RSS

রামমন্দির নিয়ে উন্মাদনা তৈরি করতে গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ার নির্দেশ সঙ্ঘের

জাতীয়

 রামমন্দির নিয়ে দেশজুড়ে উন্মাদনা তৈরি করার জন্য সমগ্র সংগঠনকে গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ার নির্দেশ দিল রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ (আরএসএস)। এর পাশাপাশি হিন্দুত্ব এবং জাতীয়তাবাদের মিশেলে আরও কতগুলি বিষয় উত্থাপন করেছেন আরএসএস নেতারা। ফলে সেগুলি নিয়ে এবার কেন্দ্র এবং রাজ্যের বিজেপি সরকার এবং হিন্দুত্ববাদীদের সব ধরনের মেশিনারি সক্রিয় হবে। ছয় মাসের মধ্যে লোকসভা নির্বাচন। তার আগে তিন দিন ধরে গুজরাটের ভুজে সংগঠনের বৈঠক করে কর্মীদের এবং সরকারের সুর বেঁধে দিল আরএসএস। 
রবিবার শুরু হওয়া বৈঠকে সঙ্ঘপ্রধান মোহন ভাগবত এবং সাধারণ সম্পাদক দত্তাত্রেয় হোসাবালে  উপস্থিত ছিলেন। এদিন বৈঠক শেষে যদিও সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়েছিলেন শুধুমাত্র হোসাবালে। সেখানেই তাঁর বক্তব্যে স্পষ্ট হয়,  অযোধ্যায় মন্দির নির্মাণের শ্রী রাম জন্মভূমি তীর্থক্ষেত্র ট্রাস্ট সঙ্ঘের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতেই সম্পূর্ণ কর্মসূচি গ্রহণ করছে এবং সঙ্ঘও তাদের সম্পূর্ণ সংগঠন এবং বিশাল কর্মী বাহিনীকে গোটা দেশে এই কাজে নামিয়ে দিচ্ছে। তিন দিনের অধিবেশনে উপস্থিত এক কর্মী জানিয়েছেন ইতিমধ্যেই এই কাজে নেমে পড়েছেন সঙ্ঘকর্মীরা। হোসাবালে জানিয়েছেন, রাষ্ট্রীয় অস্মিতার অনেক বড় আন্দোলন আমাদের সময়ে হয়েছে। সেটা হলো অযোধ্যায় রামজন্মভূমির একটি বিশাল মন্দির নির্মাণের। সঙ্ঘের স্বয়ংসেবকরা এই আন্দোলনে সমগ্র হিন্দু সমাজকে যুক্ত করার কাজ করেছিল, নিজেরাও অংশ নিয়েছিল। এখন একটি ঐতিহাসিক সময় এসেছে রামলালার প্রাণ প্রতিষ্ঠা হবে। ট্রাস্ট আমাদের জানিয়েছে সংক্রান্তি থেকে সাতদিনের অনুষ্ঠান হবে। শেষ দিন অর্থাৎ ২২ জানুয়ারি প্রাণ প্রতিষ্ঠার প্রধান অনুষ্ঠান হবে। সেদিন প্রধানমন্ত্রী উপস্থিত থাকবেন।’ এদিকে তার আগে গোটা দেশে ১ থেকে ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত গ্রামে গ্রামে প্রতিটি ঘরে যাওয়ার কর্মসূচি বেঁধে দিল আরএসএস। 
আরএসএস এই কর্মসূচিকে আমন্ত্রণ জানানোর কর্মসূচি বলছে। এই জন্য গত সোমবার থেকেই অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে অযোধ্যায়। অক্ষত অনুষ্ঠান অর্থাৎ ১০০ কুইন্টাল চালের মধ্যে হলুদ এবং ঘি মিশিয়ে তা  পিতলের কলসীতে ভরে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে রওনা হয়ে গেছে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ কর্মীরা। বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নামেই যেহেতু এই কাজ হবে তাই তাদের সাংগঠনিক হিসাবে দেশের ৫০টির বেশি সাংগঠনিক অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে। সেখানে এই ‘অক্ষত’ পৌঁছানো শুরু হয়ে গেছে। এরপরে আরও ছোট ছোট ভাগে বিভক্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত পৌঁছানো হবে গ্রামে গ্রামে। ৫ লক্ষ গ্রামে পৌঁছানোর লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা হয়েছে। সেখানে ১-১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত এই চাল এবং রামমন্দিরের ছবি নিয়ে যাবেন বিশ্ব হিন্দু পরিষদের কর্মীরা। এর জন্য ২ কোটি প্রচারপত্র ছাপানো হচ্ছে। গ্রামে গ্রামে এইগুলি দিয়ে অযোধ্যায় রামমন্দির দর্শনের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হবে। তবে এক্ষেত্রে জোর দেওয়া হয়েছে উত্তর প্রদেশেই। কলস বিতরণের হিসাবেই তা বোঝা যাচ্ছে। রামমন্দির তীর্থ ক্ষেত্র ট্রাস্টের সদস্য জানিয়েছেন, ৫২টি কলসের মধ্যে ৩০টিই যাবে উত্তর প্রদেশের বিভিন্ন অংশে। লোকসভার ৮০টি আসন আছে উত্তর প্রদেশে। এরমধ্যে ৬৪টি আসনে গতবার বিজেপি জয় পেয়েছিল। যে কোনোভাবে এই আসন ধরে রাখতে অথবা বাড়াতে মরিয়া বিজেপি। সেক্ষেত্রে রামমন্দিরের আবেগকে উত্তর প্রদেশেই সর্বাধিক কাজে লাগাতে চায় সঙ্ঘ পরিবার। ফলে রামলালার প্রসাদ স্বরূপ অক্ষতের ভাগও বেশি পেতে চলেছে উত্তর প্রদেশের মানুষ। ২৩ জানুয়ারি থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অযোধ্যায় নতুন রামমন্দিরে লাখো লাখো লোক যাতে আসতে থাকেন, তা নিশ্চিত করতে চাইছে আরএসএস। পরবর্তী ৪৮ দিন টানা এইভাবে মন্দির দেখতে লোকসমাগম করতে চাইছে সঙ্ঘ। হিসাব করে দেখলে ওই সময়েই লোকসভা ভোটের ঘোষণা হবে। ফলে জানুয়ারি মাসের শুরু থেকে সম্পূর্ণ সময়টা রামমন্দিরের আবেগে মানুষকে ডুবিয়ে রাখতে চাইছে আরএসএস। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ সমেত সঙ্ঘের সমস্ত পরিচিত অপরিচিত সংগঠনকে এই কাজে নামানো হচ্ছে। ভুজের তিন দিনের আলোচনায় এমনই স্থির হয়েছে বলে সেখানে উপস্থিত এক স্বয়ংসেবক জানিয়েছেন। 
এদিকে হোসাবালে আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এদিন বলেছেন। তারমধ্যে সঙ্ঘের শতবর্ষ যেহেতু আগামী বছর শুরু হচ্ছে সেই হিসাবে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, ভারত অতীতেও হিন্দু রাষ্ট্র ছিল, এখনও আছে এবং ভবিষ্যতেও হিন্দু রাষ্ট্র থাকবে। এর জন্য আলাদা করে ঘোষণার প্রয়োজন নেই। এমন একটা গুঞ্জন চলছে, ফের মোদী সরকার একইরকম গরিষ্ঠতা নিয়ে ফিরলে ২০২৫ সালে আরএসএস’র শতবর্ষ পূর্তিতে ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র বলে ঘোষণা করা হবে। সেই কারণেই এই প্রশ্ন করা হয়েছিল বলে মনে করা হচ্ছে। কিন্তু হোসাবালে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উত্থাপন করেছেন, যাকে নিয়ে কেন্দ্রের সরকার এবং বিজেপি সহ হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি আগামী দিনে প্রচারে নামতে চলেছে বলে মনে করা হচ্ছে। হোসাবালে বলেছেন, পাকিস্তানের সীমান্তের সঙ্গে থাকা ভারতের গ্রামগুলি থেকে হিন্দুরা পলায়ন করছেন। এমনকি গুজরাটের কচ্ছ জেলা থেকেও এই পলায়ন হচ্ছে। আরএসএস’র তিন দিনের এই অধিবেশনে সীমান্তের গ্রামগুলির নিরাপত্তা নিয়ে পর্যালোচনা করা হয়েছে। সেখানে ধর্মান্তরকরণ হচ্ছে বলেও তিনি দাবি করেছেন। সীমান্ত এলাকায় দেশপ্রেমিক জনগণের থাকা দেশের নিরাপত্তা এবং সুরক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্লেষকদের অভিমত, এটা একটা নতুন বিষয় উত্থাপন করলো সঙ্ঘ। জম্মু-কাশ্মীর এবং গুজরাট উভয়েই এখন বিজেপি’র সরকারের হাতে। তা সত্ত্বেও সেখানে কেন এইধরনের ঘটনা ঘটছে এই প্রশ্ন বিরোধীরা, বিশেষত কংগ্রেস তুলতে পারে। তাতে কেন্দ্র এবং গুজরাট সরকার কিছুটা অপদস্থ হতে পারে কিন্তু আখেরে বড় লাভ আছে বিজেপি’র। অভ্যন্তরীণ সমস্যায় জর্জরিত ধুঁকতে থাকা পাকিস্তানকে ঘিরে এখন আর তেমনভাবে জিগির তৈরি করা যাচ্ছে না। এই অবস্থায় এই নয়া প্রচার হিন্দুত্বের মিশেলে জাতীয়তাবাদের আবেগ তৈরির কাজে লাগানো হবে। 
এই একই কৌশল নেওয়া হচ্ছে দক্ষিণ ভারতের ক্ষেত্রে। প্রায় পুরো দক্ষিণ ভারতে বিজেপি’র পা রাখার জায়গা আগের থেকে সঙ্কুচিত হয়েছে। বিশেষ করে কর্নাটকে ভোটে বিজেপি হারার পরে এমন একটা পরিস্থিতি সেখানের বিরোধী দলগুলি তৈরি করতে পেরেছে যে, বিজেপি মনে করছে লোকসভা ভোটেও পরিস্থিতি খারাপ হতে চলেছে। এরমধ্যেই সনাতন ধর্ম বিতর্কে উদয়নিধি স্ট্যালিনের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে তামিলনাডুতে নিজেদের অবস্থান বিজেপি আরও দুর্বল করেছে বলেই সঙ্ঘের অভ্যন্তরীণ রিপোর্ট। দ্রাবিড় আবেগকে ডিএমকে নিজেদের দিকে টেনে নিচ্ছে মনে করায় এডিএমকেও বিজেপি’র হাত ছেড়েছে তামিলনাডুতে। হোসাবালে এই প্রসঙ্গ উল্লেখ করে সাংবাদিক বৈঠকে বলেছেন, কেউ কেউ এখন বলছেন দক্ষিণ ভারত উত্তর ভারত থেকে আলাদা। একটি রাজনৈতিক এবং বৌদ্ধিক ষড়যন্ত্র চলছে দক্ষিণ ভারতকে উত্তর ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করে নেওয়ার। বলা হচ্ছে, তারা দ্রাবিড়ীয় এবং আমাদের ভাষা ভিন্ন। এটা দেশকে দুর্বল করার কৌশল। মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে এই ধরনের কৌশলে ব্যর্থ করতে এবং যাতে এরা সফল না হয়, তা নিশ্চিত করতে। উল্লেখ্য, বিজয়া দশমীর সভা থেকে সঙ্ঘপ্রধান ভাগবত আক্রমণ করেছিলেন মার্কসবাদীদের। ‘ধ্বংসাত্মক শক্তি’র সঙ্গে ‘সাংস্কৃতিক মার্কসবাদীরা’ বা ‘সমাজের জাগ্রত অংশের’ তুলনা টেনে ভাগবত বলেন, ‘এই ধরনের শক্তির কাজ সমাজে নৈরাজ্য, অস্থিরতা ও দুর্নীতিকে উৎসাহ দেওয়া। সংবাদমাধ্যম, বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে এঁদের প্রভাবের ফলে এঁরা সামাজিক শৃঙ্খল, নৈতিকতা, সংস্কৃতি, মর্যাদা ও সংযমকে ধ্বংস করে। এঁদের লক্ষ্য, বিশ্বশান্তি বিঘ্নিত করা। ধর্মীয় জিগির তোলার পথে বাধা মার্কসবাদীদের বিরুদ্ধে যেভাবে সেদিন ভাগবৎ আক্রমণ করেছিলেন, এদিন সেইভাবেই হোসাবালে দ্রাবিড়ীয় সংস্কৃতির প্রচারকদের বিরুদ্ধে নামতে নির্দেশ দিয়েছেন।

Comments :0

Login to leave a comment