Opposition meeting at patna

বিজেপি হটাতে একজোট লড়াইয়ের ডাক বিরোধী বৈঠকে

জাতীয়

কেন্দ্রের ক্ষমতা থেকে বিজেপি সরকারকে হটাতে একজোট লড়াইয়ের আহ্বান জানালেন দেশের বিরোধী নেতারা। শুক্রবার পাটনায় ১৭ টি বিরোধী দলের এক তাৎপর্যপূর্ণ বৈঠক থেকে বলা হয়েছে, দেশের গণতন্ত্র, সংবিধান, ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামো বাঁচানোর স্বার্থেই ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটে বিজেপি’কে পর্যুদস্ত করা দরকার। এজন্য নমনীয়তার পথে সমস্ত মতদ্বৈধতা সত্ত্বেও বিরোধী দলগুলিকে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করতে হবে। বিজেপি-বিরোধী লড়াইয়ের যৌথ কৌশল প্রণয়নে আগামী মাসে সিমলায় ফের এমনই বৈঠক হবে, জানিয়েছেন বিরোধী নেতারা।
পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনের আগে বিরোধীদের এটিই ছিলো প্রথম আনুষ্ঠানিক বৈঠক। বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার এবং উপমুখ্যমন্ত্রী তেজস্বী যাদবের আয়োজনে এদিন পাটনার বৈঠকে যোগ দিয়েছিলেন ৬জন মুখ্যমন্ত্রী এবং ১৭টি রাজনৈতিক দলের শীর্ষনেতারা। জানা গিয়েছে, রাজনৈতিক সমীকরণের ভিন্নতার কারণে দু’-একটি দলের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বৈরিতার ইঙ্গিত মিললেও এদিন সাধারণভাবে বৈঠকের মূল সুরের সঙ্গে একমত হন সব বিরোধী নেতাই। বৈঠক শেষে যৌথ সাংবাদিক সম্মেলনেও বিরোধী নেতাদের সেই মনোভাব স্পষ্ট হয়েছে।
পাটনায় ১ নম্বর অ্যানে মার্গে মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবনে প্রায় চার ঘন্টা আলোচনার পরে এদিন একযোগে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন বিরোধী নেতারা। তবে ‘‘বিমান ধরার তাড়া’’ থাকায় সাংবাদিক সম্মেলনের আগেই চলে যান দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরীওয়াল এবং পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী ভগবন্ত মান। এ নিয়ে খানিক গুঞ্জন থাকলেও নীতীশ কুমার সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘আমরা খুব ভালো বৈঠক করেছি। ১৭ দলের নেতারাই ইতিবাচকভাবে খোলামেলা মত প্রকাশ করেছেন। একসঙ্গে কাজ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে বৈঠকে। আগামী লোকসভা ভোটে ঐক্যবদ্ধভাবেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবো আমরা।’’ নীতীশ আরও বলেন, ‘‘মোদী সরকার দেশ এবং দেশবাসীর স্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করে চলেছে। তাই এই সরকারকে বিদেয় করতে হবে। আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই ফের বৈঠকে বসে ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করবো।’’
নীতীশ কুমারের বক্তব্যের পরেই কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে সাংবাদিকদের সামনে ঘোষণা করেন, ‘‘বিরোধী দলগুলির পরের শীর্ষ বৈঠক হবে হিমাচল প্রদেশের সিমলায়, আগামী মাসে।’’ প্রসঙ্গত, হিমাচলে এখন কংগ্রেসের সরকার। খাড়গে বলেন, ‘‘নির্বাচনী লড়াইয়ের জন্য বিরোধীদের একটি যৌথ সাধারণ কর্মসূচি তৈরির সিদ্ধান্ত হয়েছে। এব্যাপারে আমরা কিভাবে এগোবো, তা ঠিক হবে পরের বৈঠকে। সব রাজ্যের পরিস্থিতি এক নয়। তাই প্রতিটি রাজ্যের জন্য আলাদা আলাদা পরিকল্পনা করতে হবে। তবে কেন্দ্রের ক্ষমতা থেকে বিজেপি’কে ছুঁড়ে ফেলার লক্ষ্যেই একযোগে লড়বো আমরা সকলে।’’
কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী বলেন, ‘‘আমাদের নিজেদের মধ্যে কিছু কিছু মতবিরোধ থাকতে পারে। কিন্তু তা সত্ত্বেও নমনীয়তার সঙ্গেই একসঙ্গে কাজ করার এবং আমাদের আদর্শ রক্ষার সিদ্ধান্ত করেছি আমরা।’’ কেন্দ্রের আরএসএস-বিজেপি সরকারকে তীব্র আক্রমণ করে রাহুল বলেন, ‘‘যে নীতি ও আদর্শের ভিত্তিতে ভারত গঠিত হয়েছিলো, সেই সংস্কৃতির ভিত্তিমূলেই আঘাত হেনেছে ওরা।’’
সিপিআই(এম)’র সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি সাংবাদিকদের সামনে বলেন, ‘‘আমাদের দেশের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক কাঠামোটিই বদলে দিতে উদ্যত হয়েছে আরএসএস-বিজেপি। তারা ফ্যাসিবাদী হিন্দুত্ব রাষ্ট্র গঠন করতে চায়। ভারতের সাধারণতন্ত্রের মূল চরিত্র রক্ষাই আজকের দিনের প্রধান কাজ।’’ ইয়েচুরি বলেন, রাজ্যে রাজ্যে নির্দিষ্ট পরিস্থিতি রয়েছে। কিন্তু মূল লক্ষ্য হবে ধর্মনিরপেক্ষ ভোট যেন ভাগ না হয়। সংবিধান রক্ষার সঙ্গে সঙ্গেই জনগণের জীবনজীবিকার সংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে। বিশেষ করে বেকারী, মূল্যবৃদ্ধির মতো বিষয়ে। বিরোধীরা এইসব প্রশ্নে আন্দোলন গড়ে তোলার বিষয়ে একমত হয়েছেন। 
সিপিআই’র সাধারণ সম্পাদক ডি রাজা বলেন, ‘‘নয় বছরের বিজেপি-শাসন আমাদের দেশের সংবিধানের পক্ষে বিপর্যয়সৃষ্টিকারী এবং ক্ষতিকর হয়ে উঠেছে।’’
অসুস্থ শরীরেও এদিন বৈঠকের পরে সাংবাদিকদের সামনে আসেন রাষ্ট্রীয় জনতা দল (আরজেডি)’র প্রতিষ্ঠাতা-নেতা লালুপ্রসাদ যাদব। সকলের উদ্দেশে তিনি বার্তা দেন, ‘‘বিজেপি এবং আরএসএসের বিরুদ্ধে আমরা একজোট হয়ে লড়ি, দেশের মানুষ এটিই দেখতে চান।’’ তিনি বলেন, ‘‘মানুষ আক্ষেপ করে বলে এদেশের বিরোধীরা একসঙ্গে লড়তে পারেনা। তাই বিরোধী ভোট ভাগ হয়ে যায়। কিন্তু বিজেপি-আমলে দেশ এখন ভাঙনের মুখে। দেশ রক্ষায় তাই একজোট হয়েই এগোতে হবে আমাদের।’’ লালুপ্রসাদের কটাক্ষ, ‘‘নিজের দেশের মানুষ যখন হাজারো সমস্যায় জর্জরিত, তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদী চন্দনকাঠ বিলোচ্ছেন! এদেশে এবার ভুগতে হবে মোদী এবং বিজেপি’কে।’’
রাজনৈতিক দোদুল্যমানতা এবং রহস্যময়তার জন্য অতিপরিচিত তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী তথা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিও এদিন সাংবাদিকদের সামনে বলেন, ‘‘পাটনা থেকে যা শুরু হয়, তা-ই পরবর্তী সময়ে গণআন্দোলনের চেহারা পেয়ে যায়। কেন্দ্রের এই স্বৈরাচারী সরকার যদি পরের বারও ক্ষমতায় ফিরে আসে, তাহলে এদেশে আর কোন নির্বাচনই হবে না। দেশের ইতিহাসও বদলে দিচ্ছে বিজেপি। তাই ওদের বিরুদ্ধে একসঙ্গে লড়বো আমরা সবাই।’’
ন্যাশনালিস্ট কংগ্রেস পার্টি (এনসিপি)’র প্রধান শারদ পাওয়ার বলেন, ‘‘জয়প্রকাশ নারায়ণের সেই আন্দোলনের মতো এবারের লড়াইও দেশবাসীর আশীর্বাদ লাভ করবে।’’
জম্মু-কাশ্মীরের ন্যাশনাল কনফারেন্স নেতা ওমর আবদুল্লাহ বলেন, ‘‘শুধু ক্ষমতার জন্য নয়, আদর্শের জন্যই আজ কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারীর ১৭ টি দল একত্রিত হয়েছে।’’ বক্তব্য রাখেন জম্মু-কাশ্মীরের পিডিপি নেত্রী মেহবুবা মুফতিও। তাঁর মন্তব্য, ‘‘গান্ধীর ভারতকে আমরা গডসের ভারতে পরিণত হতে দিতে পারিনা।’’
সমাজবাদী পার্টির নেতা অখিলেশ সিং যাদব বলেন, ‘‘দেশ বাঁচানোর স্বার্থে আমাদের একজোট হয়ে লড়তে হবে, পাটনা-বৈঠক এই বার্তাই দিয়েছে।’’
ঝাড়খন্ডের মুখ্যমন্ত্রী ও ঝাড়খন্ড মুক্তি মোর্চার নেতা হেমন্ত সোরেন বলেন, ‘‘সব নেতাই ইতিবাচক চিন্তার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। আজকের বৈঠক আগামী ভারতের জন্য অন্যতম মাইলফলক হয়ে থাকবে।’’
এদিনের বিরোধী-বৈঠকে এঁরা ছাড়াও হাজির ছিলেন ডিএমকে প্রধান তথা তামিলনাডুর মুখ্যমন্ত্রী এমকে স্ট্যালিন, সিপিআই(এমএল-লিবাবেশন)’র সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য, মহারাষ্ট্রের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তথা শিবসেনা (ইউবিটি) নেতা উদ্ধব থ্যাকারে, শারদ পাওয়ারের কন্যা সুপ্রিয়া সুলে, তৃণমূল সাংসদ অভিষেক ব্যানার্জি প্রমুখ।
এদিন বিরোধী-বৈঠকের পরে এহেন ঐক্যের সুরে কিছুটা ছন্দপতন হয় সাংবাদিক সম্মেলনে দিল্লি এবং পাঞ্জাবের দুই মুখ্যমন্ত্রীর গরহাজিরায়। বৈঠকের পরে সাংবাদিকদের সামনে আর হাজির হননি আম আদমি পার্টির এই দুই নেতা। বৈঠকের উদ্যোক্তা নীতীশ কুমার এব্যাপারে অবশ্য কারুর নাম না করে পরে বলেন, ফেরার বিমান ধরার তাড়া থাকায় কেউ কেউ আগেই চলে গিয়েছেন। কিন্তু জানা গিয়েছে, দিল্লির প্রশাসনিক ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে মোদী সরকার কিছুদিন আগে যে অর্ডিন্যান্স জারি করেছে সেব্যাপারে কংগ্রেসের অবস্থান স্পষ্ট করার দাবি তুলেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল। কিন্তু তাঁর এই প্রচেষ্টা সফল না হওয়ায় যথেষ্ট ক্ষুব্ধ হন তিনি। পরে এক বিবৃতিতেও বিষয়টি স্পষ্ট করে আম আদমি পার্টি বলেছে, ‘‘অসাংবিধানিক, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর বিরোধী এবং পুরোপুরি অগণতান্ত্রিক এই কালা অর্ডিন্যাস রাজ্যসভায় উত্থাপিত হলে কংগ্রেসের ৩১জন সাংসদের সকলে বিরোধিতা করবেন কিনা তা স্পষ্ট হওয়া দরকার। অন্যথায় কংগ্রেসের উপস্থিতিতে এই ধরনের কোন বৈঠকে আমাদের যোগদান খুবই কঠিন হয়ে পড়বে।’’
এদিকে পাটনায় বিরোধী বৈঠককে কটাক্ষ করে বিজেপি নেতা অমিত শাহ এদিন জম্মুতে বলেন, ‘‘বিরোধী জোট অসম্ভব। পাটনায় এখন দলবদ্ধভাবে ফটো তোলার অধিবেশন চলছে। ২০২৪ সালে বর্ধিত আসন নিয়ে নরেন্দ্র মোদীর প্রত্যাবর্তন কেউ আটকাতে পারবে না।’’

 

Comments :0

Login to leave a comment