উচ্ছেদের মুখে এরাজ্যের শতাধিক কলোনি ও বস্তি। মমতা ব্যানার্জির সরকারের প্রত্যক্ষ মদতে বুলডোজারের সামনে ঘর গৃহস্থালির বস্তিজীবন।
গত আগস্ট মাসেই নবান্নে রাজ্যের মুখ্যসচিবের উপস্থিতিতে জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষ ও পূর্ত দপ্তরের সঙ্গে একটি বৈঠক আয়োজিত হয়েছিল। এরাজ্যের জাতীয় সড়ক সম্প্রসারণের জন্য বস্তিবাসী ও কলোনির বাসিন্দাদের উচ্ছেদ করার এক বিস্তৃত পরিকল্পনা ওই বৈঠক থেকেই গ্রহণ করা হয়েছে। হাওড়া, উত্তর ২৪ পরগণা ও পশ্চিম বর্ধমান এই তিন জেলার জেলা প্রশাসনের তরফ থেকে শীর্ষ আধিকারিকরা ছিলেন বৈঠকে। সূত্রের খবর, বস্তিবাসীদের ওপর চাপ তৈরি করার জন্য জমি-বাড়ি ছেড়ে না উঠলে সরকারের সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প থেকে নাম বাদ দেওয়ার হুমকি দেওয়ার জন্য প্রশাসন থেকে পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
গোটা রাজ্যজুড়েই বিভিন্ন প্রান্তে প্রায় যোগী সরকারের কায়দায় বুলডোজার নামিয়ে উচ্ছেদ অভিযানের পথে যাচ্ছে রাজ্য ও কেন্দ্র দুই সরকারই। আর উচ্ছেদের মুখে পড়ে বস্তিবাসী থেকে কলোনির বাসিন্দাদের চোখ খুলছে মমতা ব্যানার্জির সরকারের ভুয়ো দলিল দান।
জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে ইতিমধ্যেই হাওড়ার কোনা এক্সপ্রেস লাগোয়া নারায়ণ পল্লির পাঁচটি পরিবারের কাছে চলে এসেছে ভিটেমাটি ছেড়ে উচ্ছেদের নোটিস। আপাতত পাঁচটি পরিবার। বিপদের প্রহর গুনছে আরও প্রায় ১৭টি পরিবার। উচ্ছেদ হওয়ার পরিবারগুলির কাছে রাজ্য সরকার তুলে দিয়েছিল জমির অধিকারের ‘নিঃশর্ত দলিল’। সরকারি সেই দলিলের কাগজ নিয়ে জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষের কাছে পুর্নবাসনের দাবি জানাতে গিয়েছিল উচ্ছেদের নোটিস পাওয়া পরিবার। রাজ্য সরকারের কাগজকে আদপেই দলিল বলে মানতেই চায়নি জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষ।
জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ঘাড়ধাক্কা খেয়ে কোনা এক্সপ্রেস লাগোয়া নারায়ণ পল্লির উচ্ছেদের মুখে পড়া পরিবারগুলি যোগাযোগ করেছিল রাজ্য সরকারের ভূমি দপ্তরের অধীন উদ্বাস্তু পুনর্বাসন দপ্তরের সঙ্গে। দপ্তরেরই ‘নিঃশর্ত দলিল’-এর কাগজ দেখে আধিকারিকের বক্তব্য ছিল,‘‘ এটাই তো হওয়ার কথা। মন্ত্রীসভা সিদ্ধান্ত করে আমাদের সাপ বললে আমরা সাপ বলবো। ব্যাঙ বললে আমাদের ব্যাঙই বলতে হবে। এখন আপনারা আমাদের অভিযোগ জানিয়ে চিঠি দিলে আমরা সেই চিঠি নবান্নে পাঠিয়ে দেব। এর বেশি আমাদের কিছু করার নেই।’’
উচ্ছেদের মুখে পড়ে বস্তি থেকে কলোনিবাসীদের কাছে ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে রাজ্যে সরকার নিঃশর্ত দলিলের নামে যে কাগজ দিয়েছে তা আসলে ভুয়ো। গত ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে ঘটা করে রাজ্য মন্ত্রীসভার বৈঠকে একটি সিদ্ধান্ত করেছিলেন মমতা ব্যানার্জি। মুখ্যমন্ত্রী ওই সময় ঘোষণা করেছিলেন,‘‘ রাজ্য সরকারের যত কলোনি আছে সব আইনত স্বীকৃতি করে দেওয়া হয়েছে। তারা সময়, সময় পাট্টা পেয়ে যাবে। কেন্দ্রীয় সরকারের যত জমি আছে কয়লা, রেল মন্ত্রকের জমিতে যারা বসবাস করছে তাদের উচ্ছেদ করা যাবে না। আইন করে দেওয়া হয়েছে। বেসরকারি জমিতেও যারা বাস করছে তাদের জমি থেকে উচ্ছেদ ঠেকাতে আইন করে দেওয়া হয়েছে।’’ সরকারের সেই আইনেই রাজ্য সরকারের জমি, রেলের জমি, কেন্দ্রীয় সরকারের অন্যান্য মন্ত্রকের জমি এমনকি বেসরকারি জমিতে যারা বসবাস করছিলেন গত বিধানসভা ভোটের আগে ‘নিঃশর্ত দলিল’ তুলে দিয়েছিল রাজ্য সরকার।
এখন দলিল প্রাপক ভুক্তভোগীরা জানতে পারছেন, ওটা কোনও সরকারি দলিল নয়। ওই দলিল আসলে ‘দখলিসত্ত্ব’এর কাগজমাত্র। ‘‘ জমি অধিগ্রহণ না করে বা জমি হস্তান্তর না করে দলিল দেওয়াই যায় না। অন্যের জমিকে কী করে রাজ্য সরকার দলিল দিতে পারে। জমি আগে রাজ্যের উদ্বাস্তু পুনর্বাসন দপ্তরের হাতে নিতে হবে। জমির মালিক রাজ্য সরকার হলেই তবে সেই জমির নিঃশর্ত দলিল রাজ্য দিতে পারবে।’’ জানিয়েছেন রাজ্যের ভূমি সংস্কার দপ্তরের এক আধিকারিক।
তাহলে রেল বা অন্য কেন্দ্রীয় সরকারের জমিতে বসাবাসকারীদের যে দলিল রাজ্য দিচ্ছে তা আসলে জমিতে বসবাসকারী হিসাবে একটি স্বীকৃতিমাত্র। ‘‘ নিঃশর্ত দলিলের ফরম্যাট পর্যন্ত বদল করে দেওয়া হয়েছে। বাস্তুহারা কথাটি পর্যন্ত প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। তার পরিবর্তে ওই জমিতে বাস করার স্বীকৃতি দেওয়া একটি কাগজকে নিঃশর্ত দলিল বলে দেওয়া হচ্ছে।’’ জানাচ্ছেন উদ্বাস্তু পুর্নবাসন দপ্তরের আধিকারিকরাই। সরকারের তথাকথিত সেই নিঃশর্ত দলিল নিয়ে এখনও একজন কলোনি ও বস্তিবাসী ভূমি সংস্কার দপ্তর থেকে পরচা তুলতে পারেননি।
একদিকে ভুয়ো দলিল দিয়ে বস্তিবাসী মানুষকে প্রবঞ্চনার মুখে ঠেলে দেওয়া। একইসঙ্গে বুলডোজার নামিয়ে সেই বস্তিবাসী মানুষকে জোর করে জমি থেকে উচ্ছেদ করতে নেমেছে রাজ্য সরকার।
কোনা এক্সপ্রেসের রাস্তা সম্প্রসারণের জন্য যে কোনও সময় হাত পড়তে পারে নারায়ণ পল্লির আশেপাশের লক্ষ্মী কলোনি, সরস্বতী কলোনি, সর্বমঙ্গলা কলোনির গরিব মানুষের ওপর। দক্ষিণ পূর্ব রেল ও জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষের মাঝখানে সাঁড়াশি চাপে ফি দিন উচ্ছেদ আতঙ্ক নিয়ে রাত কাটাতে বাধ্য হচ্ছেন বস্তিবাসী মানুষ। রাজ্য সরকারের তথাকথিত নিঃশর্ত দলিল কোনও কাজে আসছে না।
ভুয়ো দলিল নয়, স্বীকৃত কলোনির বাসিন্দা হিসাবে নিঃশর্ত দলিল হাতে নিয়েও উচ্চেদের মুখে উত্তরবঙ্গের মাটিগাড়া এলাকার প্রায় ১৫ হাজার পরিবার। ফি দিন বুলডোজার নামছে কলোনির ওপর। ভিটে মাটি রক্ষার জন্য বুলডোজারকে রুখে দিয়েই বাঁচতে হচ্ছে গরিব মানুষকে। দলিল হাতে থাকার পরেও রাজ্য সরকার গরিব মানুষের জীবনমান রক্ষায় কোনও ভূমিকা পালন করছে না।
বারাকপুর- কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়ে সম্প্রসারণের জন্য নবান্নে আগস্ট মাসেই জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সভা করেছে রাজ্য সরকার। সেই এক্সপ্রেস ওয়ের সামনে একটি বিরাট আবাসন প্রকল্প লাগোয়া প্রায় ৩ হাজার বস্তিবাসী মানুষের বাস। একদফা বুলডোজার এসে গুঁড়িয়ে দিয়ে গেছে বস্তিবাসীদের ঘর। লড়াই করে ফের মাথা তুলছে বস্তির মানুষজন। এবার সরকার নামছে বারাকপুর কল্যাণী এক্সপ্রেস ওয়ের প্রথম পর্যায়ের সম্প্রসারণের জন্য। একইভাবে ৩৫ নং জাতীয় সড়ক সম্প্রসারণের জন্য কাজিপাড়া, অশোকনগর, হাবড়া গেট ১, হাবড়া গেট ২ ও বনগাঁয় ফ্লাইওভার তৈরির জন্য বিপুল সংখ্যায় উচ্ছেদ অভিযানের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয়েছে। মালদহের ফারাক্কা ব্যারেজ সংলগ্ন প্রায় ৭টি কলোনির বাসিন্দাদের প্রতিনিয়ত উচ্ছেদের আতঙ্ক তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে।
পুনর্বাসন ছাড়া জমি না ছাড়ার সিদ্ধান্তে অটল এরাজ্যের বস্তিবাসী ও কলোনির মানুষজন। রাজ্যের উন্নয়নের পথে তাঁরা বাধা হবেন না, কিন্তু পুনর্বাসন ছাড়া জমি থেকে কোনোভাবেই তাঁরা উঠবেন বলে স্থির করেছে। সম্মিলিত কেন্দ্রীয় বাস্তুহারা পরিষদ আগামী ২১ সেপ্টেম্বর সরকারের অমানবিক উচ্ছেদের বিরুদ্ধে কলকাতার আলিপুরের সার্ভে বিল্ডিং দপ্তরের বিক্ষোভের কর্মসূচি নিয়েছে। ইউসিআরসি’র নেতা দীপ ভট্টাচার্য জানিয়েছেন,‘‘ পুনর্বাসন ছাড়া কোনও উচ্ছেদ আমরা মানবো না।’’
Comments :0