INSAF JATRA DAY 2

‘ন্যায় চাই, আমাদের কথা বলতে চাই’, শ্রমজীবীদের নাছোড় গ্রামে থামল আশার পদযাত্রা

রাজ্য

ইনসাফ যাত্রা সোনাপুরে দাঁড়াবে না জানতেন না সোনাপুরের অটো চালক মিরান বর্মন। সামনে দিয়ে ইনসাফ যাত্রাকে এগিয়ে যেত দেখে বেপরোয়া মিরান এক পদযাত্রীকে হাত ধরে টেনে দাঁড় করিয়ে বললেন, ‘‘আমি আর আমার স্ত্রী দু বছর আগে ২৫ দিন করে ১০০ দিনের কাজ করেও টাকা পাই নি। একটু বলে দেবেন সবাইকে।’’ 
সোনাপুরেই বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলেন সতীশ সরকার ও তাঁর সঙ্গী উৎপল দাস। সতীশ সরকার তাঁর বন্ধুকে উদ্দেশ্যে বললেন, পঞ্চায়েত ভোটের আগে যুবরাজের রাজসিক যাত্রা ছিল পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ। আর এদের দেখছি মানুষে মানুষে ছয়লাপ। দম আছে ছেলেগুলোর! নইলে হেঁটে কেউ কলকাতায় যায় ইনসাফ চাইতে? দুজনের কথা শুনে রাস্তায় দাঁড়ানো দুই মহিলা সিভিক ভলেন্টিয়ারও মুচকি হেসে যেন ওদের সমর্থন জানালো।
সামনে দুটি পতাকা। একটি জাতীয় পতাকা। আর একটি সাদা পতাকায় লাল তারা। ইনসাফ যাত্রা আলিপুরদুয়ারের বাবুরহাট থেকে দ্বিতীয় দিনের শুরু হয় মানুষের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই।
শুধু বদলে গেছে চারপাশের পরিবেশ আর জীবন জীবিকার চালচিত্র। যন্ত্রনার ছবিটা অবশ্য একই।
কোচবিহার জেলা মানেই ছিল কৃষিবলয় আর তাকে ঘিরে যন্ত্রণা। আর আলিপুরদুয়ার জেলার পথের বাঁকে বাঁকে দাঁড়িয়ে ছিল কৃষিবলয়ের পাশাপাশি ৬২ চা-বাগান, ৪২ বনবস্তী আর শিলতোর্ষা নদীর বালি-পাথর তোলার সঙ্গে জড়িত ৪ টি পঞ্চায়েতের প্রায় ৬০ হাজার মানুষের রুটি-রুজি কেড়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে ক্ষোভ আর যন্ত্রণার ধূসর ছবি।
পথের বাঁকে দেখা মিলেছে দলগাঁও চা বাগান, বীরপাড়া চা-বাগান, তাসা টি এস্টেটের শ্রমিকদের। যাত্রা পথে বনবস্তি না পড়লেও 
কালকূট, রাজাভাতখাওয়া বনবস্তির যুবকরা এসে মূল পদযাত্রীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে এগিয়ে দিলেন ৫ কিমি পথ। এদিন আলিপুরদুয়ারের বাবুরহাটে স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে মিলিত হয়ে বক্তব্য রাখলেন মীনাক্ষী মুখার্জি, সোহম মুখার্জি আর জয়নাথ রায়।
এখানেই কোচবিহার জেলার মাথাভাঙা মহকুমা, ফালাকাটায় গত ৭২ ঘন্টায় হাতির দলের হানায় ৬ জন গ্রামবাসী নিহত ও এক বনকর্মী সহ ৪ জনের আহতের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে নীরবতা পালনের পাশাপাশি নিহত ও আহতদের পরিবারের সদস্যদের ক্ষতিপূরণের দাবি তুললো  ইনসাফ যাত্রা।
নভেম্বরের শুরু। এসময়ে ডুয়ার্সে শীত নেমে আসার সময় হলেও এবারে বেলা ১১ টায় মাথার ওপরে সূর্য যেন আগুন ঝড়াচ্ছে। তার মাঝেই সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে ইনসাফ যাত্রা। শীলতোর্সা সেতুর ওপর ইনসাফ যাত্রার পথ আটকে দাঁড়ালেন, জনা ৫০ গ্রামবাসী। ওদের মধ্যে কেউ শ্রমিক, কেউ লরি, ট্রেকারের মালিক কেউবা ঠিকাদার। অথচ সবার দাবি একটাই — ‘‘ন্যায় চাই আমরা। আমাদের অনেক কথা। বলতে চাই যুব নেতাদের সঙ্গে।’’ জনতার দাবির সামনে ইনসাফ যাত্রা দাঁড়িয়ে পড়লো। জনতার সামনে এগিয়ে এলেন মীনাক্ষী মুখার্জি, কলতান দাশগুপ্ত আর ধ্রুবজ্যোতি সাহারা। গ্রামবাসীরা জানালেন অজানা কারনে শিলতোর্সা নদী থেকে বালু পাথর তুলতে দিচ্ছে না প্রশাসন। আশেপাশের ৪ গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রায় ৭০ হাজার মানুষের জীবিকা কেড়ে নিয়েছে দু বছর ধরে। প্রায় এক হাজার লরি, ট্রেকার বসে আছে। ঠিকাদাররা বলছেন দু বছর আগে ২০২১ এর ডিসেম্বরে প্রায় দেড় কোটি টাকা জমা দিলেও অনুমতি মেলেনি বালি পাথর তোলার। অথচ জেলার রায়ডাক নদীতে ড্রেজিং করছে কলকাতার এক কোম্পানী। ওদের অভিযোগ ওই কোম্পানিকে সুবিধে পাইয়ে দিতেই আমাদের রুটি রুজিতে লাথি মেরেছে সরকার। ওদের দাবি পথ চলতে চলতে আমাদের যন্ত্রনার কথাও মানুষের কাছে তুলে ধরুন আপনারা। আমাদের সংগ্রাম কমিটি আপনাদের সঙ্গে আছে। ওদের সঙ্গে কথা বলে মীনাক্ষী মুখার্জি সাংবাদিকদের বললেন,‘‘শিল্পাঞ্চলে কয়লা চুরি করছে ওরা। আর ডুয়ার্সে বালি চুরি করছে।ইনসাফ যাত্রাও ওদের যন্ত্রনার সঙ্গী।৭ ই জানুয়ারির মানষের ব্রিগেড শুনবে শিলতোর্সার পাড়ের যন্ত্রনার কথা।’’
নদীকে পিছনে রেখে ইনসাফ যাত্রা দাঁড়ালো পলাশবড়িতে। এখানে মঞ্চ বেঁধে সভা হবে। তার আগে মিছিলকে স্বাগত জানালো খুদে মেয়েরা। উত্তরবঙ্গের মানুষ অতিথিদের স্বাগত জানায় বৈরাতী নৃত্য দিয়ে। মুগ্ধ হয়ে ওদের নাচ দেখলো ইনসাফ যাত্রায় হাঁটা সংগ্রামী  যৌবন। পদযাত্রী সমর বালা, রাহুল বসুমাতা, দীনবন্ধু বর্মণরা ক্ষুদে শিল্পীদের সঙ্গে ছবিও তুললো। এখান থেকে পদযাত্রা এগিয়েছে শিশারগোড়ের দিকে। পদযাত্রীদের স্বাগত জানাতে দাঁড়িয়ে অনেকে। এখানেই দেখা মিললো সুজয় তরফদারের। সাতদিন আগেই মাকে হারিয়েছেন। শোকের পোষাকেই হাজির তিনিও। বললেন,স্ত্রী নিষেধ করেছিল আসতে। কিন্তু পদযাত্রীদের অভিনন্দন জানাতে না এসে পারলাম না। এটা আসলে বামপন্থার প্রতি নাড়ির টান, বুঝলেন। স্মিত হাসলেন মাঝবয়সী  মানুষটা। কৃষকসভার নেতা শংকর মজুমদার জানালেন, শিশারগোড় জমির আন্দোলনের শক্ত ঘাঁটি ছিল।জোতদারদের অতিরিক্ত জমি কেড়ে নিয়ে গরীবের মধ্যে বিলি করা শুরু হয়েছিল যুক্তফ্রন্ট আমল থেকে।গড়ে উঠেছে একাধিক বস্তি। ভোটের অঙ্কে আমরা হেরে গেলেও মানুষের হৃদয়ে আছি। আর তাই ইনসাফ যাত্রাকে স্বাগত জানাতে এসেছেন প্রচুর মানুষ।
চা বাগান আন্দোলনের নেতা পঞ্চায়েত ওঁরাও, কমল মিনজ আর নিশ্চন ঝা আর তাদের সঙ্গীরা এগিয়ে যাওয়া পদযাত্রীদের পুষ্পস্তবক দিয়ে স্বাগত জানিয়ে পদযাত্রায় শামিল হলেন। শিশারগোড়ে পদযাত্রীদের স্বাগত জানাতে এসেছিলেন যাত্রী ওঁরাও, অনিতা ওঁরাও, উমা ওঁরাও,শিলা গোয়ালা, রাজেশ্বরী লুগুন, ধনমাইত গৈরের মত ৫০ জনের একটি দল। ওদের নেতা,পঞ্চায়েত ওঁরাও জানালেন, আমাদের মজুরির দাবি নিয়ে লং মার্চ করেছি সংকোশ থেকে টানা ৭ দিন। মজুরির দাবি এখনও মেটেনি। এখনও মজুরি দিনে ২৫০ টাকা। ন্যূনতম মজুরির দাবি না মেটা পর্যন্ত লড়াই চলবে।
মীনাক্ষী মুখার্জি জানালেন,‘‘৬০ দিনে আমাদের দুহাজার কিমি পথ অতিক্রম করার কথা। তবে দুদিনের অভিজ্ঞতা বলছে ৬০ দিনে হয়তো বাড়তি ৩০০ কিমি পথ হাঁটতেই হবে।’’ এদিন ফালাকাটায় ইনসাফ যাত্রা বিকেল ৪ টায় পৌঁছোনোর কথা থাকলেও ওরা পৌঁছোয় সন্ধ্যে ৭ টায়। দীর্ঘক্ষন অপেক্ষাতেও ক্লান্তি নেই অপেক্ষমান জনতার। এখানেও সংক্ষিপ্ত সভায় বক্তব্য রাখলেন,মীনাক্ষী মুখাজী, ধ্রুবজ্যোতি সাহা ও বাপন গোপ। তিন বক্তা তাদের বক্তব্যে তুলে ধরলেন চা-বাগান, বনবস্তীর বাসিন্দাদের দূর্দশার কথা। তাঁরা বললেন, বাগানের জমি মুখমন্ত্রী বড় বড় হোটেল মালিকদের হাতে তুলে দেবার আইন পাশ করিয়েছে। অথচ বাগানে বাগানে শ্রমিকরা যখন তাদের অধিকারে থাকা বসতবাড়ি ও চাষের জমির পাট্টা চাইছে সে পাট্টা মিলছে না। আলিপুরদুয়ার জেলায় দিনভর হাঁটতে হাঁটতে চা শ্রমিকদের মুখে শুনেছি বাগানের হাসপাতালগুলিতে এমবিবিএস চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও ৩/৪ টের বেশি বাগানে সে ব্যবস্থা নেই। হাতুড়ে চিকিৎসকরাই ভরসা শ্রমিক ও তাদের পরিবারের। বাগানের শ্রমিকদের স্ত্রী,বাচ্চারা অপুষ্টিতে ভুগছে। বাগান ছেড়ে শ্রমিক পরিবারের ছেলে-মেয়েরা ছুটছে ভিন রাজ্যে। আমাদের ইনসাফ যাত্রা চা বাগান শ্রমিকদের এই যন্ত্রনা থেকে মুক্তি চায়। তাদের মুক্তির পথ খুঁজে বের করবে এই পদযাত্রা। আলিপুরদুয়ারের যুব সংগঠনের জেলা সম্পাদক রাজু ব্যনার্জি জানালেন, আলিপুরদুয়ারের ৫০ জন শ্রমিক যারা এখন ভিন রাজ্যে (কেরালায়)কাজ করে তাঁরা ফোনে জানিয়েছে ওরা নিজেরা টিকিট কেটে ব্রিগ্রেড সমাবেশে আসবেন। নিজেদের মজুরি থেকে ইনসাফ যাত্রার খরচের জন্য চাঁদাও দেবেন।

Comments :0

Login to leave a comment