বিশ্বজিৎ রায়- বারাকপুর
কাঁচড়াপাড়া রেলের কোচ ফ্যাক্টরি হবে বলে ২০১০ সালে বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী (তখন তিনি রেলমন্ত্রী) শিলা পুঁতেছিলেন। সেই শিলা আজ খুঁজে পাওয়া যাবে না। সেই শিলা পুঁতে কাঁচড়াপাড়ায় দাঁড়িয়ে তিনি ঘোষণা করেছিলেন এই বারাকপুর শিল্পাঞ্চলে বেকার থাকবে না।
গত তেরো বছরে রেলের কোচ ফ্যাক্টরির একটি ইট গাঁথা হয়নি। সেখানে এখন মদ, জুয়া ও সমাজবিরোধীদের আস্তানা হয়েছে!
‘শিল্পতাড়ুয়া মুখ্যমন্ত্রী।’
এভাবেই সম্বোধন করছেন স্থানীয় যুবক সায়ন্তন দে। হালিশহরের স্টেশন রোডে থাকেন। উচ্চ মাধ্যমিক পাশ। আর্থিক কষ্টের জন্য পড়াশোনা আর এগোয়নি। নিজের গাড়ি নেই। অন্যের গাড়ি চালান। সেই সামান্য পয়সা দিয়ে সংসার চলে। ইনসাফ যাত্রায় হাঁটতে হাঁটতে সায়ন্তন বললেন, ‘‘কাচড়াপাড়ায় রেলের কোচ ফ্যাক্টরি হলে একটা কাজ হবে আশা করেছিলাম। কিন্তু কিছুই হলো না। কাচড়াপাড়ার ভূমিপুত্র বলে নিজেকে দাবি করেন মুকুল রায়। তিনি রেলমন্ত্রী থাকার সময় কোচ ফ্যাক্টরির আবার একটি শিলা পুঁতেছিলেন। সেটিও এখন খুঁজে পাওয়া যায় না।’’
কোচ ফ্যাক্টরি হবে এই ঘোষণার পর তৃণমূলের দপ্তরগুলিতে বেকারদের নাম লেখানোর ঠিকানা হয়ে উঠেছিল। কোচ ফ্যাক্টরির প্রস্তাবিত জায়গায় সকাল থেকেই বেকার যুবকদের লাইন থাকত।
সায়ন্তন বলছেন, ‘‘তৃণমূলের লোকজন সেই যুবকদের থেকে থেকে বায়োডাটা সংগ্রহ করত। সিঙ্গুর থেকে শিল্প তাড়িয়েছে। আমাদের মতো যুবকদের ভবিষ্যতকে অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে।’’
ইনসাফ যাত্রায় এদিন মানুষের ঢল নামে। রাস্তায় মানুষ ফুল ও মালায় ইনসাফ যাত্রার পদযাত্রীদের বরণ করেন। খাসবাটি এলাকায় আশি বছর বয়সী এক অসুস্থ বৃদ্ধা নাতির হাত ধরে দীর্ঘক্ষণ রাস্তায় দাঁড়িয়ে থেকে পদযাত্রীদের দিকে হাত নাড়িয়ে তাদের লড়াইয়ের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করেন।
শ্যামনগরে প্রাক্তন এসএফআই নেত্রী কানন সাহা ও এলাকার যুবক আবীরন দাস পাঁচ হাজার করে দশহাজার টাকা ব্রিগেড সমাবেশের জন্য মীনাক্ষী মুখার্জির হাতে তুলে দেন।
ইনসাফ যাত্রায় হাঁটছেন নৈহাটি জুট মিলের শ্রমিক মহম্মদ সামসুদ্দিন। কাঁধে ঝান্ডা নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তিনি বলেন, ‘‘বারো বছর চটকলে কাজ করছি। এখনও নাম নম্বর হয়নি। মিলের মালিক আমাদের স্থায়ী করে না। বোনাস দেয় না। লকডাউনের পয়সা পাইনি। কাজ কর, পয়সা নাও বাড়ি যাও এই নীতিতে মালিক মিলগুলো চালাচ্ছে। মিলে স্থায়ী শ্রমিক কমে গেছে। ভাগা, ভাউচার, জিরো নম্বর- বিভিন্ন ছদ্মনামে শ্রমিকরা কাজ করে। কাজের বোঝা বাড়াচ্ছে। মিলে কোনো অন্যায়ের প্রতিবাদ করা যায় না। প্রতিবাদ করলেই মালিক মিল থেকে গেট বাইরে করে দেয়। আমরা এর ইনসাফ চাইতেই এই পদযাত্রায় হাঁটছি।’’
একশো বছরের পুরনো বারাকপুর শিল্পাঞ্চল। গত বারো বছরে এই শিল্পাঞ্চলে বন্ধ হয়েছে একের পর এক শিল্প কলকারখানা। নতুন শিল্প হয়নি। টায়ার কর্পোরেশন কারখানার সমস্ত মেশিন ও শেড ছিটেফোঁটাও নেই। রামস্বরুপ কারখানা বন্ধ। এন পি টি, নিক্কো কেবিল থেকে শুরু করে এই শিল্পাঞ্চলে অসংখ্য কারখানা তৃণমূলের আমলে বন্ধ হয়ে
ইনসাফ যাত্রায় হাঁটছেন পঁয়ষট্টি বছরের বৃদ্ধ রহমত আলী। হুকুম চাঁদ জুট মিলের শ্রমিক ছিলেন। এখন অবসর নিয়েছেন। হাজিনগরে থাকেন। কয়েক বছর আগে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ হয়। তিনি বলেন, ‘‘চোখের সামনে ঘর, দোকান পুড়তে দেখেছি। এখানে আমার জন্ম। আমি এই অবস্থা কোনোদিন দেখিনি। বামফ্রন্টের সময়ে আমরা মিলেমিশে এখানে থাকতাম। তৃণমূল আসার পর এই বিভাজন চলছে।’’
ইনসাফ যাত্রায় স্লোগান উঠেছে চটকলে অবিলম্বে ত্রিপাক্ষিক চুক্তির মীমাংসার করতে হবে। স্লোগান উঠেছে কাঁচড়াপাড়ায় রেলের কোচ ফ্যাক্টরি হয়নি কেন মোদী মমতা জবাব দাও। স্লোগান উঠেছে বিভাজনের শক্তিকে পরাস্ত করতে হবে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা করতে হবে।
বারাকপুর স্টেশনের সামনে বিশাল এক সমাবেশে মীনাক্ষী মুখার্জি বলেন, ‘‘এই রাজ্যে যুবকদের কাজ নেই। কাজের খোঁজে অন্য রাজ্যে চলে চুরি ও দুর্নীতি এই রাজ্যে ভয়াবহ আকার নিয়েছে। বিভাজনের রাজনীতি করছে তৃণমূল ও বিজেপি। এই দুই শক্তির বিরুদ্ধে যুবদের ঐক্যবদ্ধভাবে রাস্তায় নেমে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।’’
বক্তব্য রাখেন যুব নেতৃবৃন্দ। এদিন ত্রিশ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে ইনসাফ যাত্রা বারাকপুর শহরে এসে শেষ হয়।
Comments :0