IPC-Crpc amendment Bill

নয়া সংহিতা, নাম বদলে আরও কড়া ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতা’

জাতীয়

দেশজুড়ে কেন্দ্রের সরকার বিরোধী আন্দোলন দমনে ফৌজদারি আইন ব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নিলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ। রাষ্ট্রদ্রোহিতা আইনের নাম বদল করে তা আরও দানবীয় করার উদ্যোগ নেওয়া হলো। বাদল অধিবেশনের ঠিক শেষ দিনে শুক্রবার তিনি ফৌজদারি আইন বদলের তিনটি বিল লোকসভায় পেশ করেছেন। মোদী জমানায় সেই আইনের নামেও বদল এনেছেন শাহ। নাম দেওয়া হয়েছে সংহিতা। শুধু নামেই বদল। কাজ একই বা ব্রিটিশ আমলের থেকেও আরও দানবীয়। শাহের বিলে আইনের নাম বদল করে যেন অনেকটা মনুসংহিতার বিধি নিয়ম জারির একটা বার্তা দেওয়া হলো। শাহ তিনটি বিল পেশ করে তা সংসদীয় কমিটিতে আলোচনার জন্য পাঠানো হয়েছে বলে সংসদে জানান। শাহ দাবি করেন নয়া সংহিতা আইন চালু হলে দেশে দীর্ঘ দিন চলতে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ আইনের যে ধারা চলছে তার অবসান ঘটবে। বা বলা যায় মোদী জমানায় দেশে অপরাধ দমনের আইনের নতুন ধারা চালু হয়ে যাবে। শাহের দাবি নাগরিকের সুরক্ষা নিশ্চিত করে আইনে সাজা আরও কড়া  করা হয়েছে।
দেশের অপরাধ দমনে আমাদের যে ফৌজদারি আইন বা ইন্ডিয়ান পেনাল কোড (আইপিসি) অ্যাক্ট আছে তা বদলাতে আনা হয়েছে ভারতীয় নয়া সংহিতা বিল। ফৌজদারি প্রক্রিয়া আইন বা ক্রিমিনাল প্রসিডিওর অ্যাক্ট (সিআরপিসি) যা রয়েছে তা বদলাতে আনা হয়েছে  নাগরিক সুরক্ষা সংহিতা বিল। এভিডেন্স আ্যাক্ট বদলাতে আনা হয়েছে ভারতীয় সাক্ষ্য বিল। প্রস্তাবিত ভারতীয় নয়া সংহিতা বিলে পুরানো আইপিসি আইনের ২২ ধারা বাতিল করা হয়েছে, ১৫৭ টি ধারার সংশোধন করা হয়েছে এবং নতুন ৮টি ধারা যুক্ত করা হয়েছে। নাগরিক সুরক্ষা সংহিতা বিলে সিআরপিসি আইনের ৯ টি ধারা বাতিল করা হয়েছে, ১৬০টি ধারায় সংশোধন করা হয়েছে, ৯টি নতুন ধারা যুক্ত করা হয়েছে। ভারতীয় সাক্ষ্য বিলে এভিডেন্স অ্যাক্টের ৫টি ধারা বাতিল করা হয়েছে, ২৩টি ধারা সংশোধন করা হয়েছে এবং একটি নতুন ধারা যুক্ত করা হয়েছে। এতে মোট ১৭০টি ধারা রয়েছে। 
এদিকে আইনজীবী মহল জানাচ্ছেন ভারতীয় নয়া সংহিতা বিলে ও ফৌজদারি আইন বা আইপিসি-তে ব্রিটিশ আমলের দেশদ্রোহিতার ধারাকে আরও দানবীয়  করা হয়েছে। ব্রিটিশদের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের দমনের যে আইনি ব্যবস্থা ছিল তার সেভাবে কোনও বদল দেখা যাচ্ছে না মোদীর সংহিতা আইনে। যেমন আইপিসি’র ১২৪এ ধারাতে রয়েছে দেশদ্রোহিতা দমনের আইনি ব্যবস্থা। মোদীর ভারতীয় নয়া সংহিতা বিলে সেই দমন পীড়নের ব্যবস্থা রয়েছে ১৫০ ধারায়। সংহিতার এই ধারায় বলা হয়েছে, ‘কেউ আইনে প্রতিষ্ঠিত সরকারের বিরুদ্ধে তার শব্দ, তার লেখায় বা কথায় বা কোন প্রতীকে বা কোন দৃশ্যত উপস্থাপনায় বা ইলেকট্রনিক প্রচারে ( ইউটিউব) বা টাকা ছড়িয়ে বা অন্য কোনোভাবে হিংসা বা অবমাননা বা উত্তেজনা সৃষ্টির চেষ্টা, বা সশ্রস্ত্র বিদ্রোহ বা অন্তর্ঘাতমূলক কাজ, বা বিচ্ছিন্নতাবাদী কাজে মদত জোগাবে, যা ভারতের সার্বভৌমত্ব ঐক্য এবং সংহতির ক্ষেত্রে বিপদ সৃষ্টি করবে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এতে অপরাধীর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হবে। বা কম করে সাত বছরের জেল ও জরিমানা হবে।’
সুপ্রিম কোর্ট রাষ্ট্রদ্রোহিতা বা সিডিশন আইন নিয়ে সদ্যই প্রশ্ন তুলেছে। সরকার নতুন আইন না করা পর্যন্ত এই ধারার প্রয়োগ বন্ধ রাখতেও বলেছে। এই অবস্থায় সরকার ‘সিডিশন’ শব্দ তুলে দিয়ে নতুন বোতলে একই পানীয় পেশ করেছে। বরং নতুন বিলে এই ধারায় ‘অপরাধের’ পরিসর আনেকটা বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। যা দেশের সরকার বিরোধী ক্রমবর্ধমান আন্দোলন দমনের একটা বড় হাতিয়ার হয়ে উঠবে বলে মনে করা হচ্ছে। রাষ্ট্রদ্রোহিতা আইনের ১২৪এ ধারা  দেখলেই তা স্পষ্ট হবে। সেই ধারায় বলা হয়েছে,‘ কেউ সরকারের বিরুদ্ধে কোনও শব্দ লিখিত  বা  কথায় বা কোন প্রতীকে বা কোন দৃশ্যত উপস্থাপনায় বা অন্য কোনোভাবে ঘৃণা বা অবমাননা করে উত্তেজনা সৃষ্টি করবে  তাদের বিরুদ্ধে  ব্যবস্থা নেওয়া হয়ে। তাদের যাবজ্জীবন কারদণ্ড বা তিন বছরের কারাদণ্ড ও জরিমানা  ধার্য করা হবে।’ দেখা যাচ্ছে ব্রিটিশ আমলে স্বাধীনতা সংগ্রমীদের দমনে  দেশদ্রোহের যে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে মোদীর জমানায় দেশের  সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে সংগ্রামকে অনেকটাই  দেশদ্রোহের পর্যায়ে নিয়ে আসা হয়েছে। ভারতের ঐক্য, সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলছে মনে করলেই তাঁকে এই আইনে শাস্তি দেওয়া যাবে। নতুন বিলে এমন ভাবে শব্দ চয়ন করা হয়েছে যা বহু ধরনের কাজকেই ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতার’ পরিধিতে নিয়ে আসতে পারে। 
প্রসঙ্গত সুপ্রিম কোর্টে  প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি এভি রামানা বিচারপতি সূর্যকান্ত,বিচারপতি হিমা কোহলির বেঞ্চ এক রায়ে এবং ব্রিটিশ আমলের আইপিসি’র ১২৪এ ধারায়  দেশদ্রোহিতা আইন তুলে দেওয়ার পক্ষে মত দেয়। তাতে সহমত হয় কেন্দ্র। এরপরে মোদী সরকার গঠিত আইন কমিশন এবছর ২৩ এপ্রিলে দেশদ্রোহিতা আইন বহাল রাখার  সুপারিশ করে। কমিশন জানায় বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশদ্রোহ আইন বহাল রেখে তা আর কঠোর করার ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। মোদী  সংহিতায় সেই তার আইন কমিশনের সুপারিশ কার্যকর করেছে। দেশদ্রোহের প্রেক্ষিত বদলে তা সরকারবিরোধী হওয়ায় যাওয়ায় তা দমনে আইন আরও দানবীয় হয়েছে মোদীর সংহিতায়। 
অমিত শাহের পেশ করা বিলে দলবদ্ধভাবে হত্যার সাজা হিসাবে মৃত্যুদণ্ডের কথাও বলা হয়েছে। 
আইনের নামকরণ হিন্দিতে কেন, তা নিয়ে ইতিমধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে। তামিলনাডুর মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্ট্যালিন একে ‘হিন্দি চাপানো’ বলে অভিহিত করেছেন। আইনজীবীরা নজর করিয়েছেন ভারতীয় সংবিধানের ৩২৮ নম্বর ধারায় বলা রয়েছে আইনের নাম হবে ইংরেজিতেই।
 

Comments :0

Login to leave a comment