সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকারগুলো জনগণকে ফিরিয়ে দেবার। একই সঙ্গে গরিব, খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ, শ্রমিক,কৃষক, খেতমজুর, জুমিয়া, তফসিলি উপজাতি, তফসিলি জাতি, ধর্মীয় সংখ্যালঘু, ওবিসি নির্বিশেষে শিক্ষক, কর্মচারী, ছাত্র, যুব ও নারী সহ সব অংশের মানুষের জীবনে, রুজিরুটির ওপর যে চরম আক্রমণ নেমে এসেছে তা থেকে তাদের রক্ষা করারও লড়াই এবারের নির্বাচন।
২০১৮ সালে বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি-আইপিএফটি জোট বামফ্রন্টকে পরাজিত করে সরকার গঠন করেছিল। ৩ মার্চ নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর থেকে ত্রিপুরায় বিজেপি এক অভূতপূর্ব দুঃশাসন নামিয়ে এনেছে। এরা রাজ্যে একদলীয় স্বৈরশাসন কায়েমের লক্ষ্যে ফ্যাসিস্তসুলভ সন্ত্রাস চালাচ্ছে। গণতন্ত্র ধবংস করেছে। নাগরিক স্বাধীনতা হরণ করেছে। স্বাধীনভাবে ভোট দেবার অধিকার গায়ের জোরে ছিনিয়ে নিচ্ছে। এই সরকার আসার পর পঞ্চায়েত থেকে পৌরসংস্থা, লোকসভা থেকে বিধানসভার উপনির্বাচন - সমস্ত নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করা হয়েছে। সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা এরাজ্যে পদদলিত। সংখ্যালঘুদের ধর্মাচরণ ও সামাজিক অনুষ্ঠানের স্বাধীনতাও আক্রান্ত। উপজাতি এলাকা স্বশাসিত জেলা পরিষদকে শুকিয়ে মারার চেষ্টা হচ্ছে ৷ উপজাতি, তফসিলি, ওবিসি এবং সংখ্যালঘুদের অর্থনৈতিক অধিকার ও সুবিধা হরণ করেছে এরা। ত্রিপুরাকে নেশার সাগরে ডুবিয়ে রাখবার খেলায় মেতেছে। মা-বোনদের বিরুদ্ধে অপরাধ বাড়ছে। ত্রিপুরায় এরা জঙ্গলের শাসন কায়েম করেছে। দেশের সংবিধান এখানে কাজ করছে না।
অন্যদিকে ২০১৮-তে দেওয়া নিজেদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিকে বিজেপি প্রহসন ও মিথ্যায় প্রতিপন্ন করেছে। মানুষের কাঁধে প্রতিনিয়ত কর ও রাজস্বের বোঝা চাপিয়ে চলেছে। জিনিসপত্রের দাম রোজ বাড়ছে। ব্যবসা-বাণিজ্য মন্দায় আক্রান্ত। কৃষি ও কৃষক সঙ্কটাপন্ন। মানুষের কাজ-উপার্জন-ক্রয়ক্ষমতা তলানিতে নেমে এসেছে। অর্ধাহার-অনাহার-অনাহার মৃত্যু-সন্তান বিক্রির অন্ধকার দিনগুলি ফিরে এসেছে। পরিস্রুত পানীয় জল, সেচের জল ও বিদ্যুৎ সরবরাহের অনিশ্চয়তায় মানুষ ভুগছেন। সড়ক যোগাযোগ বিপর্যস্ত। বিদ্যালয়ে, কলেজে শিক্ষক-অধ্যাপকের অভাব। হাসপাতালে ডাক্তার-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মীর অভাব। ওষুধ, রোগীর খাবার ও শয্যার অভাব। সরকারি নিয়োগ প্রায় বন্ধ। যা কিছু নিয়োগ হচ্ছে তা হচ্ছে চুক্তির ভিত্তিতে। শূন্যপদ পূরণ হচ্ছে না, উলটে হাজার হাজার শূন্যপদ সৃষ্টি হচ্ছে। শ্রমজীবী সহ সরকারি কর্মচারীরা ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার এবং ন্যায্য আর্থিক পাওনা থেকে বঞ্চিত। অনেক ক্ষেত্রে মজুরি কমিয়ে দিয়েছে। শাসকদলের আশ্রিতরা অবাধ লুটের স্বরাজ কায়েম করেছে। সরকার দুর্নীতিতে ডুবে আছে। সরকারি আর্থিক শৃঙ্খলা ও অর্থ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। বিজেপি-আইপিএফটি জোট সরকার ত্রিপুরাকে ধবংসের কিনারায় নিয়ে গেছে।
এই দুর্বিষহ অবস্থা থেকে ত্রিপুরাকে মুক্ত করে রাজ্যে গণতন্ত্র-শান্তি-সম্প্রীতি- ধর্মনিরপেক্ষতার বাতাবরণ এবং আইনের শাসন ফিরিয়ে আনতেই হবে। কাজ-উপার্জন সহ মানুষের বেঁচে থাকবার মতো ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। দেশের সংবিধানে প্রদত্ত অধিকার ত্রিপুরার জনগণকে ফিরিয়ে দিতে হবে। এই লক্ষ্যকে সামনে রেখেই বামফ্রন্ট বিজেপি-কে পরাস্ত করতে এবং জনগণের স্বার্থে কিছু ন্যূনতম কর্মসূচি ও প্রতিশ্রুতি জনগণের সামনে রেখে এই নির্বাচনে লড়ছে। সেই ন্যূনতম কর্মসূচি ও প্রতিশ্রুতিই এবারের বামফ্রন্টের নির্বাচনী ইশ্তেহারের মূল কথা। আমরা ইশ্তেহারে বলেছি স্থানীয় সংস্থায় নিয়মিত নির্বাচন, রাজনৈতিক হিংসার শিকার পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়ানো, সংখ্যালঘুদের অধিকার সুনিশ্চিত করা, মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধ সম্পর্কে শূন্য সহনশীলতার নীতি গ্রহণ আমাদের অগ্রাধিকার। একই সঙ্গে ২.৫ লক্ষ নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি, রেগা সহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের মাধ্যমে বছরে ২০০ দিনের কাজ, মজুরি বৃদ্ধি, ১০৩২৩ সহ সব ছাঁটাই হওয়া কর্মচারীদের ফের নিয়োগ, ৬০ বছরের বেশি বয়সি সব কায়িক শ্রমে যুক্ত মানুষকে সামাজিক সুরক্ষার আওতায় আনা, গরিব কৃষক, খেতমজুর, জুমিয়াদের নতুন সামাজিক ভাতার আওতায় আনা, কর্মচারীদের বছরে দুবার ডিএ দেওয়া, পুরানো পেনশন প্রকল্প ফিরিয়ে আনা, শ্রমিক বিরোধী আইন কার্যকর না করার পাশাপাশি, উপজাতি এলাকা স্বশাসিত জেলা পরিষদকে আরও বেশি ক্ষমতা দিতে সংবিধান সংশোধনের জন্য উদ্যোগ নেওয়া হবে।
এই লড়াই একা সিপিআই(এম) বা বামফ্রন্টের নয়। আক্রমণের শিকার যখন গোটা রাজ্য, যখন বিজেপি- আরএসএস’র হিংস্র আক্রমণে সংবিধান, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা বিপন্ন, তখন সেই শত্রুকে পরাজিত করতে পারে সমস্ত গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির ব্যাপকতম ঐক্যই। সিপিআই(এম) এর ২৩ তম পার্টি কংগ্রেসে গৃহীত রাজনৈতিক রণকৌশলগত লাইনের সঙ্গে সাযুজ্য রেখেই ত্রিপুরায় সিপিআই(এম) এবং বামফ্রন্ট বিজেপি বিরোধী ভোটের সর্বোচ্চ একীকরণের লক্ষ্যে সমস্ত গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিকে একযোগে রাজ্যে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের প্রশ্নে এই নির্বাচনী লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানিয়েছে। সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে কংগ্রেস দল বামফ্রন্টের সঙ্গে আসন সমঝোতায় উপনীত হয়েছে। আদিবাসীভিত্তিক স্থানীয় দল তিপ্রা মথাকেও এই সমঝোতার অংশীদার হতে আহ্বান জানানো হয়েছিল। কারণ বিজেপি-ই সারা দেশে এবং ত্রিপুরায় আদিবাসী জনগণের সবচেয়ে বড় শত্রু। বিজেপি’র বিরুদ্ধে ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক শক্তির এই একসাথে লড়াই করার সিদ্ধান্ত আসলে রাজ্যের জনগণের দাবি। এই দুঃশাসন থেকে মুক্তির জন্য তাদের আকুলতা এবং ইচ্ছাকে সম্মান জানিয়ে বামফ্রন্ট এবং কংগ্রেস সহ ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহ এই নির্বাচনে একযোগে লড়াই করছে। এতে রাজ্যের জনগণের মধ্যে নতুন উৎসাহের, সাহসের সৃষ্টি হয়েছে। বামফ্রন্ট ও কংগ্রেসের মিছিল, সভায় মানুষের উপস্থিতি, ভয় জয় করে নির্বাচনী প্রচারে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ এই নির্বাচনে বিজেপির পরাজয়ের স্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই কেন্দ্র এবং রাজ্যে বিজেপি সরকার ও দলের নেতৃত্ব এতে আতঙ্কিত। মোদী, অমিত শাহ, জে পি নাড্ডা সহ কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, বিজেপি শাসিত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা ত্রিপুরায় বারবার আসছেন। এরা স্পষ্ট বুঝতে পারছেন মানুষের মনোভাব। বুঝতে পারছেন যদি মানুষ নির্ভয়ে, অবাধে নিজের ভোট নিজে দিতে পারেন তাহলে বিজেপি’র পরাজয় নিশ্চিত। সেজন্যই শত শত কোটি টাকা অবৈধভাবে রাজ্যে আনা হয়েছে। নির্বাচনী নিয়ম কানুনকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে টাকা বিলি করা হচ্ছে। পার্শ্ববর্তী রাজ্য আসাম, মণিপুর এমনকি উত্তর প্রদেশ থেকেও আরএসএস কর্মীরা ত্রিপুরায় ঘাঁটি গেড়ে বসে আছে। নানা কায়দায় জনগণকে বিভ্রান্ত করার এবং জনগণের ঐক্য ভাঙার চেষ্টা করছে। সমাজবিরোধী, দুর্বৃত্তদের ব্যবহার করে মানুষকে ভীত, সন্ত্রস্ত করার চেষ্টা হচ্ছে। হামলা, সন্ত্রাস চালানো হচ্ছে বিরোধী প্রার্থী, কর্মীদের ওপর। ভোটের আগে, ভোটের দিনও চেষ্টা হবে মানুষের ভোটের অধিকার লুট করার। এরা যাতে সফল না হয়, মানুষ যাতে নিজের অধিকার নির্ভয়ে প্রয়োগ করতে পারেন, তা নিশ্চিত করা ভারতের নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব। আমরা আশা করি তারা তাদের দায়িত্ব পালন করবেন। গোটা দেশ ত্রিপুরার দিকে তাকিয়ে আছে। আজ পশ্চিমবঙ্গ সহ সারা ভারতের গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষ ত্রিপুরার পাশে দাঁড়াচ্ছেন সংহতির বার্তা নিয়ে। আমরা প্রত্যয়ী, ত্রিপুরার জনগণ সব ভয়কে জয় করে নিজের অধিকার প্রয়োগ করে বিজেপি-কে পরাজিত করবেন এবং জনগণের সরকার গঠন করবেন। ত্রিপুরার নির্বাচনের ফলাফল গোটা দেশেই সংবিধান, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষা করার লড়াইকে শক্তিশালী করবে।
--------------------------------------------
লেখক ত্রিপুরা রাজ্য বামফ্রন্টের আহ্বায়ক
Comments :0