Panchayat vote 2023

ঐক্যের বর্ম গড়ে ভোট রক্ষা মানুষের

রাজ্য

 সাহস ছিল গ্রামেই। মমতা-শাসনে এতদিন তা থেকেছে সহ্যের খোলসে। যাঁরা শেষ পর্যন্ত ইতিহাস গড়েন, নিজেদের তাগিদে আক্রমণের মুখে বর্ম গড়ে তোলেন ঐক্যের, তাঁরাই, সেই মানুষই, শনিবার রুখেছেন ভোট লুটেরাদের। 
কমরেড জ্যোতি বসুর জন্মদিনে ‘জনগণের পঞ্চায়েত’ গড়ে তোলার সংগ্রামে নিঃসন্দেহে সেই মানুষই নতুন দৃষ্টান্ত গড়ে তুলেছেন এই বাংলায়। শনিবার আতঙ্কের মুখোমুখি মানুষের ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে — নির্বাচনী ময়দানে। 
তাঁরা আশা করেছিলেন আধা সামরিক বাহিনী। পাননি। তাঁরা পুলিশের কাছে কিছুই আশা করেননি। তাঁরা জানতেন তাঁদের ঘৃণা ন্যায্য — তৃণমূল হামলা করবেই। বুথ দখল করতে চাইবেই। তাই তাঁরা, সেই ‘জনগণ’ নেমেছিলেন রাস্তায়। এদিন, অনেকদিন পর একটি বৈশিষ্ট্য বড়ো স্পষ্ট ছিল — ভোটটি দিয়ে বাড়িতে ঢুকে পড়া মানুষ ছিলেন কম। যাঁরা ভোট দিয়েছেন, তাঁরা থেকেছেন বুথের আশেপাশে। যাঁরা বাড়ি গেছেন, ফের এসেছেন। ভোট এদিন উৎসবের ছিল না। ভোট ছিল — সতর্কতার।
আর এই ক্ষেত্রে যা তাৎপর্যপূর্ণ তা হলো — মহিলাদের দেখা গেছে  অত্যন্ত সাহসী ভূমিকায়। সুতাহাটায় কী দেখা গেল? একটি বুথ দখল করতে এসেছিল তৃণমূলের দুষ্কৃতীরা। যাঁদের ভোট দেওয়া বাকি তাঁরা তো ছিলেনই, যাঁদের ভোট দেওয়া হয়ে গিয়েছিল, তাঁরাও বেরিয়ে এলেন। তাঁদের মধ্যে অনেক মহিলা। ‘আমাদের গ্রাম, আমাদের বুথ, ভোট আমাদের, তুই কাড়তে আসিস? কত বড় নেতা তুই?’ — এমন বলতে বলতে মহিলা, যুবকরা চেনা তৃণমূল নেতা অভিষেক দাস এবং তার নিয়ে আসা দুষ্কৃতীদের ধাওয়া করে। দুষ্কৃতীরা পালায়। গ্রামবাসীরা এবার সেই তৃণমূল নেতার বাড়ির সামনে হাজির হয়। বিপত্তি বুঝে তখন তৃণমূল নেতার বাড়ি রক্ষা করতে হাজির হয় পুলিশ। চিৎকার করতে থাকেন মহিলারা। যুবকরাও ক্ষিপ্ত। রুখে দেন তাঁরা ভোট লুটেরাদের। 
রানিগঞ্জও এমনই দেখেছে। রাজ্যের কয়লাঞ্চল, মুমূর্ষু শিল্পাঞ্চল লাগোয়া সেই ব্লকের জেমারি পঞ্চায়েতের ৩৪,৩৫, ৩৬ নং বুথে এদিন সকাল থেকে আতঙ্ক সৃষ্টির চেষ্টা করে তৃণমূল। জেমারি স্টেট ব্যাঙ্কের সামনে জমায়েত হয় দুষ্কৃতীরা। সঙ্গে সঙ্গে অভিযোগ জানানো হয় রাজ্য নির্বাচন কমিশনকে। রাজ্য নির্বাচন কমিশন ও রাজ্য সরকারের পুলিশ  নির্লিপ্ত থাকায় তৃণমূলের গুন্ডাবাহিনী বুথ দখল করার চেষ্টা করে। গ্রামের মহিলা-পুরুষ নির্বিশেষে প্রতিরোধ করেন। দুষ্কৃতীরা ভেবেছিল হেলায় সরিয়ে দেবেন মহিলা, পুরুষদের। তা হয়নি। সরে যেতে হয়েছে তৃণমূলীদেরই।
এদিন সকালে কাঁকসার বাবনাবেড়া অঞ্চলের ৪৭১ নম্বর বুথে শনিবার সকাল থেকে শান্তিপূর্ণভাবেই ভোট গ্রহণ চলছিল। কিন্তু বেলার দিকে হঠাৎই তৃণমূলের বাইকবাহিনী বুথ লুঠ করতে আসে। বহিরাগত দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে গ্রামবাসীরা রুখে দাঁড়ানোয় সেই পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। উত্তেজিত জনতার প্রতিরোধের মুখে পড়ে দুষ্কৃতীরা বাইক ফেলে দৌড়ে পালিয়ে যায়। এরপরই গ্রামের মানুষ দুষ্কৃতীদের ফেলে যাওয়া দুটি বাইক ভাঙচুর করে তাতে আগুন লাগিয়ে দেয়। পরে পুলিশ এসে এলাকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
দাসপুর-১ নং ব্লক, নিচ নাড়াজোল গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার হাজাকুণ্ডু বুথ দখল করতে এলে বাইক বাহিনী ঘিরে তুমুল জনরোষ ছড়িয়ে পড়ে। অনেকগুলি বাইক ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয় জনতা। তৃণমূলের বাইক বাহিনী রাস্তায় দাপিয়ে বেড়িয়ে বুথের মুখে ক্ষিপ্ত জনতার ঘেরাটোপে পালানোর পথ পায়নি। বাইক ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে জেলার দাসপুর, মোহনপুর, নারায়ণগড় সহ বহু জায়গায়। দরজা লাগিয়ে ছাপ্পা ভোট চলায় ক্ষিপ্ত ভোটার সেই বুথের দরজা ভেঙে ব্যালট বাক্স ভেঙে গুঁড়িয়ে জলে ফেলে দেয় এমন ঘটনা নারায়ণগড় ব্লকের হেমচন্দ্র গ্রাম পঞ্চায়েতের গুড়তলার ২টি বুথ,  চন্দ্রকোনা-১ নম্বর ব্লকের খাপুর গাংচা বুথে এবং মোহনপুর ব্লকের সাউটিয়ার ২টি বুথে।  
বাঁকুড়ার খাতড়া কী দেখেছে? সেখানে ১নং পঞ্চায়েতের মুসলিম পাড়ার বুথে খাতড়ার বিভিন্ন এলাকা থেকে তৃণমূল সশস্ত্র দুর্বৃত্তদের জড়ো করে। হামলার চেষ্টা করে। কিন্তু গ্রামবাসীরা হটেননি। তাঁরাই হটিয়ে দেন দুষ্কৃতীদের। পুলিশ চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল। তৃণমূলের দুষ্কৃতীরা এলাকাছাড়া হতে বাধ্য হয়। বড়জোড়ার গদারডিহি অঞ্চলের জগন্নাথপুরে তৃণমূলের দুর্বৃত্তরা দুপুরের পর ছাপ্পা মারতে শুরু করে। গ্রামের মহিলারা যাঁরা কিছুক্ষণ আগে ভোট দিয়ে এসেছেন, তাঁরা ফিরে আসেন বুথের কাছে। তৃণমূলের বাহিনীর সামনে মহিলারাই এগিয়ে যান। তাঁরা সেখানেই থামেননি। বুথের ভিতরে ঢুকে তৃণমূলের ছাপ্পা দেওয়া ব্যালট বক্স নিয়ে নেন তাঁরা। মহিলারা বলতে থাকেন, প্রশাসন আগে ব্যবস্থা করুক। না হলে আমরাই এর শিক্ষা দেব। বিকালে এই অঞ্চলের দধিমুখা গ্রামেও তৃণমূলবাহিনী ভোট লুটের জন্য জড়ো হয়েছিল। মানুষ সেখানেও তাদের তাড়িয়ে দেয়।
জলপাইগুড়ির করলা ভ্যালি চা বাগানের মুন্ডা বস্তি ক্ষুদিরাম পল্লিতে বুথ দখল করতে আসা তৃণমূলের দুষ্কৃতীদের প্রতিরোধ করে এলাকা ছাড়া করেন গ্রামবাসীরা। পঞ্চায়েতের সিপিআই(এম) প্রার্থী অঞ্জনা বারা ও পঞ্চায়েত সমিতির সিপিআই(এম) প্রার্থী উৎপলা মণ্ডল বুথের ভেতরে মানুষকে আহ্বান করেন বুথ দখল রুখে নিজের ভোট নিজে দেওয়ার জন্য তারপরই ভোটাররা এগিয়ে এসে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। এলাকা ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয় দুষ্কৃতী বাহিনী।
নদীয়ার কল্যাণীও দেখেছে প্রতিরোধ। সেখানে শিমুরালি অঞ্চলের ৪২নং বুথে বেলা ২টো নাগাদ হার নিশ্চিত বুঝে তৃণমূলের জেলা পরিষদের প্রার্থীর ভাই এবং আরও কিছু দুষ্কৃতী বুথ দখল করে ছাপ্পা মারতে শুরু করে। গ্রামবাসীরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। তাঁরা বুথ ঘিরে ফেলেন। দুষ্কৃতীরা পালায়। নদীয়ারই বড় আন্দুলিয়ায় ভোট লুট করতে যাওয়া চাপড়া হাঁটরা এলাকার দুষ্কৃতীদের বাইক বাহিনীকে রুখে দেন গ্রামবাসীরা। দুষ্কৃতীরা সশস্ত্র ছিল। গ্রামবাসীরাও মরিয়া ছিলেন। দুষ্কৃতীরা পালানোর চেষ্টা করে। কিন্তু একজন দুষ্কৃতীকে গ্রামবাসীরা ধরে ফেলেন। তাঁকে গাছে বেঁধে রাখা হয়। পরে পুলিশের হাতে ওই দুষ্কৃতীকে তুলে দেওয়া হয়।
 

 

 

Comments :0

Login to leave a comment