One nation one election

‘এক-দেশ, এক-ভোট’খতিয়ে দেখতে কমিটি কেন্দ্রের

জাতীয়

 সামনের বছরের গোড়ার দিকেই লোকসভা নির্বাচন হওয়ার কথা। তার ঠিক আগে ঝুলি থেকে ‘এক-দেশ, এক-ভোট’ প্রস্তাব বের করে বাজারে নামলো বিজেপি-আরএসএস। জানা গিয়েছে, সারা দেশে একসঙ্গে লোকসভা ও সব বিধানসভার ভোট করাতে মরিয়া হয়ে উঠেছে কেন্দ্রের মোদী সরকার। এই ব্যবস্থা  বাস্তবায়নের সম্ভাব্যতা খতিয়ে দেখতে ইতিমধ্যে একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটিও গড়ে ফেলেছে কেন্দ্র। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দকে এই কমিটির মাথায় রাখা হয়েছে। বলা হচ্ছে, বিশেষজ্ঞ এবং রাজনৈতিক দলগুলির নেতাদের সঙ্গে কথা বলেই নাকি এব্যাপারে সুপারিশ চূড়ান্ত করবেন কোবিন্দ। 
সরকারিভাবে কোনও কিছু জানানো না হলেও শুক্রবার কেন্দ্রের ‘সূত্র’ মারফত খবরটি ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বিজেপি-আরএসএস’র পরিকল্পনা মতো এই প্রস্তাব ঘিরে যথারীতি দেশজুড়ে হইচইও শুরু হয়ে গিয়েছে। এর মধ্যেই এদিন সকালে বিজেপি সভাপতি জেপি নাড্ডা নয়াদিল্লিতে রামনাথ কোবিন্দের বাড়িতে গিয়ে তাঁকে সব ‘‘বুঝিয়ে দিয়ে এসেছেন’’ বলে খবর। একদিকে আচমকা সংসদের বিশেষ অধিবেশনের আয়োজন, অন্যদিকে সঙ্ঘ পরিবারের কর্মসূচি রূপায়ণে গোপন তোড়জোড়— সব মিলিয়ে যথেষ্ট চাঞ্চল্য তৈরি হয়েছে রাজধানীর রাজনৈতিক মহলে। 
পর্যবেক্ষকদের একাংশের স্পষ্ট বক্তব্য, পেট্রোল-ডিজেল-গ্যাস-খাদ্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, বেনজির বেকারত্বের মতো জ্বলন্ত সমস্যাগুলি থেকে মানুষের নজর ঘোরাতেই এই পুরানো প্রস্তাব আচমকা নতুন করে ছড়িয়ে দেওয়া হলো। জীবন-জীবিকার দৈনন্দিন সঙ্কটে জর্জরিত দেশবাসীর প্রশ্নের জবাব দেওয়া কঠিন হবে আঁচ করেই এই কৌশল নিয়েছে শাসকদল। দেশে নির্বাচনী ব্যবস্থা আমূল বদলে দেওয়ার মতো এত বড়ো একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে যেভাবে হঠাৎ ধোঁয়াশা তৈরি করা হলো, তার পেছনে ‘চমকপ্রিয়’ প্রধানমন্ত্রীর নির্দিষ্ট রাজনৈতিক ছকও রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
‘ওয়ান-নেশন, ওয়ান-ইলেকশন’ অর্থাৎ ‘এক-দেশ, এক-ভোট’ প্রস্তাব অনুযায়ী লোকসভা এবং রাজ্য বিধানসভাগুলির নির্বাচন একইসঙ্গে করতে চাওয়া হচ্ছে। পরবর্তী সময়ে স্থানীয় স্বশাসিত সংস্থাগুলির নির্বাচনকেও এই ব্যবস্থার আওতায় আনার পরিকল্পনা রয়েছে কেন্দ্রের। কেন্দ্রীয় সরকার তথা শাসকদলের বক্তব্য, এই নীতি বাস্তবায়িত হলে দেশে বিপুল আর্থিক অপচয় কমবে। পাশাপাশি, নির্বাচনী আচরণবিধির কারণে উন্নয়ন প্রকল্প বারবার থমকে থাকার সমস্যাও কমবে এতে। তবে ভারতের মতো একটি জোরদার যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর দেশে, রাজ্যগুলির বৈচিত্র্যময় পরিস্থিতির মধ্যে একই সময়ে একসঙ্গে ভোট করানো সম্ভব বা উচিত কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে সর্বত্র। তাছাড়া প্রশ্ন রয়েছে, লোকসভা বা কোন বিধানসভার মধ্যবর্তী নির্বাচনের প্রয়োজন হলে, সেক্ষেত্রে কি হবে? এসব হাজারো প্রশ্নের জবাব না মেলায় এর আগেও বারবার এই প্রস্তাব শেষপর্যন্ত ঠান্ডাঘরে চলে গিয়েছে।
তাৎপর্যপূর্ণভাবে মাত্র গতকালই এক দফা রহস্য তৈরি করে সংসদের বিশেষ অধিবেশন ডাকার কথা ঘোষণা করেছে সরকারপক্ষ। কেন্দ্রের সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী প্রহ্লাদ যোশী জানিয়েছেন, আগামী ১৮ থেকে ২২ সেপ্টেম্বর সংসদের বিশেষ অধিবেশন বসবে। আগামী নভেম্বরে নির্ধারিত শীতকালীন অধিবেশনের আগে আচমকা এভাবে পাঁচদিনের বিশেষ অধিবেশন ডাকা নিয়ে জল্পনা ছড়িয়েছে দেশজুড়ে। বিশেষ অধিবেশনের আলোচ্যসূচি সরকার গোপন রাখলেও কোন কোন মহলের ধারণা, প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি কোবিন্দের নেতৃত্বাধীন ‘লোক-দেখানো’ কমিটির সুপারিশ এবারেই তড়িঘড়ি সংসদে পেশ করানো হতে পারে। তারপরেই সংসদীয় রীতিনীতি নস্যাৎ করে বিরোধীদের বক্তব্য রাখার সুযোগ না দিয়েই বিশেষ অধিবেশনে ‘এক-দেশ, এক-ভোট’ সংক্রান্ত নয়া বিল পেশ এবং পাশ করিয়ে নেওয়া হতে পারে। মনে করা হচ্ছে, একই কায়দায় এই অধিবেশনে বিতর্কিত অভিন্ন দেওয়ানি বিধিও উতরে নেওয়ার চেষ্টা হতে পারে। আবার বিশ্লেষকদের একাংশের বক্তব্য, সঙ্ঘ পরিবারের কর্মসূচিগুলি পাশ করিয়ে নেওয়ার পরে এবারের বিশেষ অধিবেশনের শেষলগ্নে বর্তমান লোকসভা ভেঙে দিয়ে সাধারণ নির্বাচন এগিয়ে আনার মতো চমকপ্রদ ঘোষণাও হয়ে যেতে পারে। 
তবে সাংবিধানিক নিয়ম অনুযায়ী, চলতি নির্বাচনী ব্যবস্থার বদলে ‘এক-দেশ, এক-ভোট’ চালু করতে গেলে আগে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। এজন্য সংসদের উভয় কক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থন প্রয়োজন। দরকার হবে দেশের অন্তত অর্ধেক সংখ্যক রাজ্য বিধানসভার সমর্থনও। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, লোকসভা এবং বিধানসভাগুলির ক্ষেত্রে বিশেষ অসুবিধা না হলেও এব্যাপারে রাজ্যসভায় বড় বাধার সামনে পড়তে হতে পারে সরকারপক্ষকে।
এই অবস্থায় মোদী সরকারের পরিকল্পনা নিয়ে যথেষ্ট ধন্দ তৈরি হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, ঠিক কি করতে চায় তারা? সামনের নভেম্বর-ডিসেম্বরে পাঁচটি রাজ্য— মিজোরাম, মধ্য প্রদেশ, ছত্তিশগড়, তেলেঙ্গানা এবং রাজস্থানে বিধানসভার ভোট হওয়ার কথা। তারপরেই আগামী মে-জুনে লোকসভা ভোট। সেসময়ে একসঙ্গেই অন্ধ্র প্রদেশ, ওডিশা, সিকিম এবং অরুণাচল প্রদেশে বিধানসভা নির্বাচন নির্ধারিত রয়েছে। লোকসভা নির্বাচনের পরেই রয়েছে মহারাষ্ট্র এবং হরিয়ানা বিধানসভার ভোট। অনেকেরই ধারণা, লোকসভা ভোট এগিয়ে এনে আগে-পরে নির্ধারিত বিধানসভাগুলির নির্বাচনও এবারে একসঙ্গে করিয়ে নিতে পারে মোদী সরকার।
‘এক-দেশ, এক-ভোট’ ব্যবস্থা এদেশে অবশ্য নতুন নয়। ১৭৬৭ সালের আগে ভারতে এই ব্যবস্থাই চালু ছিলো। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তার সঙ্গে সাযূজ্য রেখে পরবর্তীকালে রাজ্যগুলির বিশেষ পরিস্থিতি ও সুবিধা মাফিক সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে থাকে। ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে ‘এক-দেশ, এক-ভোট’ নিয়ে একাধিকবার সওয়াল করেন নরেন্দ্র মোদী। ২০১৭ সালে রাষ্ট্রপতি পদে বসার পরে রামনাথ কোবিন্দও এই ব্যবস্থা চালুর পক্ষে মতামত জানিয়েছিলেন। তবে মোদীর আগেও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী এবং তাঁর উপপ্রধানমন্ত্রী এলকে আদবানিকেও ‘এক-দেশ, এক-ভোট’ নিয়ে সরব হতে দেখা গিয়েছিল। তবে সেসময় সংসদে তাঁদের এখনকার মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল না। ২০১৯ সালে বর্ধিত আসন নিয়ে কেন্দ্রে দ্বিতীয়বার সরকার গড়ার পরেই এব্যাপারে সর্বদলীয় বৈঠক ডেকেছিলেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। কিন্তু সেখানে এই ব্যবস্থাকে ‘‘অগণতান্ত্রিক এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর বিরোধী’’ আখ্যা দিয়ে সরকারি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন বিরোধী নেতারা।
এবারেও ‘এক-দেশ, এক-ভোট’ প্রস্তাব সরাসরি নাকচ করেছেন বিরোধী দলগুলির নেতারা। মুম্বাইয়ে বিরোধী মঞ্চ ‘ইন্ডিয়া’র তৃতীয় বৈঠকে যোগ দিয়েছেন ২৮ টি রাজনৈতিক দলের প্রায় ৬৩ জন প্রতিনিধি। শুক্রবার তাঁরা অনেকেই স্পষ্ট বলেছেন, প্রস্তাবিত ব্যবস্থা এদেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর সামনে বিপদ তৈরি করবে। আসলে আসন্ন লোকসভা ভোটে বিরোধী মঞ্চ ‘ইন্ডিয়া’র চ্যালেঞ্জের সামনে বিপন্ন বোধ করেই এসব পদক্ষেপ করছে মোদী সরকার।
কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে এদিন টুইটারে বলেন, ‘‘নজর ঘোরাতে এবং বিভ্রান্ত করতে সরকার ফের এই প্রস্তাব সামনে এনেছে। তবে এবারে শাসকের কোন কৌশলেই প্রতারিত হবেন না এদেশের নাগরিকরা।’’ তাঁর সাফ কথা, ‘‘স্বৈরাচারী সরকারের পতনের কাউন্টডাউন শুরু হয়ে গিয়েছে। ১৪০ কোটি ভারতীয় পরিবর্তনের জন্য তৈরি।’’
সিপিআই’র সাধারণ সম্পাদক ডি রাজা বলেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রী মোদী মুখে সবসময় গণতন্ত্রের বাণী শোনান। কিন্তু কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই এব্যাপারে একতরফা পদক্ষেপ করছে সরকার।’’ শিব সেনা (ইউবিটি) নেতা সঞ্জয় রাউতের মন্তব্য, ‘‘দেশ তো ‘এক’ই আছে। আমরা সুষ্ঠু নির্বাচন দাবি করছি। ন্যায্য দাবি থেকে মানুষের নজর ঘোরানোর পথ খুঁজছেন বিজেপি নেতারা।’’
আম আদমি পার্টির প্রিয়াঙ্কা কক্করের কটাক্ষ, ‘‘বিরোধীদের ‘ইন্ডিয়া’ ওদের ভয় ধরিয়েছে। প্রথমে রান্নার গ্যাসের দাম ২০০ টাকা কমাতে বাধ্য হলো। বিজেপি এতটাই ভয় পেয়েছে যে, এখনই সংবিধান সংশোধন করিয়ে নিতে চাইছে! কারণ ওরা বুঝেছে যে ভোটে আর জিততে পারবে না।’’  ডিএমকে মুখপাত্র সারাভানন আন্নাদুরাই বলেছেন, ‘‘এই প্রস্তাব দেশবিরোধী, যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা বিরোধী।’
 

Comments :0

Login to leave a comment