রাজ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচনের শুাধুমাত্র মনোনয়নপত্র দাখিল পর্বেই সন্ত্রাস-হিংসার যে নমুনা দেখা গিয়েছে তাতে নির্বাচন প্রক্রিয়া শেষ হওয়া পর্যন্ত যে কত রক্ত ঝরবে, কত মায়ের কোল খালি হবে সহজেই অনুমেয়। গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে সন্ত্রাসের মধ্যযুগীয় অবস্থাকে হার মানালেও এবং তাকে ঘিরে নিন্দা-সমালোচনা গোটা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়লেও কোনও শিক্ষা হয়নি রাজ্য সরকার ও রাজ্য নির্বাচন কমিশনের। শাসক দলের সীমাহীন সন্ত্রাস, অভাবনীয় অস্ত্রের ব্যবহার, ভীতি প্রদর্শনের নজিরবিহীন ঘটনায় প্রায় দুই পঞ্চমাংশ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছে শাসক দল। ভোটের পর একই কায়দায় ভয় দেখিয়ে, হুমকি দিয়ে মোটা টাকার প্রলোভন দেখিয়ে জয়ী বিরোধী প্রার্থীদের ভাঙিয়ে বেশিরভাগ পঞ্চায়েতকে আক্ষরিক অর্থেই বিরোধী শূন্য করা হয়। চুরি, লুঠতরাজের অদম্য বাসনাই যে তৃণমূলকে এই রাস্তায় চালিত করে তা পদে পদে প্রমাণিত হয়েছে গত পাঁচ বছরে।
সেই তৃণমূলের চরিত্র যে বদলাবে না সেটাই স্বাভাবিক।
মনোনয়ন দাখিল পর্বে সেটা স্পষ্ট হয়ে গেছে। ইতিমধ্যে ঘটে গেছে ছয়-সাতটি মৃত্যুর ঘটনা। তারপরও নির্লজ্জের মতো সাফাই গাইছেন মুখ্যমন্ত্রী। যেন ব্যাপারটা কিছুই নয়। আর নির্বাচন কমিশন, সে তো কিছুই জানে না। মনোনয়ন দাখিল পর্বে যে কত মানুষের মৃত্যু হয়েছে সে খবরই নাকি কমিশনে এসে পৌঁছায়নি। আহত, গ্রেপ্তারের খবর দিলেও পুলিশ নাকি কমিশনকে কোনও মৃত্যুর খবর দেয়নি। বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান সঙ্গতভাবেই মন্তব্য করেছেন কমিশন চোখে ঠুলি পরে আর কানে তুলো গুঁজে দিবানিদ্রা যাচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে না পুলিশ কমিশনকে চালাচ্ছে না কমিশন পুলিশকে চালাচ্ছে। আইন অনুযায়ী নির্বাচন পর্বে কমিশনের অধীনেই কাজ করবে পুলিশ ও প্রশাসন। এখনো পর্যন্ত যা ঘটেছে তাতে পরিষ্কার কমিশন ঠুঁটো জগন্নাথ ছাড়া আর কিছুই নয়। তাদের কাজ শুধু বিজ্ঞপ্তি জারি করা। বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী ঠিকঠাক কাজ হচ্ছে কিনা তাদের দেখার দায় নেই। সেটা পুলিশ ও প্রশাসন শাসক দলের নির্দেশ মতো পালন করবে।
পদে বসেই কমিশনার কর্ম তৎপরতা দেখিয়েছেন ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নির্বাচন ঘোষণা করে। ব্যস, ঐ পর্যন্তই। তারপর বাকিটা অর্পিত হয়েছে শাসক দল ও সরকারের উপর। গোটা মনোনয়ন পর্বে কমিশনের কোথাও কোনও ভূমিকা ছিল বলে মনে হয়নি। যা কিছু ঘটেছে শাসক দলের মরজি মতো। কমিশন মনোনয়ন কেন্দ্রের চারদিকে ১৪৪ ধারা জারি করেছে। কিন্তু প্রশাসন ও পুলিশ ১৪৪ ধারার ভেতরে তৃণমূল দুষ্কৃতীদের সশস্ত্র জমায়েতের বন্দোবস্ত করে দিয়েছে আর বিরোধীদের আটকে দিয়েছে বাইরে। অর্থাৎ বিরোধীরা যাতে মনোনয়ন জমা করতে না পারে তার সুনিপুণ ব্যবস্থা। মনোনয়ন জমায় বিরোধীদের সমস্তরকম সহযোগিতার নির্দেশ পুলিশের উপর থাকলে তা পুলিশ পালন করেনি। তারা সদা তৎপর ছিল শাসক দলকে নিরাপত্তা দেবার কাজে।
এমনই এক অনুপ্রাণিত আমলা কমিশনারের দায়িত্ব পেয়েছেন যিনি নির্বাচন প্রক্রিয়ার অনেকটা কেটে গেলেও এখনো স্পর্শকাতর এলাকা বা বুথ চিহ্নিত করে উঠতে পারেননি। অথচ সর্বত্র প্রায় সন্ত্রাসের আগুন জ্বলছে। রক্ত ঝরছে। মৃত্যুর মিছিল শুরু হয়েছে। রাজ্যবাসী উদ্বিগ্ন, উচ্চ আদালত উদ্বিগ্ন, বিরোধীরা আতঙ্কিত শুধু তাপ উত্তাপ নেই কমিশনের। তাই উচ্চ আদালতকে বাধ্য হয়ে সব জেলায় কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করে ভোট করার নির্দেশ দিতে হলো। বাস্তবে রাজীব সিনহা নামে একজন কমিশনার আছেন বটে তবে তিনি নিছকই কাঠের পুতুল মাত্র। তাঁকে দাঁড় করিয়ে পেছনের দরজা দিয়ে কমিশন চালাচ্ছে শাসক দলের হয়ে প্রশাসন ও পুলিশ। এই অবস্থায় শান্তিপূর্ণ অবাধ নির্বাচন সোনার পাথরবাটি ছাড়া আর কিছুই নয়।
সঙ্ঘবদ্ধ জনগণ অনেক ঝুঁকি নিয়ে বিরোধীদের বিশেষ করে বামপন্থীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। দল বেঁধে গিয়েছেন বাম প্রার্থীদের মনোনয়ন জমায় তৃণমূলী বাধা প্রতিরোধ করতে। অনেক জায়গায় সফল হলেও সব জায়গায় পারেননি। শাসক সশস্ত্র গুন্ডাদের হানায় তাদের অনেকে জখম হয়েছেন, বিনা অপরাধে গ্রেপ্তার হয়েছেন, এমন কি প্রাণও দিতে হয়েছে। পাঁচদিন ধরে হাজার চেষ্টা করেও বিরোধীরা নাকাল হয়েছেন মনোনয়ন জমা দিতে সেখানে শাসক দল কার্যত একদিন ক্ষণিকের মধ্যে সব মনোনয়ন জমা দিয়েছে। পেছনের দরজা দিয়ে শাসকের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা না থাকলে এটা সম্ভব নয়।
Comments :0