আগামী লোকসভা ভোটে এরাজ্যে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে তৃণমূল লড়াই করবে বলে সরকারি মঞ্চ থেকে ঘোষণা করে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি!
সিপিআই(এম) ও কংগ্রেস দলকে এদিন তীব্র ভাষায় আক্রমণ করে জাতীয় ক্ষেত্রে বিজেপি বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’কে নিয়েও কটাক্ষ করে মমতা ব্যানার্জি বলেছেন,‘‘ ওখানে ন্যাশানাল পার্টিতে ইন্ডিয়া। আর এখানে ‘বিজেন্ডিয়া’। লজ্জাও করে না। বিজেপি’র সাথে বসে আছে।’’
এদিন রাজ্যে সিপিআই(এম) ও কংগ্রেস দলকে আক্রমণ করতে গিয়ে যেভাবে জাতীয় ক্ষেত্রে গড়ে ওঠা বিজেপি বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’কে মুখ্যমন্ত্রী কটাক্ষ করেছেন তাতে বিস্মিত রাজ্যের রাজনৈতিক মহল। পাটনার পর বেঙ্গালুরুর বৈঠক থেকে বিজেপি বিরোধী রাজনৈতিক জোটের নাম ‘ইন্ডিয়া’ রাখার পর থেকে খোদ নরেন্দ্র মোদী আসরে নেমে পড়েন। জোটকে কটাক্ষ করে সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীর সঙ্গে তুলনা টেনেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু লোকসভা ভোটের আগে মুখ্যমন্ত্রীর ‘বিজেন্ডিয়া’ মন্তব্য নিশ্চিতভাবেই এরাজ্যে আরএসএস-বিজেপি’কে ইন্ডিয়া জোটকে কটাক্ষ করার ভাষা সরবরাহ করে দিল।
ঝাড়গ্রামে বিশ্ব আদিবাসী দিবসের সরকারি মঞ্চ থেকে এদিন তীব্র ভাষায় মমতা ব্যানার্জি সিপিআই(এম) ও কংগ্রেসকে আক্রমণ করতে শুরু করেন। মমতা ব্যানার্জি বলেন,‘‘ এখানে রাম, বাম, জগাই, মাধাই গদাই মানে, সিপিএম আর কংগ্রেস। মানুষের একটা নীতি থাকে। সেই নীতি মেনে চলতে হয়। আমাদের লড়াই সিপিএম’এর বিরুদ্ধে। বাংলায় আমাদের লড়াই কংগ্রেসের বিরুদ্ধে। আর বিজেপি’র বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই থাকবে।’’ কেন বাংলায় কংগ্রেসের বিরুদ্ধে লড়াই তার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মমতা ব্যানার্জি বলেছেন, ‘‘যদি ওরা (কংগ্রেস) এরকম করতে থাকে তাহলে বাংলায় কংগ্রেসের বিরুদ্ধে লড়াই হবে।’’
বিজেপি বিরোধী জোটে তৃণমূল কংগ্রেস যে থাকবে না, তা আগে জানিয়েছিলেন মমতা ব্যানার্জি। সাগরদিঘির উপনির্বাচনে পর্যুদস্ত হওয়ার পর নবান্ন থেকেই মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, ‘‘আমরা কারোর সাথে থাকব না। আমরা একাই লড়ব।’’ তখন বিজেপি বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’ তৈরি হয়নি। কিন্তু গোটা দেশে বিজেপি বিরোধী সব রাজনৈতিক দলগুলি পরস্পরের মধ্যে আলাপ আলোচনা শুরু করে দিয়েছিল। গত মার্চ মাসে সাগরদিঘির ভোটে হারার পর মমতা ব্যানার্জি বলেছিলেন,‘‘আমরা একা লড়ব। আমরা কারোর সাথে যাব না। যারা বিজেপি-কে হারাতে চায়, বিশ্বাস করি তারা আমাদের ভোট দেবে। আর যারা কংগ্রেস, সিপিএম’কে ভোট দেবে তারা আসলে বিজেপি-কেই ভোট দেবে। সাগরদিঘির ভোটে সেই সত্যতা উদঘাটিত হয়ে গেছে।’’
বুধবার ঝাড়গ্রামে সরকারি সভামঞ্চ থেকে মমতা ব্যানার্জি আগামী লোকসভা ভোটে তৃণমূল কংগ্রেসের একা লড়ার নীতিগত ঘোষণা করে দিলেন। কিন্তু তারসঙ্গে জুড়ে দিলেন ইন্ডিয়া জোট নিয়ে তীব্র কটাক্ষও। শুধু সাগরদিঘি উপনির্বাচনে পরাজিত হওয়া নয়, রাজ্যে পঞ্চায়েত ভোটের প্রচারেও কংগ্রেস দলকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেছিলেন মমতা ব্যানার্জি। গত ১৬ জুন রাজ্য কংগ্রেসকেও একইভাবে আক্রমণ করে ‘সিপিএম-এর দোসর’ বলে দেগে দিয়ে মমতা ব্যানার্জি বলেছিলেন,‘‘বাংলায় সিপিএম’র সাথে ঘর করে আমাদের কাছ থেকে সাহায্য চাইতে আসবে না।’’ ফলে এক সময় এরাজ্যে বিজেপি বিরোধী জোট নিয়ে মমতা ব্যানার্জির মন্তব্য কার্যত বিজেপি’কে সাহায্য করার বার্তাই পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। তবে এদিন সব মাত্রাকে অতিক্রম করে গেছেন মুখ্যমন্ত্রী।
বিজেপি বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মমতা ব্যানার্জি ও তাঁর দল আদৌ কতটা আন্তরিক সেই প্রশ্ন আছেই। তা এদিন রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোসকে নিয়ে মমতা ব্যানার্জির মন্তব্যে ফের সামনে চলে এসেছে। গত ২৫ জুলাই আকস্মিকভাবে নবান্ন থেকে রাজভবনে রাজ্যপালের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যান। রাজভবন থেকে বেরিয় মুখ্যমন্ত্রী সাক্ষাৎ পর্বকে সৌজন্য বলে জানিয়েছিলেন। এমনকি রাজভবনে পড়ে থাকা মুখ্যমন্ত্রীকে রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির আচার্য পদে নিয়োগের বিল দীর্ঘদিন ধরে পড়ে থাকা নিয়ে সাংবাদিকরা তাঁর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন,‘‘ওটা পড়ে আছে। যখন হবে, তখন হবে। ওটা নিয়ে আজকে আলোচনা হয়নি।’’
দু’সপ্তাহের মধ্যে সম্পূর্ণ ভোলবদল করে ঝাড়গ্রামের সভা থেকে মমতা ব্যানার্জি রাজ্যপালকে আক্রমণ করে বলেন,‘‘যদি আপনার(রাজ্যপাল) সৎসাহস থাকে তো, বিধানসভায় যে বিলটা পাশ হয়েছে, মুখ্যমন্ত্রী আচার্য হবে, সেই বিলটা আপনি সই করে দিন।’’ অথচ জগদীপ ধনকড়ের আমলে এই বিল বিধানসভায় পাশ হয়ে রাজভবনে এসেছিল। জগদীপ ধনকড় রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে আচার্য পদে নিয়োগের বিলে স্বাক্ষর করেননি। তারপর লা গনেশন রাজ্যে অস্থায়ী রাজ্যপাল হিসাবে আসেন। তিনিও সই করেননি। এরপর আসেন সিভি আনন্দ বোস। শুরুতে রাজভবনের সঙ্গে সুসম্পর্ক এমনই ছিল যে রাজ্যপালের হাতেখড়ি অনুষ্ঠানে ছিলেন মমতা ব্যানার্জি। তখন বিলে সই করা নিয়ে রা কাড়েনি সরকার। এখন সিভি আনন্দ বোসকে বিজেপি’র হয়ে নির্বাচনে দাঁড়ানোর পরামর্শ দিয়ে জগদীপ ধনকড়ের জন্য প্রশংসা বাক্য শোনাচ্ছেন মমতা ব্যানার্জি।
ঝাড়গ্রামের সভা থেকে মমতা ব্যানার্জি এরাজ্যে কেন্দ্রীয় সরকারের বঞ্চনার প্রসঙ্গ তুলে রেগা, আবাস যোজনা, গ্রামীণ রাস্তায় টাকা না দেওয়ার প্রসঙ্গ তুলে তাৎপর্যপূর্ণভাবে তার সঙ্গে জুড়ে দেন সরকারি কর্মচারীদের মহার্ঘভাতার প্রসঙ্গ। ‘‘ শুধুমাত্র সরকারি কর্মচারীদের কেন্দ্রীয় সরকার ডিএ বাড়ায়। কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকারের চাকরির প্রার্থক্য আছে। কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরির নীতি আলাদা। কেন্দ্র ১০০ দিনের টাকা দিচ্ছে না। রাস্তার টাকা আটকে দিয়েছে। আবাসের টাকা দিচ্ছে না। সেই টাকায় মুষ্টিমেয় লোককে ডিএ পাইয়ে দিচ্ছে।’’ বলেছেন মমতা ব্যানার্জি। সরকারি কর্মচারীদের মহার্ঘভাতা নির্ধারণ হয় এআইসিপিআই (অল ইন্ডিয়া কনজিউমার প্রাইস ইনডেক্স) অনুযায়ী। তা মুখ্যমন্ত্রীর অজানা নয়। তাহলে কেন্দ্রীয় প্রকল্পের টাকা প্রাপ্তির সঙ্গে ডিএ’কে মিলিয়ে দেওয়ার লক্ষ্য পরিকল্পিতভাবেই করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। কারণ, এরাজ্যের সরকারি কর্মচারীদের ডিএ বকেয়া ৩৬শতাংশ। গোটা দেশে সব রাজ্যের তুলনায় সর্বোচ্চ। কেন্দ্র আগামী সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে ফের ডিএ ঘোষণা করবে। তখন ফারাক আরও বাড়বে। তাই সচেতনভাবেই মুখ্যমন্ত্রী ডিএ প্রসঙ্গ উত্থাপন করে রাখলেন।
Comments :0