KISAN LONG MARCH

চুলা জ্বলছে, কৃষকের ক্ষোভের চুলা

জাতীয়

Kisan long march Aiks maharashtra farmers distress bengali news

মুরলীধর বুধা মিসার : বাসিন্দ (মুম্বাই)
 

সন্ধ্যায় বাসিন্দ স্টেশনের কাছের মাঠটায় পরের পর চুলা জ্বলতে শুরু হয়েছে। বড় একটা কড়াইয়ে কষা হচ্ছে বেগুন-আলুর সবজি। পাশে চলছে আটা মাখার প্রস্তুতি। রুটি বানানোর তোড়জোর। সারাদিনের হাঁটার শেষে জিরিয়ে নেওয়ার জো নেই। ৬০-৭০জনের রান্না। তাই মাঠে এসেই গজাননরা নেমে পড়েছেন রাতের খাবার বানানোর লড়াইয়ে।

নাসিকের ওই যুবনেতার সঙ্গেই হাত লাগিয়েছেন ডিন্ডোরি থেকে আসা তাঁর গ্রামের বাকি জোয়ান-যুবকরা। ধোয়া হচ্ছে চাল। শুধু রুটি নয়, রাতের মেনুতে থাকছে চাওয়ালও। বয়স্করা তখন ইতিউতি একটু গড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা। আজ রাতে আর এগনোর নেই। নেতারা জানিয়ে দিয়েছেন, আজ রাতটা এখানেই কাটাতে হবে। এক একটা গ্রামের লোকের একটা একটা চুলা। রাতে পাত পড়বে সেই মতো। কাল সকালে ফের চলতে শুরু করবে লাল ঝান্ডার কিষান লঙ মার্চ, মুম্বাই পানে।

 
এখনও প্রায় ৬৫ কিলোমিটার পথ। এর মধ্যেই ১৩৫ কিলোমিটার পথ পার করে এসেছে এই মিছিল। রবিবার ডিন্ডোরিতে শুরুর দিনে সংখ্যাটা ছিল দশ হাজার। আর এই কয়েকদিনে ফুলে ফেঁপে বহরে বেড়েছে লঙ মার্চ। বৃহস্পতিবার বিকেলে নাসিক-মুম্বাই সড়ক ছেড়ে রাত কাটানোর জন্য মুম্বাই সাবার্বান লাইনের বাসিন্দ স্টেশন লাগোয়া মাঠে লঙ মার্চ পৌঁছালো, ততক্ষণে হাজার তিরিশেক ছাড়িয়ে গেছে সংখ্যাটা।

কাল রাতটা লঙ মার্চের কেটেছিল ঘাটন দেবী মন্দিরে। সকাল সকাল রওনা দিয়ে আজ প্রথমে মিছিল পৌঁছায় কাসারা ঘাট। খানিক জিরিয়েই মোখনগাঁও হয়ে দুপুরের মধ্যেই সাহাপুর। সেখানে দুপুরের খাওয়া সেরে তপ্ত দুপুরেই ফের পথ চলতে নেমে পড়েন হাজার হাজার কৃষক। শুধু কিষানভাই নয়, মিছিলে রয়েছে অসংগঠিত ক্ষেত্রের বহু শ্রমিক। রয়েছে আশাকর্মীরা। শুধু তাই নয়, মুম্বাইয়ের লক্ষ্য হেঁটে চলেছেন বেশ কিছু আদিবাসী সংগঠনের প্রতিনিধিরাও। 

সহযাত্রীদের পরিচিতি দিতে গিয়ে নাসিকের ডিওয়াইএফআই’র জেলা সম্পাদক গজানন্দ কোকট জানালেন, এআইকেএস-এর ডাকে এই লঙ মার্চ। কিন্তু অন্য কৃষক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত বহু কৃষকই পথ হাঁটছেন। ফসলের উচিত দাম হোক কিংবা বনাঞ্চলের জমির অধিকার ১৭ দফার দাবির সবগুলোই তো ওঁদেরও চাহিদা। তাই সেই মানুষগুলিও থেমে না থেকে এগিয়ে এসেছেন। কিষানসভার লাল ঝান্ডা কাঁধে এগিয়ে যাচ্ছেন।

বছর সাঁইত্রিশের গজানন্দের সাড়ে তিন একর মতো জমি। খানিকটা গাইরনওয়ালার, মানে খাসজমি। বেশিরভাগটাই বনাঞ্চলের জমি। জমি আছে, কিন্তু নেই সাত-বারার পাট্টার কাগজ। একটা পর্চি আছে, কিন্তু সেখানে জনা চল্লিশের একসাথে জমির কাগজ। চাষের কথা জানতে চাইলে দুই ছেলে-মেয়ের বাবা গজানন্দে গলায় বেশ কিছুটাই আক্ষেপের সুর। কিছুটা পেঁয়াজ বুনেছিলেন। কিন্তু এবার যা দাম পড়ে গেছে তাতে আর সেগুলির তোলার সাহস হয়নি। জমিতেই পচছে ফসল। মুম্বাই থেকে দাবি আদায় করে ফিরলে নামবেন জমি সাফাইয়ের কাজে।

লঙ মার্চের দাবির কথা জানতে চাইলে গড়গড় করে বলে চললেন গজানন্দ। পেঁয়াজে অবিলম্বে কুইন্টাল প্রতি ৬০০টাকার আর্থিক ক্ষতিপূরণ চাই। মুখ্যমন্ত্রী ৩০০টাকা ঘোষণা করলেও তাতে কিছুই হবে না। অসময়ের বৃষ্টি আর প্রাকৃতিক দুর্যোগে সম্প্রতি ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে সোয়াবিন, তুলোয়।  ক্ষতিপূরণ দিতে হবে তাঁদেরও। চাই বনের জমির অধিকার, উচিত পাট্টা— এসব তো রয়েইছে। একটু থেমে গজানন্দ ফের বলতে শুরু করলেন, কৃষি ঋণ মকুবের পাশাপাশি কৃষকরা দাবি করছেন ১২ঘণ্টার জন্য নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের।


শুধু কি তাই, এই লঙ মার্চ দাবি তুলেছে রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের জন্য পুরানো পেনশন প্রকল্প ফিরিয়ে আনার। এমন দাবির সঙ্গে আপনার কী সম্পর্ক? আপনার মতো কৃষকরা কেন এই দাবি তুলল? প্রশ্ন শুনে বললেন, ওরাও তো আমাদের লড়াইয়ের সাথে রয়েছেন। ওরাও পথ হাঁটছেন। অনেকেই মুম্বাইয়ে আমাদের সঙ্গে জুড়ে যাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন। তাই নামে কিষান লঙ মার্চ, কিন্তু শুধু কৃষকের নয়, শ্রমিক-কর্মচারী সকলের দাবিই মিলেমিশে জুড়ে গেছে এই লঙ মার্চে।

গজানন্দের কথায় খানিকটা হলেও উঁকি দিয়ে গেল ২০১৮-র সেই ঐতিহাসিক কিষান লঙ মার্চ। সেবার হাজার হাজার কৃষক যখন মাঝরাতে মুম্বাইয়ে ঢুকেছিল, বাণিজ্য নগরীর মধ্যবিত্ত, উচ্চমধ্যবিত্ত সোসাইটিবাসীরা তাঁদের এগিয়ে দিয়েছিলেন জলের বোতল কিংবা মিষ্টি-ফল। অন্য পেশার মানুষ সেদিন জুড়ে গিয়েছিলেন ‘অন্নদাতার’ লড়াইয়ে। সমাবেশের গর্জনে সেবার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফড়নবীশ বাধ্য হয়েছিলে কৃষকদের দাবিগুলি মেনে নিতে।


গতবারের সেই অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়েই এবার শুরু থেকে সাবধানী বিজেপি জোট সরকার। প্রতিদিনই মন্ত্রীদের পাঠাচ্ছেন কৃষক নেতাদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে রফা সূত্র বের করার। সন্ধ্যায় বাসিন্দের মাঠে যখন গজানন্দরা আগামীকালের লড়াইয়ের রসদ সংগ্রহ ব্যস্ত, তখন সিপিআই (এম)’র পলিট ব্যুরোর সদস্য অশোক ধাওয়ালে, প্রাক্তন বিধায়ক জে পি গাভিট, অজিত নাওয়ালে, উমেশ দেশমুখ, সিআইটিইউ নেতা ডি এল কারাড, ডিওয়াইএফআই নেতা ইন্দ্রজিৎ গাভিটরা দর কষাকষি চালাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী একনাথ শিণ্ডে, এখন উপমুখ্যমন্ত্রী ফড়নবীশের সঙ্গে।

বিকেল পাঁচটায় বৈঠক শুরু হয়েছিল সেই বৈঠক। রাতে মুখ্যমন্ত্রীই জানালেন, মহারাষ্ট্র সরকার সব দাবি মেনে নিয়েছে। ম্যারাথন বৈঠক শেষে শিণ্ডে জানিয়েছেন, ‘সব বিষয় নিয়ে খুবই ফলপ্রসু আলোচনা হয়েছে। কাল সকালে আমি বিধানসভায় বিবৃতি দেব’। 


রাত দশটা নাগাদ বাসিন্দে যখন এই খবর পৌঁছালো, ততক্ষণে সব চুলাই প্রায় নিভে গেছে। সকালে উঠে ফের সড়কে নেমে পড়ার টাইমলাইন নিয়েই কথা চলছিল। তার মধ্যেই জয়ের খবর আসার খুশিতে উদ্বেল গোটা মাঠ। ঘন ঘনই স্লোগান উঠছে। কিন্তু এর মধ্যেই নির্দেশ এসে গেছে কিষাণ সভার নেতৃত্বের তরফে। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকেই পোড় খাওয়া নেতৃত্ব এখনই আন্দোলন তুলতে নারাজ। আপাতত বাসিন্দেই বসে থাকার নির্দেশ এসেছে। আগামী দুদিনের মধ্যে সরকার প্রাসঙ্গিক নির্দেশ জারি করলে, তবেই অন্য কিছু ভাবা হবে।

Comments :0

Login to leave a comment