Panchayat vote 2023

টক্করে জয় ছিনিয়ে আনায় জয়কৃষ্ণপুর উত্তরের সুবর্ণজয়ন্তী

রাজ্য

১৯৭২ থেকে এই বুথটিতে সিপিআই(এম) জিতছে। দশম পঞ্চায়েত নির্বাচনেও সেই ধারা অব্যাহত। 
পাঁশকুড়ার গোবিন্দপুর পঞ্চায়েতের জয়কৃষ্ণপুর উত্তর। হিন্দু, মুসলমান পাশাপাশি বাস করেন, শান্তিতে। 
গতবার, ২০১৮-র পঞ্চায়েত নির্বাচনে একটি বুথ ছিল। একটিই আসন ছিল। এবার দুটি বুথ হয়েছিল। ফলে দুটি আসনও হয়েছিল। দুটিতেই সিপিআই(এম) জিতেছে। জয়ী দুই প্রার্থী — সেখ আসিকুর রহমান এবং সেখ মনজুর আলি।
কী ভাবে সম্ভব? দুই জয়ী প্রার্থীর প্রায় এক উত্তর। মোদ্দা কথা —‘আতঙ্ক তৈরি করার চেষ্টা করেছে ওরা। টাকা ছড়িয়েছে দেদার। মদ খাইয়ে ভোট কেনার চেষ্টা করেছে। কিন্তু আমরা ওদের সঙ্গে টক্কর নিয়েছি প্রতিদিন। ২০১৮-র মত এবারও চেষ্টা করেছিল বুথে গোলমালের। চেষ্টা করেছিল গণনার দিনও।’’ সিপিআই(এম) নেতা ইব্রাহিম আলি ওই এলাকার বাসিন্দা। তাঁর কথায়,‘‘গোটা গ্রাম এককাট্টা ছিল। আমরা যে কোনও প্রয়োজনে গ্রামবাসীদের পাশে থাকি। কী করছি, কেন করছি, সব বলি মানুষকে। সরাসরি। গ্রামবাসীরা বোঝেন আমরাই তাঁদের আপনজন। তাই এবারও আমাদের হারাতে পারেনি।’’
শুধু ওই দুটি বুথ নয়। গোবিন্দপুর পঞ্চায়েতে গতবার ১টি মাত্র বুথে জিততে পেরেছিল বামফ্রন্ট। বাকিগুলির একাংশ ভোটের আগেই জিতে নিয়েছিল মমতা ব্যানার্জি-শুভেন্দু অধিকারীর দল। এবারও সন্ত্রাস হয়েছে। কিন্তু এবার ৬টি আসনে জিতেছে বামফ্রন্ট এখানে। তার অন্যতম পশ্চিম নেকড়া ৭৭ নম্বর বুথ। ১৯৭৮ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত জয়ী হয়েছিলেন সিপিআই(এম)’র প্রার্থীরা। ২০১৮ সালে কোনওরকমে মনোনয়ন করতে পারলেও প্রচার করতে পারেননি সিপিআই(এম)’র প্রার্থীরা। ব্যাপক ছাপ্পা করে সেবার জিতেছিল তৃণমূল। এবারের নির্বাচনে এই বুথেই সিপিআই(এম) প্রার্থী নিলুফা খাতুন জয়ী হয়েছেন। এই বুথে মোট ভোটার ১২৫০। প্রায় ৯৯ শতাংশই সংখ্যালঘু। পাঁশকুড়া জুড়ে যে ব্যাপক সন্ত্রাসের বাতাবরণ তৈরি করে রেখেছে তৃণমূল তার বিরুদ্ধে এই এলাকার মানুষ সিপিআই(এম) প্রার্থীকেই জয়ী করেছেন।
পূর্ব মেদিনীপুরে এমন আরও বেশ কিছু জায়গায় রীতিমতো লড়াই করে জয়ী হয়েছে বামফ্রন্ট, কংগ্রেস, আইএসএফ’র সম্মিলিত প্রার্থীরা।
কী বলছেন সঞ্জীব আচার্য?
‘‘তৃণমূল গত পাঁচ বছর কোনওদিন ভয় দেখাতে ছাড়েনি। কিন্তু আমরা লাগাতার জুঝে গেছি। জমি ছাড়িনি একদিনও। এমনকি ভোটের দিন কিংবা গণনার দিনও শেষ পর্যন্ত টিকে থেকেছি আমরা।’’ দুটি আসনে লড়ে জয় ছিনিয়ে এনেছে সিপিআই(এম)। প্রার্থী দু’জনের একজন সঞ্জীব আচার্য। যুবক— ৩৭ বছরের। অন্যজন প্রৌঢ় কৃষক। রবীন্দ্রনাথ মান্না তাঁর নাম।
শহীদ মাতঙ্গিনী ব্লককে তৃণমূলের কথায়,‘অনুব্রত মডেলে’ চালানো হয়েছে, বিশেষত গত পাঁচ বছর। পূর্ব মেদিনীপুর জেলার সন্ত্রাসের এক ভিন্ন রূপ এই ব্লক এলাকায়। ২০১৮-র পর যেখানে সব গ্রাম পঞ্চায়েত বিরোধীশূন্য ছিল। এলাকায় তোলাবাজি ছিল তৃণমূলের একমাত্র কাজ। বিরোধিতা করার চেষ্টা করলেই হুমকি, মারধর। জেলার প্রবেশ পথ এই ব্লক এলাকা ২০০৮ পরবর্তী সময় থেকে তৃণমূলের লাগাতার সন্ত্রাসের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। ২০১১-তে রাজ্যে মমতা ব্যানার্জি মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরেই পূর্ব মেদিনীপুর জেলার বিভিন্ন ব্লক এলাকার মতো এখানেও সিপিআই(এম) প্রার্থী এবং কর্মীদের ঘর ছাড়া হতে হয়। জেলায় তৃণমূলের নেতা তখন শুভেন্দু অধিকারী। অনেক মিথ্যা মামলা হয় সিপিআই(এম) নেতা, কর্মীদের নামে। হারাতে হয় নিজের জমি, কাজ। প্রকাশ্যে মিটিং মিছিল তো দূর অস্ত্‌, পার্টি অফিস খুলে বসারও ‘অধিকার’ ছিল না সিপিআই(এম) কর্মীদের। চলত লাগাতার মারধর। যাদের নেতৃত্বে এমন সন্ত্রাস চলতো তাদের একজন সেলিম আলি। অন্যজন দিবাকর জানা। এই দুজনের বাহিনী এই ব্লক এলাকা জুড়ে দাপিয়ে বেরিয়েছে। 
তার মধ্যেও অনেক অত্যাচার সহ্য করে লড়ে গিয়েছেন সিপিআই(এম) কর্মীরা। এলাকাটিতে একঘরও সংখ্যালঘু নেই। ২০১৩ সালেও সিপিআই(এম) প্রার্থী হিসাবে সঞ্জীব আচার্য জয়ী হয়েছিলেন। কিন্তু জয়ী হওয়ার পর থেকেই তার ওপর লাগাতার আক্রমণ চালায় তৃণমূল নেতা সেলিম আলির বাহিনী। ব্যাপক মারধর করা হয় তাঁকে। দুবার হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। তৃণমূলী ফতোয়ায় পঞ্চায়েতমুখী হতে পারেননি তিনি। ২০১৮ সালে সঞ্জীব আচার্যর স্ত্রী প্রার্থী হন। কিন্তু মনোনয়ন করার পর থেকেই ঘরবন্দি থাকতে হয় তাকে। দেদার ছাপ্পা চলে সেবার। জয়ী হয় তৃণমূল। এবার আবার সঞ্জীব প্রার্থী হয়েছিলেন। শান্তিপুর-১ নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েতের শান্তিপুর দক্ষিণপাড়া ২১ নম্বর বুথে ১৭৮ ভোটে জয়ী হয়েছেন তিনি। সিপিআই(এম) ছাড়াও তৃণমূল, বিজেপি এবং এসইউসিআই দলের প্রার্থী ছিলেন। অন্যদিকে এই গ্রাম পঞ্চায়েতেরই বড়গাছিয়া বুথে ৬৫ বছরের কৃষক রবীন্দ্রনাথ মান্না ৪৭ টি ভোটে জয়ী হয়েছেন।
রবীন্দ্রনাথ মান্নার কথায়,‘‘ওরা হুমকি দিত। কিন্তু আমরা যা সুযোগ পেয়েছি গ্রামের লোকের সঙ্গে থাকার চেষ্টা করেছি। বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের ফরম ফিল আপ করে দিতেন আমাদের কর্মীরা। আমফানের সময় পঞ্চায়েত যখন কোনও কাজ করছে না, আমরা ত্রিপল, খাবার, যা যতটুকু পেরেছি জোগাড় করে গ্রামবাসীদের পাশে থেকেছি।’’
কিছুটা এসবেরই ফল মিলেছে। আর? সঞ্জীবের কথায়,‘‘তৃণমূলের দৌরাত্ম্যে মানুষ অস্থির ছিলেন। কোলাঘাট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে কাটমানি নিয়ে শ্রমিকদের কাজে লাগানো, কোলাঘাট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ছাই বেনামে বিক্রি সহ ব্যাপক দুর্নীতি মানুষ দেখেছেন। কিছুতেই ওদের সহ্য করতে পারছিলেন না। এবারও যেভাবে জেলায় ওরা পঞ্চায়েত কবজা করল, তাতেও মানুষ ক্ষুব্ধ হয়েছেন।’’
লড়াইয়ের অন্য রূপ কাঁথিতেও। ৮০ শতাংশ সংখ্যালঘু নিবিড় বুথ কাঁথি ৩ ব্লকের দুরমুঠ অঞ্চলের বেতালিয়া। কাঁথি শহর লাগোয়া অঞ্চল। গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে এই বুথে তৃণমূল প্রার্থী জয়লাভ করেছিলেন। স্বভাবতই ব্যাপক রিগিং করে। এমনকি ২০২১ সালে বিধানসভা নির্বাচনে ওই বুথে ৬৭২ ভোটের লিড ছিল তৃণমূলের। মাত্র দু’বছরের ব্যবধানে এবারে সিপিআই(এম)’র প্রার্থী রুবিনা বিবি ৩৭ ভোটে জয়লাভ করেছেন।
 

Comments :0

Login to leave a comment