coromandel express accident

দিন গেলো, জীবিত উদ্ধার হলেন না কেউই

জাতীয়

 শনিবারের ভোর এল প্রায় নৈঃশব্দ্যে। রেলের চারটি ট্র্যাক জুড়ে যেন ছড়িয়ে ছিল প্রলয়-চিহ্ন। ভোরের আলো পড়ছিল ছিটকে পড়া কামরায়, মালগাড়ির উপরে উঠে পড়া ইঞ্জিনে, উল্‌টে থাকা কামরার জানলা থেকে ঝুলে থাকা হাত, পায়ে। মৃতদেহ সারি সারি শোয়ানো হচ্ছিল দুটি ট্র্যাকের মাঝের নিচু জমিতে। নিচু স্বরে কথা বলছিলেন উদ্ধারকর্মী, গ্রামবাসী আর আশেপাশে দলবেঁধে বসে থাকা পরিযায়ী শ্রমিকরা— যাঁরা কেউ অল্প আহত হয়েছেন, কেউ রক্ষা পেয়েছেন।
বেলা যত বেড়েছে তত শব্দ প্রবল হয়েছে। ক্রেনের শব্দ। অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন। আর প্রশ্ন— কেন ঘটল, কী করে ঘটল এত বড় বিপর্যয়!
শনিবার রাত পর্যন্ত ২৮৮জনের মৃত্যু হয়েছে বলে রেলসূত্রে জানানো হয়েছে। তার মধ্যে এখনও পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের আছেন ৩৫জন, এমনটা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের দাবি। পশ্চিমবঙ্গের ৫৪৪জন আহত হয়েছে এই দুর্ঘটনায়। তাঁদের ২৫জন ওডিশার এবং ১১জন পশ্চিমবঙ্গের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তবে এই খবর বিকালের। যত সময় গড়াচ্ছে তত মৃতের এবং আহতের সংখ্যা বেড়ে চলার আশঙ্কা প্রবল। 
ভারত স্কাউট গাইডের কর্মীরা এদিন উদ্ধার কাজে হাত লাগিয়েছেন। এনডিআরএফের সঙ্গে ট্রেনের চ্যাপ্‌টা হয়ে যাওয়া বগি থেকে দেহ উদ্ধারের কাজ চালিয়ে গেছেন তাঁরা। এই দলে থাকা শেখ নুসরত জানালেন,‘‘প্রচণ্ড গরমের জন্য ভাঙাচোরা কামরায় আটকে থাকা দেহ পচতে শুরু করছে।’’ আগত সেনাবাহিনী ও বায়ু সেনাদের জওয়ানদের মতও তাই। সেই জন্য তাঁরা বগি ফুটো করে উদ্ধারের কাজ না চালিয়ে সকাল সাড়ে এগারোটার পর  ইলেকট্রিক কাটার দিয়ে বগি কাটার সিদ্ধান্ত নেন। আর তা করায় আরও দেহ উদ্ধার হয়।
বাহানাগা লেভেল ক্রশিংয়ের কাছে ঘটনাস্থল কী বলছে? 
মালগাড়ির পিছন দিক থেকে তার উপরে উঠে এসেছে করমণ্ডল এক্সপ্রেসের ইঞ্জিন। কিছু কামরা ছিটকে পড়েছে পাশের নয়নজুলিতে। কয়েকটি উল্‌টে পড়েছে ছিটকে পাশের ট্র্যাকে। কিছু পুরোপুরি ঘুরে গিয়ে এক নিদারুণ জ্যামিতি তৈরি করেছে ট্র্যাকের উপর। স্থানীয় যাঁরা আগে এসেছেন ঘটনাস্থলে তাঁরা জানাচ্ছেন, করমণ্ডল এক্সপ্রেস পিছন থেকে ধাক্কা মারে মালগাড়িকে। তারপর তার ইঞ্জিন উঠে পড়ে মালগাড়িতে। শুধু তাই নয়, ঘটনাস্থল বলছে মালগাড়ির উপরে করমণ্ডলের ইঞ্জিন অনেকটা ঘষটে যায়। স্বভাবতই গতির কারণে। 
কিন্তু উপরে উঠে পড়ল কী করে? ঘটনাস্থলে রেলের এক আধিকারিককে এই প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন,‘‘মালগাড়িটিতে জিনিস না থাকলে তা হালকা হত। করমণ্ডলের ইঞ্জিন সেক্ষেত্রে মালগাড়িকে মাথায় তুলে নিজে নিচে ঢুকে যেত। মালগাড়িতে মাল ছিল। তাই করমণ্ডলের ইঞ্জিন উপরে উঠে গেছে।’’ কিন্তু এক লাইনে এল কী করে করমণ্ডল আর মালগাড়ি? খড়গপুরে প্রায় ১৫ মিনিট আগে মালগাড়িটি ছেড়েছিল করমণ্ডলের। চালক জানতেন। সেই অনুসারেই চলার কথা। তারচেয়েও বড় কথা দুটি কিছুতেই এক লাইনে যাওয়ার কথা নয়। 
ইঙ্গিত— সিগন্যালের ভুলেই এত বড় দুর্ঘটনা। এত হতাহত। কিন্তু তদন্ত শেষ না হলে চূড়ান্ত কথা বলা সম্ভব নয়— রেলের আধিকারিকরা ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে তাই বলেছেন।
এদিন দুপুরে ঘটনাস্থলে এসেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। তিনি অভিযোগ করেছেন রেলের সমন্বয়ের অভাবের। হতাহতদের একাংশ চিকিৎসার জন্য যাচ্ছিলেন দক্ষিণ ভারতে। আর একটি অংশ, তাঁরাই বেশিরভাগ, তাঁরা যাচ্ছিলেন দক্ষিণের বিভিন্ন রাজ্যে কাজে। পশ্চিমবঙ্গে কাজ নেই। তাই ভিন রাজ্যে যাওয়া। এই বিষয়টি উঠছে বুঝেই মুখ্যমন্ত্রী বলেন,‘‘কী দরকার এখানে কাজ করতে আসার। আমাদের ওখানে তো অনেক কাজ আছে।’’
এদিন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও এসেছিলেন ঘটনাস্থলে। তাঁর সঙ্গে মমতা ব্যানার্জির দেখা হয়ে যেতে পারে— এমন একটি সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু তাঁদের দেখা হয়নি। 
যেসব পরিযায়ী শ্রমিকরা গত দুর্ঘটনায় বেঁচে ফিরেছেন, তাঁদের অনেককে এদিন ভোরে ঘটনাস্থলে বসে থাকতে দেখা গেছে। কেন বসে আছেন ? জিজ্ঞাসা করতেই মুর্শিদাবাদের বাসিন্দা সাইবুল ইসলাম জানালেন, ‘কী করব ? ফিরব কী করে ?  চেন্নাইয়ে লেবারের কাজটা তো আমার গেল। তার ওপর জখম হয়েও এখানে বসে আছি। শুনছি সরকার নাকি কীসব সাহায্য দেবে। সকাল থেকে খাওয়া দাওয়া কিছু হয়নি। কেউই আসল না আমাদের সঙ্গে কথা বলতে।’  
সাইবুল ইসলামের মতো আরো কিছু বেঁচে ফেরা পরিযায়ী শ্রমিক বসে ছিলেন। পরিযায়ী শ্রমিক নিয়ে সংবাদ মাধ্যমের  আগ্রহ বাড়তে থাকায় বেলা এগারোটা নাগাদ তাঁদের সব পরিযায়ী শ্রমিককে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হয়। কোথায় তাঁদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সে বিষয়ে প্রশ্ন করতেই বালেশ্বরের পুলিশ সুপার সাগরিকা নাথ সটান উত্তর, ওঁদের বালেশ্বর জেলা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
বাহানাগা বাজারের কাছে, ঘটনাস্থলে স্থানীয়দের ভিড় ছিল। তাঁদের অনেকেই গত রাতে পৌঁছেছিলেন দুর্ঘটনা স্থলে। উদ্ধার কাজ তাঁরাই প্রথম শুরু করেন। পরে এসেছে সরকারি উদ্ধারকারী দল। রাত থেকে চলেছে উদ্ধার কাজ। দিনের আলো ফুটতেই উদ্ধার কাজে আরো জোর দিয়েছেন সব পক্ষ।
তবে শনিবার ভোর থেকে কাউকে আর জীবিত উদ্ধার করা যায়নি। সাইরেনের আওয়াজ হচ্ছে। সাইরেনের শব্দ মানেই দেহ উদ্ধার। ঘটনাস্থলের পাশেই সার দিয়ে রাখা হচ্ছে একের পর এক দেহ। কোন দেহই অক্ষত নয়। রাশি রাশি বডিব্যাগে সেই দেহ একের পর এক এসে রাখছেন এনডিআরএফ কর্মীরা। আর নতুন দেহ উদ্ধার হতেই  ছুটে আসছেন কিছু মানুষ। আরপিএফ কর্মীরা একের পর এক বডিব্যাগ খুলে দেখাচ্ছেন আগতদের। তাঁরা দেখছেন, কেউ প্রিয়জন আছেন কিনা। বেশিরভাগই সন্ধান পাচ্ছেন না দুর্ঘটনায় পড়া তাঁদের প্রিয়জনদের।   
সকালে আলো ভালোভাবে ফুটতেই শুধু বাড়তে দেখা গেছে মৃতদেহের সংখ্যা। শেষে বডি ব্যাগের ঘাটতি পড়ে যায়। মৃতদের সাদা কাপড়ে মুড়ে রাখতে শুরু করেন উদ্ধারকারীরা। এবারে আর দেহকে দেখানোর সুযোগ পাওয়া যাচ্ছিল না। সেখানে সকাল থেকে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষদের মধ্যে দানা বাঁধতে থাকে  প্রবল ক্ষোভ।  এদিন  সেনা, আধা সেনা, পুলিশ, বিপর্যয় মোকাবিলা দলের সঙ্গে উদ্ধার কাজে হাত লাগাতে দেখা গেছে স্থানীয়  স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনদের। 
এদিকে সকাল সাতটা নাগাদ আশপাশের গ্রাম ভেঙে দুর্ঘটনাস্থলে আসতে শুরু করেন মানুষ। বাহানাগার পাশের দুই গ্রাম সাট্টি এবং কামারিপুর থেকে সপরিবারে মানুষজন আসা শুরু করেন। দলবেঁধে নিজের ছেলে-মেয়েকে নিয়ে আসতে দেখা যায় মহিলাদের। কীভাবে একটি ট্রেন একটির ওপর ওঠে গেছে, তা দেখতে ছুটে এসেছেন তাঁরা। কেউ আবার অটো ভাড়া করে গোপালপুর থেকেও এসেছেন। দুর্ঘটনাস্থলে বাড়তে থাকা সেই ভিড়কে সামলাতে দারুণ সমস্যায় পড়ে যায় স্থানীয় প্রশাসন।
সময় যতই বেড়েছে ততই ভিড়ের চাপ বাড়তে থাকায় শেষে সেনাবাহিনীকে উদ্ধার কাজের পাশাপাশি নামতে হয় গ্রামাঞ্চল থেকে আসা মানুষ সামলাতে। বাহানাগা লেভেল ক্রশিংয়ে সব রেল লাইন পাটিসহ ভেঙে গেছে। তা ঠিক করতে অনেক ভারী মেশিন আনা হলেও তা চালাতে গিয়ে দারুণ সমস্যায় পড়তে হয় স্রেফ  এলাকার মানুষের ভিড়ের জন্য। একই সঙ্গে সকাল থেকে কেন্দ্র ও রাজ্যের মন্ত্রীদের আনাগোনার জন্য উদ্ধার কাজ ব্যাহত হয়।  তাঁদের সামলাতে ওডিশা পুলিশকে সারাদিন ব্যস্ত থাকতে হয়।   
শনিবার বিকাল পর্যন্ত ভদ্রক থেকে বালেশ্বরে ফেরার লাইনটি চালু করার চেষ্টা চালিয়ে গেছে রেল। প্রচুর রেল কর্মীকে ঘটনাস্থলে আনা হয়েছে। রেল লাইনের পাশে তাঁবু খাটিয়ে ছিঁড়েফুঁড়ে যাওয়া ইলেকট্রিক লাইন ঠিক করার কাজ তাঁরা চালিয়ে যাচ্ছেন। ওডিশা প্রশাসনের পাশাপাশি রেলের তরফে এদিন দুমড়েমুচড়ে যাওয়া বগিগুলোকে রেল লাইনের ওপর থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য বিশাল বিশাল পে-লোডার এবং ক্রেন আনা হয়। একটি লাইন দিয়ে যাতে  দক্ষিণ ভারতগামী ট্রেনগুলিকে নিয়ে যাওয়া যায়, তার জন্য রেল কর্মীরা জোরদার কাজ করছেন।  

 

Comments :0

Login to leave a comment