Manipur violence

‘মন কী বাত’ বয়কটে রাস্তায় রেডিও আছড়ে ভাঙলেন মণিপুরের মানুষ

জাতীয়

 

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ‘মন কী বাত’-এ মণিপুর নিয়ে ‘মৌন’-ই থাকলেন। সাম্প্রতিক হিংসায় নিজের মন্ত্রীসভার সদস্যের বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হলেও উত্তর-পূর্বের ওই রাজ্যের হিংসা নিয়ে একটি বাক্যও খরচ করলেন না মোদী তাঁর ‘অমৃতভাষণে’। ফলে প্রধানমন্ত্রীর নীরবতায় ক্ষুব্ধ মণিপুরবাসী রবিবার সকালে ‘মন কী বাত’ অনুষ্ঠান চলাকালীন দলে দলে রাস্তায় নেমে ট্রানজিস্টার সেট আছাড় মেরে ভাঙলেন। এমনকি মোদীর ভাষণ বয়কট করবেন বলে রাস্তায় সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে দু’হাত দিয়ে চেপেও থাকলেন কান। অনেকে আবার প্রধানমন্ত্রীর নীরবতার বিরুদ্ধে পোস্টার হাতে, স্লোগান দিয়ে প্রতিবাদও জানালেন। স্বাভাবিকভাবেই মণিপুর নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর নিস্পৃহ মনোভাবের সমালোচনায় সরব হয়েছে কংগ্রেস সহ বিরোধীরা।
এদিন বিজেপি’র তরফে ইম্ফল সহ মণিপুরের বিভিন্ন অংশে প্রধানমন্ত্রীর ‘মন কী বাত’ শোনানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল। রাস্তায় রাস্তায় অটোতে লাউডস্পিকার লাগিয়ে মোদীর কথা শোনানোর ব্যবস্থা করা হয়। উলটোদিকে মণিপুরবাসীও সক্রিয় ছিলেন ওই অনুষ্ঠান বয়কট করার জন্য। আর প্রধানমন্ত্রী যখন তাঁর ভাষণে মণিপুরের হিংসার বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করলেন, তখন ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায় রাজ্যবাসীর। এমনিতেই মুখে মাস্ক পরে, মোদীর নীরবতার প্রতিবাদে পোস্টার-প্ল্যাকার্ড নিয়ে এদিন সকাল থেকে দলে দলে তাঁরা জড়ো হয়েছিলেন রাস্তায় রাস্তায়। পশ্চিম ইম্ফল জেলার ইন্দো-বার্মা রোডে ট্রানজিস্টার আছড়ে ভেঙে এক প্রতিবাদী জানালেন, ‘‘আমরা ‘মন কী বাত’ অনুষ্ঠানের তীব্র বিরোধিতা করছি। এইসব ভাষণ না দিয়ে ওঁর উচিত মণিপুরের জ্বলন্ত সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা। আমরা প্রধানমন্ত্রীর ‘মন কী বাত’ চাই না। আমরা চাই ‘মণিপুর কী বাত’।’’
প্রধানমন্ত্রীর আচরণে হতাশ মণিপুরের মানুষ, সেকথা এদিন জোরের সঙ্গে জানালেন ‘থাওয়াই মিরিল’র মিডিয়া কো-অর্ডিনেটর খোমদ্রাম সুরেন্দ্র। তিনি অভিযোগ করলেন, ‘ভোটের সময় প্রধানমন্ত্রী মোদী হাতজোড় করে মণিপুরবাসীর সমর্থন চাইতে আসতে পারেন। অথচ রাজ্যের সঙ্কট সমাধানে কোনও উদ্যোগই নিচ্ছেন না। ওঁর কোনও সদিচ্ছাই নেই। মণিপুরের অশান্ত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে কোনও গুরুত্বই দিচ্ছেন না উনি।’ এরই সঙ্গে সুরেন্দ্র মুখ্যমন্ত্রী বীরেন্দ্র সিংয়ের অকর্মণ্যতার কথা উল্লেখ করে অভিযোগ করলেন, ‘উনি বিজেপি’র কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ।’
মণিপুরের হিংসার প্রতিবাদে শনিবার রাতে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে রাস্তায় নেমে মানববন্ধনে শামিল হয়েছিলেন মহিলারা। মেইতেই মহিলারা পূর্ব ইম্ফল, পশ্চিম ইম্ফল, থাউবল এবং কাকচিঙ জেলায় হাতে মশাল নিয়ে মানববন্ধন করেন। তাঁরা প্রত্যেকেই কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের ভূমিকায় সরব হন। অভিযোগ করেন, শুধু শান্তি ফেরানোয় নয়, রাজ্যবাসীকে নিরাপত্তা দিতেও ব্যর্থ দুই সরকার। এরই পাশাপাশি বার্মা থেকে অনুপ্রবেশেরও বিরোধিতা করেন তাঁরা।
বস্তুত, মাসখানেক ধরেই অশান্ত বিজেপি শাসিত মণিপুর। মেইতেই-কুকি গোষ্ঠী সংঘর্ষে ইতিমধ্যেই সরকারিভাবে ১০০ জনেরও বেশি প্রাণ হারিয়েছেন বলে জানানো হয়েছে। অসংখ্য মানুষ ঘরছাড়া, পুড়েছে হাজার হাজার বাড়ি, নষ্ট হয়েছে সরকারি সম্পত্তি। মেইতেই-কুকি সংঘর্ষে জর্জরিত রাজ্য, প্রশাসন কার্যত নিষ্ক্রিয়। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ মণিপুর সফরে এসে বাগাড়ম্বর করে গেলেও শান্তি ফেরেনি এই পাহাড়ি রাজ্যে। উলটে বিদ্রোহীরা বিদেশ প্রতিমন্ত্রী রাজকুমার রঞ্জন সিং-য়ের বাড়ি সম্পূর্ণ জ্বালিয়ে দিয়েছে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীও শেষে বলতে বাধ্য হয়েছেন যে, রাজ্যের বীরেন সিং সরকার আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় সম্পূর্ণ ব্যর্থ। এরপরে শনিবার রাজ্যের মন্ত্রী বিশ্বজিৎ সিংয়ের বাড়ি জ্বালিয়ে দিতে গিয়ে বাধা পেয়ে ভাঙচুর চালায়। পুড়িয়ে দেয় বিজেপি’র একটি মণ্ডল কার্যালয়। এত কিছুর পরেও ‘অদ্ভুত নীরব’ প্রধানমন্ত্রী!
প্রধানমন্ত্রীর মণিপুর নিয়ে উপেক্ষায় শুধু রাজ্যবাসী নয়, ক্ষুব্ধ বিরোধীরাও। শনিবার মণিপুরের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ইবোবি সিংয়ের নেতৃত্বে রাজ্যের ১০টি বিরোধী দিল্লি এসেছে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে। ২০জন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরে যাওয়ার আগে প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাতের আশায় দশ দলের নেতৃত্ব দিল্লিতে আছেন। ‘নীরব’ প্রধানমন্ত্রীর কাছে তাঁরা রাজ্যে শান্তি ফেরানোর আরজি জানাতে চান। এদিনও কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে প্রধানমন্ত্রীর মণিপুর নিয়ে নীরবতার সমালোচনা করে বলেছেন, ‘আপনার মন কী বাত-এ অবশ্যই মণিপুরের কথা থাকা উচিত ছিল। কিন্তু আপনি মৌন-ই থাকলেন। অথচ ওই রাজ্যের পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার নিচ্ছে। আপনি একটা বৈঠকও ডাকলেন না। সর্বদলীয় বৈঠকও করলেন না।’ তাঁর কটাক্ষ, ‘মণিপুর যখন জ্বলছে তখন কেন্দ্রীয় সরকার ঘুমচ্ছে’। মণিপুর যেন ভারতের অঙ্গরাজ্যই নয়, প্রধানমন্ত্রী এমন ভান করছেন বলে কঠোরভাষায় নিন্দা করেন খাড়গে। দলের মুখপাত্র জয়রাম রমেশ টুইটে মোদীর নীরবতাকে কটাক্ষ করে বলেছেন, ‘আবার একটি মন কী বাত, অথচ উনি মৌন মণিপুর নিয়ে।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘বিপর্যয় মোকাবিলায় দেশের ভূমিকা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নিজের পিঠ নিজেই চাপড়ান। কিন্তু সম্পূর্ণভাবে মানুষের তৈরি মানবতার বিপর্যয় নিয়ে কেন নীরব থাকেন উনি?’ সবশেষে রমেশ এও বলেছেন, ‘‘ওঁর পক্ষ থেকে শান্তি ফেরানোর কোনও আরজি জানানো হয়নি। ‘পিএম-কেয়ার্স ফান্ড’র অডিট হয় না জানি। প্রধানমন্ত্রী কি আদৌ মণিপুর নিয়ে ‘কেয়ার’ (গুরুত্ব) করেন?’’
মণিপুর নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ‘পাত্তা’ না দেওয়া মানসিকতার সমালোচনা করেছে শিবসেনার (উদ্ধব গোষ্ঠী) এবং আপ। শিবসেনা (উদ্ধব গোষ্ঠী) মনে করে প্রধানমন্ত্রীর বিদেশ সফরের থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ মণিপুরের সমস্যা। ওই সঙ্কট মেটানোয় উদ্যোগ নিতে হবে প্রধানমন্ত্রীকেই। আপ আবার মণিপুরের হিংসার জন্য বিজেপি’কে দায়ী করে উত্তর-পূর্বের ওই রাজ্যে শান্তি ফেরাতে ব্যর্থ স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী মোদী বলে অভিযোগ করেছে।
এদিকে, এতদিন পর বিজেপি শাসিত মণিপুরের হিংসা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করল আরএসএস। প্রধানমন্ত্রীর নীরবতা নিয়ে কোনও কথা না বলে তারা উলটে রাজ্যে শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য মণিপুরের বিজেপি সরকার সহ রাজ্যবাসীর কাছে আবেদন করেছে। এদিন সংগঠনের সম্পাদক দত্তাত্রেয় হোসাবালে এক বিবৃতিতে ওই রাজ্যে শান্তি ও সম্প্রীতির পরিবেশ ফেরানোর জন্য সব ধরনের উদ্যোগ গ্রহণের আরজি জানিয়েছেন।
 

Comments :0

Login to leave a comment