রাজ্যের সমস্ত সরকারি দপ্তর ও রাজ্য সরকার অধিগৃহীত সংস্থায় স্মার্ট মিটার বসানোর জন্য নির্দেশিকা জারি করল বিদ্যুৎ দপ্তর।
সরকারি দপ্তরের পাশাপাশি নিউটাউন, বিধাননগর, চন্দননগর ও গড়িয়া এলাকার প্রায় সাড়ে চার লক্ষের ওপর সাধারণ বিদ্যুৎ গ্রাহকদের স্মার্ট মিটারের আওতায় আনার জন্য ইতিমধ্যে চুক্তি স্বাক্ষর সম্পন্ন করেছে রাজ্য সরকার। মোদী সরকারের বিদ্যুৎ নীতির দ্রুত রূপায়ণে কার্যত মরিয়া হয়ে নেমেছে মমতা ব্যানার্জির সরকার।
ডব্লিউবিএসইডিসিএল (ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টেট ইলেকট্রিসিটি ডিস্ট্রিবিউশান কোম্পানি লিমিটেড)’র সঙ্গে এইচপিএল ইলেকট্রিক অ্যান্ড পাওয়ার লিমিটেড কোম্পানির ১০ বছরের চুক্তি ইতিমধ্যেই স্বাক্ষরিত হয়েছে। এরাজ্যের রাজ্য বিদ্যুৎ পর্ষদ এলাকায় এইচপিএল কোম্পানি স্মার্ট মিটার বসানোর বরাত পেয়েছে। ফলে দ্রুততার সঙ্গে গড়িয়া, চন্দননগর, বিধাননগর ও নিউটাউন এলাকায় সাধারণ গ্রাহকদের চলতি পোস্ট-পেইড মিটারের পাশে প্রি-পেইড স্মার্ট মিটার বসাতে শুরু করে দিয়েছে বরাত পাওয়া বেসরকারি কোম্পানি।
কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎ মন্ত্রকের কাছে মাথা নুইয়ে মমতা ব্যানার্জির সরকার মেনে নিয়েছে কেন্দ্রের আরডিএসএস (রিভামপড ডিস্ট্রিবিউশান সেক্টর স্কিম) প্রকল্প। বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে সংস্কারের নামে জনবিরোধী এই প্রকল্পেই উল্লেখ করা আছে, আগামী ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য বিদ্যুৎ পর্ষদ এলাকার সব গ্রাহকদের স্মার্ট মিটারের মাধ্যমে বিদ্যুৎ কেনার ব্যবস্থা করতে হবে। যার অর্থ, প্রিপেড মোবাইল ব্যবহারের মতো আগাম টাকা ভরতে হবে বিদ্যুৎ কেনার খরচ। টাকা শেষ হলে বন্ধ হবে পরিষেবা। ফের নতুন করে ভরতে হবে বিদ্যুৎ খরচের টাকা। স্মার্ট মিটার চালু হলে উঠে যাবে পারস্পরিক ভরতুকি। চালু হবে টিওডি (টাইম অব ডে) মাশুল নীতি। বিদ্যুতের চাহিদা অনুযায়ী ঠিক হবে ইউনিট পিছু বিদ্যুৎ খরচের দাম। ঠিক যেমনভাবে রেল মন্ত্রক কিংবা বিমান পরিষেবায় চালু আছে ডায়ানামিক ফেয়ার প্রাইস সিস্টেম। অর্থাৎ চাহিদা বাড়লে দূরপাল্লার ট্রেনের ভাড়ার মতোই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়বে বিদ্যুৎ ব্যবহারের খরচ। দুর্যোগ নামতে চলেছে কৃষকের জীবনেও।
আরডিএসএস প্রকল্প মেনে আগামী ২০২৪ সালের এপ্রিল মাসের মধ্যে রাজ্যের সমস্ত সরকারি দপ্তর, সরকার অধিগৃহীত সংস্থার পাশাপাশি শিল্প প্রতিষ্ঠান ও বাণিজ্যিক সংস্থায় চালু করতে হবে স্মার্ট মিটার। তার জন্য বিদ্যুৎ দপ্তরের তরফ থেকে রাজ্যের সমস্ত সরকারি দপ্তর যার মধ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল থেকে শুরু করে পৌরসভা, কর্পোরেশন সর্বত্রই স্মার্ট মিটার চালু করার নির্দেশিকা জারি করেছে রাজ্যের বিদ্যুৎ দপ্তর। রাজ্যের সেচ দপ্তর, জনস্বাস্থ্য কারিগরি দপ্তর, স্বাস্থ্য দপ্তর সহ বহু গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে ব্যাপক পরিমাণে বিদ্যুতের ব্যবহার হয়। বিদ্যুৎ দপ্তরের পক্ষ থেকে যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার এক আধিকারিকের জারি করা নির্দেশিকাতে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, রাজ্যের সমস্ত সরকারি দপ্তর ও রাজ্য সরকার অধিগৃহীত সমস্ত বিভাগ ও সংস্থায় দ্রুত চালু হবে স্মার্ট মিটার।
কী আছে নির্দেশিকায়?
রাজ্যের সমস্ত সরকারি দপ্তরে পর্যায় ভিত্তিতে স্মার্ট মিটার বসানোর কথা জানানো হয়েছে। প্রিপেড মিটার বসানোর আগে সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে আগাম জানিয়ে দেওয়া হবে। রাজ্যের সব দপ্তরে এখন চালু আছে পোস্ট পেইড মিটার। স্মার্ট মিটার বসিয়ে দেওয়ার কাজ সম্পন্ন করার পর কীভাবে পোস্ট পেইড মিটার থেকে প্রিপেড স্মার্ট মিটারে স্থানান্তর হবে তার বিস্তারিত বিষয় বিদ্যুৎ দপ্তরের নির্দেশিকায় উল্লেখ করা হয়েছে।
মাসের প্রথম দিন থেকে ১৫দিন সময়কালের মধ্যে বসিয়ে দেওয়া হবে স্মার্ট মিটার। ১৬তম দিনে সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরে যাঁর নামে মিটার তাঁর কাছে একটি এসএমএস যাবে। ওই এসএমএস থেকেই সরকারি দপ্তর জানতে পারবে তাঁদের এরপর থেকে আগাম টাকা দিয়ে কিনতে হবে বিদ্যুৎ। যার অর্থ, দপ্তরের পোস্ট পেইড মিটার থেকে বিদ্যুৎ খরচ এবার স্মার্ট মিটারে স্থানান্তর করে দেওয়া হচ্ছে। স্থানান্তর হওয়ার পর আগের মিটারের খরচ হওয়া বকেয়া বিল মিটিয়ে দেওয়ার কথা নির্দেশিকাতে জানানো হয়েছে।
কিন্তু তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ সরকারি দপ্তরে স্মার্ট মিটার চালু হওয়ার পর নির্দেশিকাতে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। ‘‘ প্রাথমিকভাবে পোস্ট পেইড থেকে স্মার্ট মিটারে স্থানান্তর হওয়ার পর কোনও সরকারি প্রতিষ্ঠানে বিল না মেটালে বিদ্যুৎ সংযোগ ছিন্ন করা হবে না।’’ তারপরেই বলা হয়েছে, ‘‘ স্মার্ট মিটার বসানোর পর বিদ্যুতের বিল বকেয়া থাকলে এসএমএস মারফত সতর্ক করা হবে। যাতে অবিলম্বে বিদ্যুৎ খরচের বকেয়া টাকা জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হবে। কিন্তু সেই নির্দেশ কার্যকর না হলে ১০ দিনের মধ্যে সরকারি দপ্তরের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হবে।’’
বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে সংস্কারের নামে ঢালাই বেসরকারিকরণের চেহারাই হলো স্মার্ট মিটার। বিদ্যুৎ দপ্তরের এই নির্দেশিকাতেই প্রমাদ গুনছে সরকারি দপ্তর। এরাজ্যের অধিকাংশ সরকারি প্রতিষ্ঠানেই সময়ে বিদ্যুতের বিল জমা পড়ে না। পৌরসভা ও গ্রাম পঞ্চায়েতে কোটি, কোটি টাকা বকেয়া বিল পড়ে থাকার পর বিদ্যুৎ দপ্তরকে চিঠির পর চিঠি দিয়ে টাকা চাইতে হয়। কিন্তু স্মার্ট মিটার বাসনোর পর আগাম টাকা দিয়ে কিনতে হবে বিদ্যুৎ। তারপর সেই টাকার বিদ্যুৎ খরচ হলে সরকারি প্রতিষ্ঠানের লাইন কেটে দেওয়ার হুমকি এসেছে।
সরকারি দপ্তর তাও ১০ দিন সময় পাবে। কিন্তু রাজ্যের সাধারণ গ্রাহকদের সেই সময়টুকুও মিলবে না। আগাম টাকা ভরতে হবে। চাহিদার সময় সর্বোচ্চ দর দিয়ে বিদ্যুৎ কিনতে হবে। টাকা শেষ হলে বন্ধ হয়ে যাবে বিদ্যুৎ পরিষেবা।
সর্বনাশের মুখে পড়তে চলেছেন রাজ্যের কৃষকরা। পারস্পরিক ভরতুকি উঠে যাওয়ার পর গ্রাহকদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ভরতুকির টাকা পাঠিয়ে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। রাজ্যের আর্থিক সঙ্কট যে মাত্রায় তাতে সেচ দপ্তর কতটা আগাম বিদ্যুৎ কিনে কৃষকদের স্বার্থরক্ষা করবে তা নিয়ে প্রশ্ন থাকছেই। তার থেকেও বড় প্রশ্ন, বর্গাদার ও ভাগচাষিদের জমির কাগজ নেই। ফলে ভরতুকির টাকা শেষ পর্যন্ত তাঁদের অ্যাকাউন্টে আসবে না।
কৃষিক্ষেত্রে মোদী ও মমতা সরকারের নীতির বিরুদ্ধে মঙ্গলবার কলকাতার রানি রাসমণি রোডে কৃষক সমাবেশের ডাক দিয়েছে সারা ভারত কৃষকসভার পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটি। কৃষিক্ষেত্রে স্মার্ট মিটার বসানোর প্রতিবাদেও সরব হবেন কৃষক সমাবেশ।
Smart meter
রাজ্যে স্মার্ট মিটার বসানোর কাজ শুরু হয়ে গেল
×
Comments :0