MUKTADHARA PRABANDHA

মুক্তধারা প্রবন্ধ পল্লব মুখোপাধ্যায়

সাহিত্যের পাতা

MUKTADHARA 17 MAY PRABANDHA

'মুক্তধারা'-র প্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথ-এর বিশ্বমানবতাবোধ

 

পল্লব মুখোপাধ্যায়

 

অভ্যন্তরীণ মূল্যবোধের লড়াই সেরে রবীন্দ্রনাথ অবশেষে পশ্চিমি সভ্যতা সম্পর্কে স্বচছ বৈজ্ঞানিক প্রত্যয়ে এসে
স্থিত হন। এই রাজনৈতিক সচেতনতা মানুষ রবীন্দ্রনাথের সত্য পরিচয়কে উন্মোচিত করে দেয়। নাট্যকার
রবীন্দ্রনাথ যাবতীয়  
জড়তা ভেঙে রাজনৈতিক সত্যাশ্রয়ে আসীন হলেন। এর সূচনা 'মুক্তধারা'-য়। এক বছরেরও
বেশি সময়ব্যাপী যুদ্ধ বিদ্ধস্ত বিদেশ ভ্রমণের প্রত্যক্ষ প্রতিক্রিয়ার ফসল 'মুক্তধারা' নাটক। বিপুল যুদ্ধকরের
বোঝায় ধুঁকছে শিল্প-বাণিজ্যের ঝকঝকে  
দুনিয়া। আলোর দিশা না দেখিয়ে অগ্নিসংযোগে ব্যস্ত মশাল। শান্তি
সম্মেলনের টেবিলে আন্তর্জাতিক বৃহৎ শক্তিগুলি শান্তি স্থাপনের অছিলায় পরাজিত পৃথিবীর সম্পদের ভাগ-
বাঁটোয়ারায় মগ্ন। পরাস্ত, ক্ষুধাতুর জার্মানির হুহুঙ্কারে আর এক  
বিশ্বযুদ্ধের অনিবার্যতার শব্দ ইত্যাদি ঘটনা
পরম্পরা নিছক রবীন্দ্রনাথের স্বপ্ন-ভঙ্গের বেদনাই প্রসব করল না কবির চোখে বিশ্ব পরিস্থিতির ভয়াবহ সংকট
চিন্তাকে ঘনীভূত করে তুলল।
 

 

'মুক্তধারায়' যে আগ্রাসী জাতীয়তার ছবি স্পষ্ট,  
আন্তর্জাতিক পটভূমিতে বিশ শতকের তিনের দশকে হিটলারের
দানবীয় আত্মপ্রকাশ ক্ষণের সঙ্গেই তার সাদৃশ্য মেলে। উত্তরকূটের বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি ও বাণিজ্যিক শিল্প সমৃদ্ধির
রসদ জোগায় শিবতরাই। শিবতরাই-এর মূল অর্থনৈতিক  
উৎপাদন হল পশম। বাইরের হাটে শিবতরাইকে ওই
পশম বিক্রি করতে না দিয়ে উত্তরকূট স্বল্পমূল্যে তা কিনে নেয়। বহির্জগতের সঙ্গে শিবতরাইয়ের সংযোগ সাধনের
একমাত্র গিরিপথটি রণজিৎ-এর পূর্ব পুরুষেরা বন্ধ করে দিয়েছিল।  
এভাবেই উত্তরকূটের অর্থনৈতিক শোষণের
ফলে শিবতরাইবাসীরা দীর্ঘকাল বন্দী। সম্প্রতি শিবতরাইবাসী উপর্যুপরি দুবছরের দুর্ভিক্ষের জন্য রাজস্ব দিতে
পারেনি। ওই রাজস্ব নানা অজুহাতে আদায় করতে ব্যর্থ হয়ে রণজিৎ বিজ্ঞানী বিভূতির  
সহায়তায় মুক্তধারার বাঁধ
বেঁধে শিবতরাই-এ পানীয় ও সেচের জলের জোগান বন্ধ করে দেয়। যদিও এই পরিকল্পনার সূচনা হয়েছিল ২৫
বছর আগে। অঙ্গ রাজ্যটিকে সম্পূর্ণ পদানত করে রাখার অর্থনৈতিক কূটকৌশলে এই পরিকল্পনা  
রচিত হয়েছিল।
উত্তরকূট-শিবতরাই দ্বন্দ্বের পটভূমিকায় জাতীয়তাবাদী আগ্রাসনের চিত্রই স্পষ্ট প্রতিভাত হয় 'মুক্তধারা';-য়।
প্রসঙ্গত, 'মুক্তধারা'-র পূর্বকল্পিত নাম ছিল 'পথ'।
'মুক্তধারা'-য় স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের যে চিত্র স্পষ্ট হয়েছে তার  
মাধ্যমে উগ্রজাতীয়তার রাজনৈতিক ভঙ্গিমা সম্বন্ধে
নাট্যকার রবীন্দ্রনাথের অবস্থান দৃঢ় হয়েছে । উত্তরকূটের জাতীয়তাবাদী মত্ততার মাশুল গুণেছে উত্তরকূটের
নিজস্ব জনগোষ্ঠী ও ত্রস্ত শিবতরাইবাসী । বিশ্বযুদ্ধের উত্তাপ থেকেই তা প্রসূত।  
স্বৈরতান্ত্রিক শাসকের কাছে বিক্রিত
হয় বিজ্ঞানীর মস্তিষ্ক। শাসকের রাজনৈতিক অভিপ্রায় চরিতার্থ করতে বিজ্ঞানীর কৌশলী কর্মযজ্ঞে ১৮ বছরের
তরুণদের বাধ্যতামূলক আত্মবলি দিতে হয়। ভয় ও সন্ত্রাসের আবহে ভুলুন্ঠিত হয় গণতান্ত্রিক  
অধিকার।
 

 

প্রশাসকের ভাড়াটে সেনা ও বাহুবলীর দল নিজের হাতে আইন তুলে নিয়ে বেগার শ্রমের জন্য রাজ্যবাসীর ওপর
চালায় নির্বিচারে নিপীড়ণ। মারণ-উচাটন মন্ত্র নবীন প্রজন্মের মনে পাকা করে গেঁথে দেন পাঠশালার গুরুমশাই।
জাতি বৈরিতার আগুন শিবতরাই ও উত্তরকূটের সাধারণ মানুষের মনে জ্বলতে থাকে লেলিহান শিখায়। এই
যাবতীয় প্রতিক্রিয়ার বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট হয় জাতীয়তাবাদী উন্মত্ততায় জার্মানির ১৯৩০-এর পরিস্তিতির এক
আগাম প্রবর্তনার  
ছবি 'মুক্তধারা'-য় গভীর অন্তর্লীন দূরদৃষ্টির সঙ্গে বিন্যস্ত করা হয়েছে। নিঃসন্দেহে বলা যায়
বিশ্বমানবতার গভীর সংকট সম্বন্ধে উদ্বিগ্ন নাট্যকার রবীন্দ্রনাথের স্বচ্ছ জ্ঞানের দিগ্দর্শন এই 'মুক্তধারা'।
অনুভূত হয়, নির্জিত মানবিকতাকে সাধারণের  
সারিতে দাঁড়িয়ে দেখার সময় প্রবল যন্ত্রনাশেলে কবি
নিদারুণভাবে বিদ্ধ হয়েছিলেন। সাধারণের অঙ্গে নিবিড় আত্মীয়তার এই নয়া বন্ধনই নাট্যকার রবীন্দ্রনাথ-কে
দিয়ে সুদূরপ্রসারী চিত্রপটের আগাম প্রস্তাবনা করিয়ে নিয়েছিল । নির্জিত  
মানবতার সংঘ শক্তি সম্পর্কেও নাট্যকার
রবীন্দ্রনাথ যে নতুন করে ভাবনা চিন্তা শুরু করেছেন তারও ইঙ্গিত পাওয়া যায় 'মুক্তধারা'-য়। অর্থনৈতিক
অবরোধের মধ্যেও অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে সঙ্গবদ্ধ প্রস্তুতি নিচ্ছে শিবতরাইবাসী । অস্থির হয়ে  
উঠছে প্রত্যক্ষ
আন্দোলনের উত্তেজনায়। ধনঞ্জয় বৈরাগীর কাছে আবেদনমত রাজনৈতিক নেতৃত্ব পেলে এরাই জোটবদ্ধ শক্তিতে
মুক্তধারার বাঁধ ভেঙে ফেলত সন্দেহ নেই। আধ্যাত্মিক আত্মশক্তির সম্প্রচারক ধনঞ্জয় সরে দাঁড়ানোয় এরা
অভিভাবকহীন হয়ে পড়ল। তবু এরা দলে দলে উত্তরকূটের দিকে ধেয়ে আসছে চরমুখে এই সংবাদ দিয়েছেন
নাট্যকার রবীন্দ্রনাথ।
 

 

পারস্পরিক প্রীতি বিনিময় ও ঐক্য সভ্যতার গোড়ার কথা। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় "মানব সমাজের সর্বপ্রধান  
তত্ত্ব
মানুষের ঐক্য। সভ্যতার অর্থই হচ্ছে একত্র হবার অনুশীলন।" বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে সভ্যতা দীপ্যমান
হলেও মানুষের মনোজগতের অন্ধতমস দূর হয়নি। গোটা বিশ্বের শান্তিকামী, প্রগতিশীল মানুষের মতে, যুদ্ধ,
সামাজিক  
বৈষম্য, জাতিতে-জাতিতে, সম্প্রদায়ে-সম্প্রদায়ে বৈরিতা, ধর্মীয় সংকীর্ণতা সৃষ্টি করছে মানব সভ্যতার
সংকট। মানুষের প্রতি বিশ্বাস ও নির্ভরতাই মানবতা। এর মধ্যে নিহিত আছে বিশ্ব মানবতাবোধের ধারণা ।
রবীন্দ্রনাথের এই  
বিশ্বমানবতাই আমাদের পথ দেখায়। তাই তিনি চিরস্মর্তব্য, চিরবরেণ্য।

Comments :0

Login to leave a comment