Panchayat vote 2023

মৃত ১৬, আহত অনেক

রাজ্য

 মৃত্যু হলো ১৬জনের। বোমায়, গুলিতে। আহত হয়েছেন অন্তত ১০০জন। তাঁদের মধ্যে মহিলা আছেন, বৃদ্ধ আছেন, আছে শিশুও। তৃণমূল বুথ দখল করেছে। ছাপ্পা দিয়েছে— দেদার। বেআইনি অস্ত্র উঁচিয়ে, বোমা হাতে শাসাতে দেখা গেছে মমতা ব্যানার্জির দলবলকে। তবু এই হিংসা, তাণ্ডবের মধ্যে জেগে থেকেছে প্রতিবাদ। অনেক জায়গায় তা প্রতিরোধও। 
দশম পঞ্চায়েত নির্বাচন চোর আর দুষ্কৃতীদের তাণ্ডব দেখল। কতটা হিংস্র ছিল তৃণমূলীরা? হাওড়ার একটি উদাহরণ দেখা যাক। পাঁচলার জুজারসাহার মালিপুকুর গ্রামে কবি নজরুল ইসলাম মাদ্রাসা শিক্ষা কেন্দ্রের বুথে ছাপ্পা ভোট দিচ্ছিল তৃণমূল। বামফ্রন্ট প্রার্থী শেফালি দাসকে ভোটকেন্দ্রে ও তাঁর এজেন্ট রবীন্দ্রনাথ সাঁতরাকে ঢুকতে দেয়নি তৃণমূলীরা।   প্রতিবাদ করলে বামফ্রন্ট সমর্থক ফটিক ধাড়াকে মারধর করা হয়। রবীন্দ্রনাথ সাঁতরা বুথে ঢুকতে বাধা পেয়ে বাড়ি যান। দুপুরের ভাত সবে খেতে বসেছিলেন, সেই সময় রবীন্দ্রনাথের ভাতের থালায় জখম ফটিক ধাড়াকে নিয়ে এসে ফাটা আঙুল চেপে ভাতের ওপর রক্ত ছিটিয়ে দিয়ে তৃণমূলী বলে, ‘ভাত নয়, রক্ত খা।’
তবে শনিবার দেখালো মানুষের রুখে দাঁড়ানোও। সিপিআই(এম) কিংবা বামফ্রন্ট, কংগ্রেস কিংবা আইএসএফ কর্মীরাই শুধু নন। রুখে দাঁড়িয়েছেন কোনও রাজনৈতিক দলের কর্মী নন, এমন গ্রামবাসীরা। এবং যা আরও ইঙ্গিতবহ— সুতাহাটায় দেখা গেছে বহিরাগত বাইকবাহিনীর বিরুদ্ধে বুথ দখল রুখতে রাস্তায় বেরিয়ে এসেছেন মহিলারা। এমন ছবি রাজ্যের আরও জেলায় এদিন দেখা গেছে। এই প্রতিরোধ অনেক জায়গাতেই মানুষের তীব্র ঘৃণার প্রকাশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেমন হয়েছে কুলতলিতে। সন্ধ্যায় সেখানকার জ্বালাবেড়িয়ায় ছাপ্পা দেওয়ার চেষ্টা করছিল তৃণমূল। ক্ষিপ্ত গ্রামবাসীরা তাড়া করে একজনকে ধরে। খুবই মার খায় ওই তৃণমূলী ‘ভোট কর্মী।’ ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়।
এদিন রাত পর্যন্ত ভোট গ্রহণ চলেছে অনেক জায়গায়। কারণ নির্বাচন কমিশনের অপদার্থতা, স্থানীয় প্রশাসনের মানুষের অসুবিধা পাত্তা না দেওয়ার কারণে একেকজনের ভোট দিতে অনেকক্ষণ লেগেছে।  
এই রক্তাক্ত নির্বাচন নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেত্রী মমতা ব্যানার্জি একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি। শনিবার রাত ৩টে, ভোর ৪টে এবং ভোর ৫টায় তিনি তিনটি ফেসবুক পোস্ট করেছেন। তিনটিতে ভোটের নামগন্ধ নেই। ভোর ৩টেয় তিনি ‘সেফ ড্রাইভ সেভ লাইফ’-র পোস্টার সেঁটেছেন নিজের ফেসবুক ওয়ালে। ভোর ৪টের পোস্ট প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর জন্মদিন উপলক্ষে। শেষ পোস্টটি কবি সুভাষ মুখার্জির মৃত্যু বার্ষিকী স্মরণ করে। 
সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম এদিন বলেছেন,‘‘প্রতিটি মৃত্যুর জন্য দায়ী মুখ্যমন্ত্রী এবং নির্বাচন কমিশন। মানুষ প্রতিরোধের মেজাজে ভোট দিয়েছেন।’’  
শনিবার দুটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য। বিজেপি এতদিন যতটা গর্জেছিল, নির্বাচনের দিন ততটা বর্ষায়নি। অনেক জায়গাতেই বিজেপি-র নেতা, কর্মীদের দেখা যায়নি তৃণমূলের তাণ্ডবের সামনে। আবার কিছু জায়গায় প্রাক্তন তৃণমূলী বিজেপি প্রার্থীদের কেন্দ্রে তৃণমূল চরিত্রবিরোধী ঝাঁঝহীন ছিল। রাজ্যে বিজেপি’র দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী নিজের বাড়ি থেকে বলেছেন,‘‘প্রহসন হয়েছে। টাকার জন্যই তো এত লুট? টাকা কী করে বন্ধ করতে হয় আমি দেখব।’’ 
কার টাকা কে বন্ধ করবে?
দ্বিতীয় প্রসঙ্গ, রাজ্যের নির্বাচন কমিশন। আরও নির্দিষ্ট করে বললে, নির্বাচন কমিশনার রাজীব সিন্‌হা। সকাল ৭টায় ভোট শুরু হয়। অথচ তিনি অফিসে আসেন ১০টা নাগাদ। রাজ্যে মানুষ খুন হচ্ছেন, আক্রান্ত হচ্ছেন বিরোধী রাজনৈতিক দলের কর্মীরা, বেআইনি রিভলভার বের করে তৃণমূলের উঠতি নেতা শাসাচ্ছে, বোমা পড়ছে শ’য়ে শ’য়ে, বুথে বসে আতঙ্কে কেঁদে ফেলছেন ভোট কর্মী— তখন নির্বাচন কমিশনার বলছেন,‘‘রাজ্যে আইনশৃঙ্খলার বিষয়টি পুলিশের দায়িত্ব। কমিশনের কাজ ব্যবস্থাপনা।’’
অর্থাৎ কমিশন হলো বিয়ে কিংবা শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের ডেকরেটার্স! তবে এত রক্ত, আর্তনাদের দায় কার? মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির। কারণ, তিনিই রাজ্যের স্বরাষ্ট্র (পুলিশ) মন্ত্রী।
আধা সামরিক বাহিনী মোতায়েন নিয়ে নানা চাপানউতোর গত কয়েকদিনে দেখা গেছে। তা নিয়ে মামলাও হয়েছিল। কিন্তু এদিন রাজ্যের বেশিরভাগ বুথে, বুথের আশেপাশে আধা সামরিক বাহিনীকে দেখা যায়নি। তাঁরা যে কোথায় ছিলেন, কী ডিউটি করছিলেন— তা এক রহস্য। তবে নির্বাচন কমিশনার দাবি করেছেন যে, ২৫% বুথে আধা সামরিক বাহিনী ছিল। প্রায় সব জায়গাতেই রাজ্য পুলিশ ছিল। এবং তারা বেশিরভাগই দর্শক ছিল। সিভিক ভলান্টিয়ারদের নির্বাচনে ব্যবহার করা যাবে না, এই ছিল আদালতের নির্দেশ। কিন্তু এদিন সিভিক ভলান্টিয়ারদের দেখা গেছে বুথে, ভোট কেন্দ্রের কাছে— আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে। 
শনিবার মৃত্যু জুড়েছে উত্তর এবং দক্ষিণবঙ্গকে। এদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত কোচবিহারে ২, উত্তর দিনাজপুরে ৩, মালদহে ১, মুর্শিদাবাদে ৫, পূর্ব বর্ধমানে ২, নদীয়ায় ১ এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনায় ২জন নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে ৯জন তৃণমূলের কর্মী। তাদের সবাই বুথ দখল করতে গিয়ে, বিরোধীদের এজেন্ট কিংবা মানুষকে মারতে গিয়ে গণ প্রতিরোধে মারা গেছেন। এছাড়া তৃণমূলের হামলায় ২জন সিপিআই(এম) কর্মী, ৩জন কংগ্রেস কর্মীর মৃত্যু হয়েছে। এদিন মারা গেছেন ২ বিজেপি কর্মীও।
সিপিআই(এম)’র ২ কর্মী নিহত হয়েছেন পূর্ব বর্ধমানের আউশগ্রাম এবং মুর্শিদাবাদের লালগোলায়। লালগোলার একটি স্কুলের বুথে শাসকদলের কর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষ বাঁধে সিপিআই (এম)’র। ভোট দিতে এসে সেই সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে যান রওশন আলি নামে ওই সিপিআই(এম) সমর্থক। বেধড়ক মারধর করা হয় তাঁকে। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথেই মৃত্যু হয় তাঁর। আউশগ্রামে যিনি নিহত হয়েছেন তাঁর নাম রাজিবুল হক। আউশগ্রাম-২ নম্বর ব্লকের বিষ্ণুপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৭ নম্বর বুথে শুক্রবার তৃণমূলের সঙ্গে সংঘর্ষে জখম হয়েছিলেন সিপিআই (এম) কর্মী রাজিবুল। প্রথমে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাঁকে। শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় গভীর রাতে এনআরএস হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয় তাঁকে। শনিবার সকালে সেখানেই মৃত্যু হয় ৩২ বছর বয়সি রাজিবুলের।
গোয়ালপোখরে কুপিয়ে খুন করা হয় মহম্মদ জামিলুদ্দিন নামে এক কংগ্রেস কর্মীকে। তিনি গোয়ালপোখরের জাগিরবস্তি এলাকার বাসিন্দা। নওদাতেও প্রাণ খোয়াতে হল এক কংগ্রেস কর্মীকে। এখানেও তৃণমূলের সঙ্গে ব্যাপক সংঘর্ষ বাঁধে কংগ্রেস কর্মীদের। গুলি চলে বলে অভিযোগ। গুলিতে জখম হন ওই কংগ্রেস কর্মী। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়।
তৃণমূল কর্মীরা নিহত হয়েছেন মুর্শিদাবাদে ৩জন, মালদহে ১জন, পূর্ব বর্ধমানে ১জন, নদীয়ায় ১জন, দক্ষিণ ২৪ পরগনার বাসন্তীতে ১জন এবং উত্তর দিনাজপুরে ২জন। প্রতিটি ক্ষেত্রেই তৃণমূল হামলা করার সময় মানুষের প্রতিরোধে তাদের মৃত্যু হয়। বাসন্তীতে অবশ্য ‘মাদার তৃণমূল’-র ছোঁড়া বোমায় ‘নব্য তৃণমূল’-র কর্মী আনিসুর ওস্তাগরের মৃত্যু হয়।
বিজেপি-র ২কর্মীরই মৃত্যু হয়েছে কোচবিহারে — ১ নম্বর ব্লকের ফলিমারি এবং দিনহাটার ১ নম্বর ব্লকে চিরঞ্জিত কার্জির।
কোচবিহার থেকে গোসাবা— দেদার ভোট লুট করেছে মমতা ব্যানার্জির দল। বারাকপুরের মোহনপুরে দেখা যায় অস্ত্র হাতে বিরোধী দলের কর্মীদের দিকে ছুটে যাচ্ছে তৃণমূলের এক দুর্বৃত্ত। এমন সশস্ত্র তৃণমূলীরা ছিলেন প্রায় প্রতিটি জেলায়। যেমন কোচবিহারে ১৪০০’র বেশি বুথে তিন স্তরেই দেদার ছাপ্পা ভোট দিয়েছে তৃণমূল। তবে এখানে বুথ দখল করেছে বিজেপিও। দেদার ছাপ্পা হয়েছে অভিষেক ব্যানার্জির লোকসভা কেন্দ্র ডায়মন্ডহারবারের অন্তর্গত ব্লকগুলিতে। এছাড়াও এই জেলার আরও কিছু ব্লকের বিভিন্ন অংশে বুথ দখল করেছিল তৃণমূল। একই ছবি উত্তর ২৪পরগনার দেগঙ্গা, বসিরহাটসহ বেশ কিছু ব্লকে। বীরভূমের ময়ূরেশ্বরসহ কয়েকটি ব্লকে ছাপ্পা ভোট দিয়েছে তৃণমূল। পশ্চিম মেদিনীপুরের সবং, পিংলায় রাজ্যের মন্ত্রী মানস ভুঁইঞার দলবল দেদার ভোট লুট করেছে। উত্তর দিনাজপুর, মালদহের কিছু এলাকাতেও একই বুথ-কব্‌জার ছবি দেখা গেছে।
এরই মধ্যে মেখলিগঞ্জ, হলদিবাড়ি ও কোচবিহার-২, মাথাভাঙার ২টি ব্লকের বেশ কিছু এলাকায় শুক্রবার রাত থেকে তৃণমূল ও বিজেপিকে রুখলেন পার্টিকর্মীরা। তাঁরা শনিবার দিনভর সাধারণ ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে নিয়ে আসার পাশাপাশি ব্যালট বক্স বুথকেন্দ্র ছেড়ে যাওয়ার আগে পর্যন্ত বুথ রক্ষা করেছেন। একই ছবি বাঁকুড়ার রানিবাঁধ, রাইপুর, সারেঙ্গা, সিমলাপাল, তালডাংরা এলাকায় দেখা গেছে। ঝাড়গ্রাম, পশ্চিম মেদিনীপুরের অনেক জায়গাতে, আলিপুরদুয়ারে, হুগলীতে, হাওড়ায়, দক্ষিণ ২৪ পরগনার সুন্দরবন এলাকায়, উত্তর ২৪ পরগনার বাদুরিয়াসহ কিছু এলাকায়, বীরভূমের অনেকগুলি জায়গায়, পুরুলিয়াতে, পূর্ব বর্ধমানে, কাঁকসা, জেমুয়াসহ পশ্চিম বর্ধমানের অনেক এলাকায় পার্টিকর্মীরা সারাদিন বুথ আগলে লড়াই করেছেন। 
এদিন নির্বাচন কর্মী হিসাবে যে সরকারি কর্মচারীরা গিয়েছিলেন, তাঁদের অনেককেই তৃণমূল কর্মীরা হেনস্তা করেছেন। তবে তারই মধ্যে বুথের দায়িত্বে থাকা সরকারি কর্মচারীদের কেউ কেউ তৃণমূলের সঙ্গে মিলে ছাপ্পা দিচ্ছেন— এমন দৃশ্য দেখা গেছে কোচবিহারের দিনহাটায়।
 

Comments :0

Login to leave a comment