Irfan habib

ইতিহাস পুনর্লিখনের নামে অসত্যের গৌরবায়ন চলছে, বললেন ইরফান হাবিব

জাতীয়

 ‘হিন্দু’ শব্দটিই আরবি। ইতিহাস যদি পুনর্লিখন করতে চাওয়া হয় তাহলে ওই শব্দ ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হচ্ছে না কেন? এক সাক্ষাৎকারে এমনই মন্তব্য করেছেন বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ইরফান হাবিব। ‘আল জাজিরা’-কে দেওয়া ওই সাক্ষাৎকারে ইতিহাস বিকৃতির অভিযানের সমালোচনা করতে গিয়ে নাৎসি অনুকরণের কথাও বলেছেন তিনি।  
অধ্যাপক হাবিব বলেছেন, ইউজিসি প্রাচীন ভারতের যে সিলেবাস প্রস্তাব করেছে সেখানে ইতিহাস থেকে বর্ণপ্রথাকেই বাদ দেওয়া হয়েছে। দাবি করা হচ্ছে, মধ্যযুগে মুসলিমরা বর্ণপ্রথা চালু করেছিল। শুধু পক্ষপাতের বিষয় নয়, মিথ্যা  ও অসত্য তথ্যকে গৌরবান্বিত করা হচ্ছে। আর্যদের নিয়ে যা বলা হচ্ছে তা নাৎসিদের মতোই। স্নাতক স্তরের ইতিহাসের সিলেবাসে বলা হচ্ছে, ভারত আর্যদের আদি বাসস্থান। এখান থেকেই আর্যরা পৃথিবীতে সভ্যতা ছড়িয়েছিল। ইতিহাসবিদ্‌দের তথ্য প্রমাণ করতে হয়, তথ্য বানানো চলে না। আর্য জাতি তৈরি করা যায় না। বস্তুত, এই কথা সংস্কৃতকে অপমান করা কেননা প্রথম দিকের সংস্কৃত রচনায় আর্য হচ্ছে ইরানের একটি এলাকা। ইরান আর্য শব্দের বহুবচন। ইরানের অর্থ হলো আর্যদের ভূমি। এখন আর্যদের একটি জাতিতে পরিণত করা হচ্ছে, যেমন হিটলার করেছিলেন। প্রাচীন ইরানীয় এবং ঋগ্বেদের সংস্কৃত খুব কাছাকাছি। দুই ভাষা আত্মীয়। আর্য বলতে বোঝানো হতো শ্রদ্ধেয় ও মহৎ মানুষ, জাতি বোঝায় না। 
এক প্রশ্নের উত্তরে অধ্যাপক হাবিব বলেছেন, ঐতিহাসিক সূত্রগুলি এমনই যে তা থেকে হিন্দু সাম্প্রদায়িক ব্যাখ্যা করা যায়, মুসলিম সাম্প্রদায়িক ব্যাখ্যা করা যায়, মার্কসীয় ব্যাখ্যাও করা যায়। আরএসএস-এর পত্রিকা ‘অর্গানাইজার’ একবার এক প্রবন্ধ প্রকাশ করে লিখলো যে মান সিং তাজমহল বানিয়েছিলেন। ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার ওদের লিখে পাঠালেন, ‘এখন থেকে তোমাদের পত্রিকা আমি আর পড়ব না, আমার কোনও লেখা পত্রিকায় ছাপা হবে না।’ মজুমদার হিন্দু সাম্প্রদায়িক ধারার ইতিহাসবিদই ছিলেন কিন্তু তিনি পেশাদার ইতিহাসবিদ ছিলেন, অপ্রমাণিত তথ্যকে তিনি মেনে নিতে পারেননি। সে প্রাচীন যুগই হোক বা মধ্যযুগ। 
প্রশ্ন ছিল, হিন্দুত্ববাদীরা মুঘলদের বরাবরই বহিরাগত বলে বিবেচনা করেছে। এখন অন্য মুসলিম নেতাদেরও আক্রমণ করা হচ্ছে। যেমন, মৌলানা আজাদ বা অষ্টাদশ শতাব্দীর টিপু সুলতানকে। অধ্যাপক হাবিব বলেছেন, আজাদকে বাদ দেওয়া হয়েছে মুসলিম-বিরোধিতা থেকে। ওরা দেখাতে চায় না কোনও মুসলিম ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভূমিকা পালন করেছেন। টিপু সুলতানের ক্ষেত্রে জাতীয় প্রশ্নকেই পুরো বিপরীত দিকে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। গান্ধীজী, নেহরু বরাবর টিপুর প্রশংসা করেছেন। টিপু মালাবার বিদ্রোহ দমন করেছিলেন, তা ন্যায্য ছিল না। কিন্তু সেই সময়ের প্রায় যে কোনও শাসক সম্পর্কেই এ কথা খাটে। কিন্তু মহীশূর এবং অর্থনীতির আধুনিকীকরণে তিনি যা করেছিলেন এবং ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে তাঁর লড়াইকে বাদ দেওয়া যায় না। ভারতের ইতিহাসবিদ্‌রা বিজেপি’র সঙ্গে একমত নন। 
শহর বা রাস্তার নাম বদলে দেওয়া হচ্ছে। প্রশ্ন ছিল, এর ফলে জনগণের স্মৃতি এবং ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের ওপরে কী প্রভাব পড়বে? অধ্যাপক হাবিব বলেছেন, মানুষের স্মৃতিকেই ওরা ধ্বংস করতে চায়। ঔরঙ্গাবাদের আসল নাম ছিল খিরকি। শহর বানিয়েছিলেন এক আফ্রিকান মুসলিম মালিক অম্বর। মালিক অম্বর ‘বহিরাগত’ কেননা তিনি আফ্রিকান এবং তদুপরি মুসলিম। যদি ইতিহাসের প্রতি দায়বদ্ধ থাকেন তাহলে ডাকা উচিত অম্বরনগর বা খিরকি। কিন্তু ঔরঙ্গাবাদকে শম্ভাজীনগর নামকরণ করা অর্থহীন কেননা শম্ভাজী কোনোদিন ঔরঙ্গাবাদে যাননি। তাজমহল থেকে ডলার আসে। কিন্তু ওরা নীরবে লোকের মধ্যে ধারণা তৈরি করার চেষ্টা করছে যে তাজমহল আসলে ছিল শৈব মন্দির। ব্রিটিশরা বজ্রপাত থেকে রক্ষা করার জন্য তাজমহলে কন্ডাকটর বসিয়েছিল। এখন বিজেপি ও তাদের সমর্থকরা ওই কন্ডাকটরকে ‘ত্রিশূল’ বলে চালাচ্ছে। এইরকম অপব্যাখ্যার অভিযান চলছে। 
প্রশ্ন করা হয়েছিল, বিজেপি ইতিহাস পুনর্লিখন করতে চাইছে কেন? অধ্যাপক হাবিব বলেছেন, তাদের একটি উদ্দেশ্য মুসলিমদের শত্রু বলে খাড়া করা। ওদের অনেক সমস্যা আছে। যেমন ধরুন, হিন্দু শব্দটিই আরাবিক। তাহলে প্রথমেই ওই শব্দকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হচ্ছে না কেন? ধর্ম একটি সেমিটিক ধারণা যা ভারতে নিয়ে আসা হয়েছিল। এখন তারা হিন্দুধর্মকে ওই ধরনের চেহারা দিতে চাইছে। বস্তুত, চতুর্দশ-পঞ্চদশ শতাব্দী পর্যন্ত সংস্কৃত সাহিত্যে হিন্দু শব্দ ব্যবহৃতই হয়নি। এমনকি বিজয়নগরের সম্রাটরা তাদের হিন্দু রাই সরাত্রন বলতেন। অর্থাৎ হিন্দু রাইয়ের সুলতান। শব্দের বিকাশ খুবই চিত্তাকর্ষক। এখন দেখা যাচ্ছে ইসলাম থেকে আসা ধারণা ভারতীয় ধর্মের ইতিহাসে প্রয়োগ করা হচ্ছে। 
অধ্যাপক হাবিব বলেছেন, কাল্পনিক কথা ছড়ানো হচ্ছে। যেমন, ভারত ছিল গণতন্ত্রের মাতা। কোনও ইতিহাসবিদ স্বীকার করেননি যে ভারত গণতন্ত্রের মাতা ছিল। ঋগ্বেদে রাজাদের কথা বলা হয়েছে, যারা আদিবাসী প্রধান ছিলেন। প্রাচীন গ্রিস বা রোমে গণতন্ত্রের উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু ভারতে, চীনে, ইরানে তা পাওয়া যায় না। প্রাচীন ভারত বিশেষজ্ঞ এমন একজন প্রকৃত ইতিহাসবিদ নেই যিনি এই গণতন্ত্রের মাতার ধারণা মেনেছেন। সংস্কৃতে বলা হতে মহাজনপদ। তার অর্থ গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র নয়। এর অর্থ আদিবাসী। প্রাচীন ভারত থেকে বর্ণভাগের ইতিহাস মুছে দেওয়া ইতিহাসকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করা। 
প্রশ্ন ছিল, রাষ্ট্র যখন জ্ঞানের একমাত্র উৎসে পরিণত হচ্ছে, পক্ষপাতে পরিচালিত হচ্ছে, শিক্ষাব্যবস্থায় এবং সমাজে তার কী প্রভাব পড়তে পারে? অধ্যাপক হাবিব বলেছেন, এ শুধু বৈরি পক্ষপাতই নয়, অসত্যের গৌরবায়ন। আর্য জাতির বিষয়টা যেমন। সিন্ধু সভ্যতাকে সংস্কৃতের অধীন করে ফেলা, সরস্বতী সভ্যতা বলে ডাকা কাল্পনিক। নাৎসি প্রচারের সঙ্গে মেলে। গোলওয়ালকর নাৎসিদের প্রশংসা করেছিলেন। আরএসএস-এর প্রতিষ্ঠাতারা নাৎসিদের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। ইহুদিদের সম্পর্কে হিটলারের আচরণের প্রশংসা করেছিলেন। 
হিন্দুত্ববাদীরা বলে থাকে মুঘল আমলে হিন্দুদের বিপুল আকারে ধর্মান্তরকরণ হয়েছিল, মুসলিম শাসকরা মন্দির ধ্বংস করেছিল। তারা বলছে সেই সময় ছিল অন্ধকারের যুগ। অধ্যাপক হাবিব বলেছেন, বাজে কথা। হজ্জাজ বিন ইউসুফ মহম্মদ বিন কাশিমকে অষ্টম শতাব্দীতে সিন্ধে পাঠানোর সময়ে বলে দিয়েছিলেন, হিন্দু, খ্রিস্টান, পারসিদের সঙ্গে একই রকম আচরণ করবে। সহিষ্ণু হবে। বিন কাশিম কোনও মন্দির ভাঙেননি। হজ্জাজের নীতি সহিষ্ণুতার মহান আদর্শে অনুপ্রাণিত ছিল, তা বলা যায় না। কিন্তু বাস্তব কারণেই এই নীতি নেওয়া হয়েছিল। কোনও দেশে অভিযান চালালে সে দেশের সকলকে বৈরি করে ফেলা যায় না। মুলতানী ব্যবসায়ীরা মুসলিম শাসকদের মদত পেয়েছিলেন, মুঘলদের পদস্থদের বিরাট অংশই হিন্দু ছিলেন। সাধারণ মুসলিম সেই সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠতে পারতেন না। আওরঙ্গজেবের প্রথম অর্থমন্ত্রী ছিলেন হিন্দু, তাঁর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ পদস্থ ছিলেন অম্বরের মহারাজা জয় সিং। তাঁকে দাক্ষিণাত্যের প্রশাসক নিয়োগ করা হয়েছিল। মুঘলরা নিশ্চয়ই গণতন্ত্রী ছিলেন না, কিন্তু তারা গায়ের জোরে ধর্মান্তর করতেন, তা-ও ঠিক নয়। 
অধ্যাপক হাবিব বলেছেন, আওরঙ্গজেবের সময়ের ভারতের ইউরোপীয় বর্ণনা যদি পড়া যায় তাহলে দেখা যাবে সব ধর্মাচরণই অনুমোদিত ছিল। মন্দিরে, মসজিদে, চার্চে যাওয়া যেত। ইউরোপে বা ঐস্লামিক বিশ্বে এর কোনও তুলনা ছিল না। মন্দির ভাঙা হয়েছিল, তা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। আওরঙ্গজেবের নীতিতে বৈষম্য ছিল। আবার একই সঙ্গে সেই সময়ে বিশ্বের অন্য দেশের পরিস্থিতি দেখতে হবে। ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ভারতের মতো কোথাও ছিল না। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রেক্ষিতে আওরঙ্গজেবের ভারত অন্যদের তুলনায় অনেক সহিষ্ণু ছিল।

 

Comments :0

Login to leave a comment