Non net scholarship

কেন্দ্র দেয় না, গবেষণার টাকা দিচ্ছে না রাজ্যও

রাজ্য কলকাতা

দেশে বিজেপি সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পরপরই প্রথম লক্ষ্যবস্তু ছিল দেশের বিজ্ঞান ভিত্তিক শিক্ষা কাঠামোর মূলে আঘাত হানা। সেই উদ্দেশ্যে উচ্চশিক্ষায় ক্রমান্বয়ে কমিয়ে আনা হয় ব্যয় বরাদ্দের পরিমাণ। যার অভিঘাতে কোপ পড়ে নন নেট ফেলোশিপে। 

নন নেট ফেলোশিপের ওপর নির্ভর করে অসংখ্য গবেষকের গবেষণার খরচা চালিয়ে যাওয়ার প্রশ্নটি। ফেলোশিপ বন্ধ করে দেওয়ায় সামগ্রিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় দেশব্যাপী এমফিল এবং পিএইচডি গবেষণার প্রক্রিয়া। 

সেই সময়ে রাজ্যের তৃণমূল সরকারের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি ঘটা করে ঘোষণা করেন যে কেন্দ্র এই ভাতা বন্ধ করে দিলেও তিনি তার রাজকোষের সীমিত ভাঁড়ার থেকে ভাতা দেবেন সমস্ত ‘নন নেট’ গবেষকদের। কিন্তু ঘোষণা রয়ে গেছে ঘোষণার স্তরেই। 

স্বামী বিবেকানন্দ মেরিট কাম মিন্স স্কলারশিপ নামে যে প্রকল্প চালু করা হয় তাতে শুরু থেকেই অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। দুবছরের এমফিল গবেষণায় দুই থেকে সাত মাসের বেশি স্কলারশিপ মেলেনি রাজ্যের প্রায় কোনো গবেষণা কেন্দ্র বা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের। একই অবস্থা পিএইচডি গবেষকদের ক্ষেত্রেও। অনিয়মিত। টাকা ঢুকলেও সাত-আট মাস বাদে দু মাস কি তিন মাসের টাকা ঢুকে আর কোনো সাড়া শব্দ নেই। 

অন্তত যাদবপুরকলকাতাআইডিএসকে-এর গবেষকদের অভিজ্ঞতা তাইই বলছে। ৭ মাস পেরিয়ে যাওয়ার পরেও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের এম ফিল গবেষকদের অনেকেই তাদের নন নেট ফেলোশিপ পাননি। এমনকি সম্প্রতিক সময়ে দেখা গেছে স্কলারশিপ পাওয়ার আবেদন করার অনলাইন পোর্টাল খুলছে না বলা হচ্ছে ‘‘মেরামতির কাজ চলছে। ধৈর্য ধরুন।’’ 

ধৈর্য ধরে রাখতে না পেরে এই অবস্থার দ্রুত সমাধানের দাবি জানিয়ে ভারতের ছাত্র ফেডারেশন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় আঞ্চলিক কমিটির পক্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে ডেপুটেশন দেওয়া হয়। উপাচার্য জানান, গবেষকদের একটি প্রতিনিধি দল বিকাশ ভবন গিয়ে কথা বলে আসবে এই বিষয়ে। এরপরে সেই প্রতিনিধি দল বিকাশ ভবনে গেলে তাদের বলা হয়বিশ্ববিদ্যালয়ের যাঁরা আবেদন করে বসে আছেন তাঁদের বরাদ্দ টাকা বিকাশ ভবনের তরফে তৈরি রাখা হয়েছে। কিন্তু এসভিএমসির যে পোর্টাল বেশ কিছুদিন আগে খারাপ হয়ে পড়ে রয়েছে তা ৫ অক্টোবর মুখ্যমন্ত্রীর উদ্বোধন করার কথা ছিল সেই সময়ে পৌরভোট, উত্তরবঙ্গ এবং গোয়া সফরে ব্যস্ত হয়ে পড়েন বলে যুক্তি প্রশাসনের। তার পরও চালু হয়নি পোর্টাল। 

বিকাশ ভবনের তরফে আরও জানানো হয়পোর্টাল উদ্বোধন হয়ে চালু হলেই গবেষকরা টাকা পেয়ে যাবেন। কিন্তু উদ্বোধন কবে হবে তা একমাত্র মুখ্যমন্ত্রীই জানেন। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে হাতে গোনা কয়েকজন তৃণমূল ছাত্র পরিষদ কর্মী-সমর্থক তথা এমফিল গবেষক সময়মতো ভাতা না পাওয়ায় মাঝপথেই কোর্স ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবছে। 

কেন্দ্র এবং রাজ্যের দড়ি টানাটানিতে চরম আর্থিক সংকটে ভুগছে যাদবপুর। আর্থিক সঙ্কট কাটাতে প্রাক্তনীদের দ্বারস্থ হতে হয় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় (Jadavpur University) কর্তৃপক্ষকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনীদের থেকে অর্থ সাহায্য চেয়ে চিঠি লেখেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সুরঞ্জন দাস। যাদবপুরের ‘গ্লোবাল অ্যালামনি ফাউন্ডেশন’-র কাছে সেই চিঠি পাঠানো হয়েছে। বছরে প্রায় ৫০ কোটি টাকা লাগে বিশ্ববিদ্যালয়ের দৈনন্দিন কাজ চালাতে। সেখানে কেন্দ্র এবং রাজ্যের বদান্যতায় বছরে ৩০ কোটি টাকার মতো ঘাটতিতে চলতে হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়কে। হাত দিতে হচ্ছে জমানো অর্থে। রাষ্ট্রীয় উচ্চতর শিক্ষা অভিযান প্রকল্পের টাকা আটকে রয়েছে বলে খবর। কেন্দ্রীয় এই প্রকল্পের পুরো টাকা আসেনি বলে দাবি বিশ্ববিদ্যালয়ের। অন্যদিকে রাজ্য সরকার থেকে যে পরিমাণ টাকা আসার কথাতাও আসছে না বলেই অভিযোগ রয়েছে যাদবপুরে বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক সংগঠনের (JUTA)

যাদবপুরের মতো একই অবস্থা প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়েরও (Presidency University)। ছাত্র সংসদ কোনও দাবি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দেখা করতে গেলেওশোনানো হচ্ছে অর্থ সংকটের কথা। ছাত্র সংসদের সহ সাধারণ সম্পাদক দিপ্রজিৎ দেবনাথ বলেন, ‘‘হোস্টেলের ফি বাড়ানো হয়েছে। পড়ুয়াদের বেশি টাকা দিতে হচ্ছে এখন। যখন আমরা কর্তৃপক্ষের কাছে এই বার্তা নিয়ে যাচ্ছিতখন কর্তৃপক্ষ বলছে সরকার থেকে টাকা দেওয়া হচ্ছে না।’’

আইডিএসকে-তেও (Institute of Development Studies Kolkata) পরিস্থিতির কোনো হেরফের নেই। দু বছরের এমফিল গবষণাকালে প্রথম বছরের কিছু মাসের ভাতা পাওয়ার পরে তা কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে বলে জানান নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আইডিএসকে-এর এক এমফিল গবেষক। তাদের ব্যাচের ১৪ জনেরই একই অভিজ্ঞতা। এছাড়াও সেখানকার বর্তমান নন নেট পিএইচডি গবেষকদেরও একই অভিজ্ঞতা।  ‘‘খেলা,মেলায়,পুজোয় টাকা ঢাললে গবেষণায় দেওয়ার জন্য টাকা কোথা থেকে আসবে সরকারের?’’ কটাক্ষ করেন ওই গবেষক। একই সঙ্গে তিনি জানানআইডিএসকে-এর তরফে বারবার এই বিষয়ে বিকশ ভবনে যোগাযোগ করা হলে দুর্ব্যবহার করাফোন না ধরাদেখা না করাই-মেইলের জবাব না দেওয়া কিংবা রাজ্যের কোষাগারে টাকা নেই ইত্যাদি বলে এড়িয়ে যাওয়ারও অভিযোগ করেন তিনি।

অন্যদিকে চিত্র কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে (University of Calcutta) নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তিনজন পিএচডি গবেষকের কথাতেও উঠে আসছে এক অভিযোগ। তাঁরা বিকাশ ভবনে যোগাযোগা করেন। বিকাশ ভবন বলেছেএকটাই পোর্টালে রাজ্যের যাবতীয় শিক্ষা ও সামাজিক ভাতার কাজ পরিচালনা করায় কার্যত ভেঙে পড়েছে পোর্টালটি। প্রত্যেকটি প্রকল্পের জন্য আলাদা আলাদা পোর্টাল বা অন্য ব্যবস্থাপনা না হওয়া পর্যন্ত কিছুই করা সম্ভব নয়। সেই কাজ চলছে। কিন্তু কবে তা শেষ হবে সেই উত্তর অজানা। 

এই পরিস্থিতিতে কার্যত গভীর সংকটের মুখে পড়েছেন গবেষকদের একটি বিরাট অংশ। এই স্কলারশিপের ওপর নির্ভর করে থাকেন প্রান্তিক পরিবার থেকে উঠে আসা পড়ুয়াদের একটি বড় অংশ। গবেষণা চালাতে গেলে বইপত্রপত্রিকাইন্টারনেট সহ আরো অনেক জিনিসের জন্য প্রয়োজন অর্থের। তা বন্ধ হয়ে যাওয়ার (বলা ভাল বন্ধ করে দেওয়া) অর্থ গবেষণার ভবিষ্যৎ প্রশ্নের মুখে পড়ে যাওয়া। যা মানব সম্পদ উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। শুধু রাজ্যেই নয়দেশেও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা গেছে মাঝপথেই গবেষণা ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন গবেষকরা। বিশেষত প্রান্তিক পরিবার থেকে উঠে আসা গবেষকরা। 

কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলির অনেকেরই নিজস্ব কিছু স্কলারশিপ প্রকল্প থাকে এবং তা থেকে ভাতা দেওয়া হলেও তা অত্যন্ত অনিয়মিত। তাতে টিকে থাকা দায় হয়ে পড়ে। ‘‘একদিকে স্ট্যাচু তৈরিসেন্ট্রাল ভিস্তা তৈরির জন্য হাজার হাজার কোটি টাকা ঢালতে পারে। আরেকদিকে রাজ্যে উৎসব ভাতা দিতে পারে জনগণের করের টাকা থেকে। অথচ লেখাপড়ার খাতে টাকা দিতে পারে না। এর ফলে দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা পড়ুয়াদের পড়াশোনা ছেড়ে দিতে হচ্ছে। পরিকল্পনা করেই শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করছে দুই সরকার,’’ প্রতিক্রিয়া এসএফআইর সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক ময়ূখ বিশ্বাস।

Comments :0

Login to leave a comment