NBDSA

ধর্মীয় বিদ্বেষ, ঘৃণা প্রচারের জন্য ৩ গোদী মিডিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা

জাতীয়

অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ঘৃণা ও ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানোর জন্য গোদী মিডিয়া বলে পরিচিত তিন টিভি চ্যানেলের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নিল দেশের নিউজ ব্রডকাস্টিং অ্যান্ড ডিজিটাল স্ট্যান্ডার্ডস অথরিটি (এনবিডিএসএ)। তিন চ্যানেলকেই একাধিক টিভি শো বন্ধ করে দেওয়ার এবং সাত দিনের মধ্যে সেগুলির অনলাইন উপস্থাপনাকে ডিজিটাল সংস্করণ থেকে সরানোর নির্দেশ দিয়েছে দেশের বেসরকারি ‍‌টিভি সংবাদ চ্যানেল এবং সংবাদ পোর্টালগুলির এই নিজস্ব নিয়ন্ত্রক সংস্থা, যার শীর্ষে রয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি এ কে সিক্রি। এই তিন চ্যানেল হলো টাইমস নাউ নবভারত, নিউজ এইটিন ইন্ডিয়া এবং আজ তক। ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানোর জন্য এনবিডিএসএ টাইমস নাউ নবভারতকে ১ লক্ষ টাকা ও নিউজ এইটিন ইন্ডিয়াকে ৫০ হাজার জরিমানা করেছে এবং কড়া ভাষায় সতর্ক করেছে আজ তককে। চ্যানেলগুলির যে সঞ্চালকদের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা, তাঁরা হলেন হিমাংশু দীক্ষিত, আমন চোপড়া, অমিশ দেবগন এবং সুধীর চৌধুরী— যাঁদের সবাই মোদী-ভক্ত বলে সুপরিচিত। এনবিডিএসএ এই শাস্তিমূলক ব্যবস্থার যে ব্যাখ্যা দিয়েছে, তাতে স্পষ্ট, গোদী মিডিয়ার এই তিনটি টিভি চ্যানেল আরএসএস’র হিন্দুত্ববাদী কর্মসূচির হয়ে প্রচার চালাচ্ছিল এবং মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়াচ্ছিল।
এনবিডিএসএ’র কাছে অভিযোগ জানিয়েছিলেন সমাজকর্মী ইন্দ্রজিৎ ঘোরপাড়ে। অভিযোগে তিনি টাইমস নাউ নবভারতের একটি, নিউজ এইটিন ইন্ডিয়ার তিনটি এবং আজ তকের একটি অনুষ্ঠানের কথা উল্লেখ করেছিলেন। অভিযোগের তদন্ত করে এনবিডিএসএ দেখেছে, টাইমস নাউ নবভারতের সঞ্চালক হিমাংশু দীক্ষিত একটি অনুষ্ঠানে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মুসলিমদের নিশানা বানিয়েছেন এবং আন্ত:ধর্ম সম্পর্ককে একতরফাভাবে ‘লাভ জিহাদ’ বলে অভিহিত করেছেন। নিউজ এইটিন ইন্ডিয়ার সঞ্চালক আমন চোপড়া দু’টি অনুষ্ঠানে এবং আরেক সঞ্চালক অমিশ দেবগন একটি অনুষ্ঠানে শ্রদ্ধা ওয়ালকরের হত্যাকাণ্ডকে তথাকথিত ‘লাভ জিহাদ’-এর তকমা দিয়ে সাম্প্রদায়িক খুন বলে প্রচার করেছেন ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানোর উদ্দেশ্য নিয়ে। আজ তকের সঞ্চালক সুধীর চৌধুরী রামনবমীর দিনের হিংসাত্মক ঘটনা নিয়ে একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়কে নিশানা করে অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেছেন। উল্লেখ্য, টাইমস নাউ নবভারত বেনেট, কোলম্যান অ্যান্ড কোম্পানির মালিকানাধীন টাইমস অব ইন্ডিয়া গোষ্ঠী পরিচালিত হিন্দি সংবাদ চ্যানেল। এই গোষ্ঠীর মুদ্রণ মাধ্যমের মধ্যে রয়েছে ইংরেজি দৈনিক দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া, ইংরেজি আর্থিক দৈনিক দ্য ইকনমিক টাইমস, হিন্দি দৈনিক নবভারত টাইমস, বাংলা দৈনিক এ‍‌ই সময় প্রভৃতি এবং টাইমস নাউ নবভারত ছাড়াও বৈদ্যুতিন মাধ্যমের মধ্যে রয়েছে ইংরেজি সংবাদ চ্যানেল টাইমস নাউ, বাণিজ্যিক সংবাদ চ্যানেল ইটি নাউ, চলচ্চিত্র বিষয়ক চ্যানেল মুভিস নাউ প্রভৃতি। নিউজ এইটিন ইন্ডিয়া এখন মোদী-ঘনিষ্ঠ শিল্পপতি মুকেশ আম্বানির মালিকানাধীন মিডিয়া কোম্পানি নেটওয়ার্ক এ‍ইটিনের হিন্দি সংবাদ চ্যানেল। এরই বাংলা সংবাদ চ্যানেল হলো নিউজ এইটিন বাংলা। আজ তকও একটি হিন্দি সংবাদ চ্যানেল, যেটি পরিচালনা করে ইন্ডিয়া টুডে গোষ্ঠী। 
লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, এনবিডিএসএ’র কাছে যে চ্যানেলগুলির বিরুদ্ধে মুসলিমদের নিশানা করে ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানোর অভিযোগ জমা পড়েছিল, সবগুলিই হিন্দি সংবাদ চ্যানেল। ভারতের বড় সংখ্যায় সাধারণ মানুষ এই ভাষায় কথা বলেন এবং ভাষাটি বোঝেন। এর অর্থ, সুপরিকল্পিতভাবেই এই ভাষার সংবাদ চ্যানেলগুলিতে ওই প্ররোচনামূলক প্রচার চালানো হয়েছে, যাতে বিরাট অংশের মানুষের মনকে মুসলিমদের সম্পর্কে সহজে বিষিয়ে দেওয়া যায় এবং এগিয়ে যায় সঙ্ঘ পরিবারের হিন্দুত্ববাদী কর্মসূচি। সমাজকর্মী ইন্দ্রজিৎ ঘোরপাড়ের অভিযোগের তদন্ত করে এনবিডিএসএ-ও তার রায়ে বলেছে, উল্লেখিত অনুষ্ঠানগুলিতে একতরফাভাবেই আন্ত:ধর্ম সম্পর্ককে ‘লাভ জিহাদ’ বলে দাগিয়ে দিয়ে সাম্প্রদায়িক রঙ চড়ানো হয়েছে। যে কোনও ধর্মের যে কোনও নাগরিকের তাঁর পছন্দের ব্যক্তিকে বিয়ে করার অধিকার আছে। কোনও হিন্দু মেয়ে অন্য কোনও ধর্মের কোনও ছেলেকে বিয়ে করা মানেই তা ‘লাভ জিহাদ’ নয়। এও দেখা গিয়েছে যে, একটি অনুষ্ঠানে আলোচকরা তা নিয়ে প্রশ্ন তুললে সঞ্চালক নিজেই চিৎকার করে তাঁদের থামিয়ে দিয়েছেন। যেভাবে এই অনুষ্ঠানগুলিতে গোটা একটি সম্প্রদায়কে নিশানা বানানো হয়েছে, তা পক্ষপাতিত্বহীনতা, বস্তুনিষ্ঠতা এবং নিরপেক্ষতার নীতিকে লঙ্ঘন করেছে। সুপ্রিম কোর্টও ২০২২ সালে ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমে ঘৃণা প্রচার নিয়ে এক মামলার শুনানিতে মন্তব্য করেছিল, ‘‘ঘৃণা টিভি চ্যানেলের টিআরপি বাড়া‌য়, মুনাফাও বাড়ায়।’’ প্রসঙ্গত, গত বছরেও এনবিডিএসএ এমন প্ররোচনামূলক অনুষ্ঠান সম্প্রচার করার জন্য নিউজ এইটিন ইন্ডিয়া, টাইমস নাউ এবং জি টিভির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছিল। সব মিলিয়ে তাদের সাতটি অনুষ্ঠানকে ডিজিটাল সংস্করণ এবং ইউটিউব চ্যানেল থেকে সরিয়ে দিতে বলেছিল। তারপরে‍‌ও যে গোদী মিডিয়ার সংবাদ চ্যানেলগুলি বেপরোয়া ভঙ্গিতেই সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ছড়ানোর প্রচার চালিয়ে গিয়েছে, এনবিডিএসএ’র সর্বশেষ শাস্তিমূলক পদক্ষেপে তা স্পষ্ট।

Comments :0

Login to leave a comment