Panchayat vote 2023

গণনার আগেই বহু ভোটের বাক্স বদলে ফেলা হয়েছে, প্রমাণ স্পষ্ট

রাজ্য

বাতিল ব্যালটের শতকরা ৭৫ ভাগ তৃণমূলকে দিয়ে বাকি ২৫ ভাগ বিরোধীদের মধ্যে ভাগ করে নিতে বলেছেন বিডিও। পূর্ব মেদিনীপুর জেলার নন্দকুমার ব্লকের বিডিও শানু বক্সি এই কথা বলেন পঞ্চায়েতের প্রার্থী ও এজেন্টদের। তিনি এই তত্ত্বের আমদানি করছেন একেবারে গণনার টেবিলেই। 
এমনই জানাচ্ছেন সিপিআই(এম) সহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির প্রার্থী থেকে কাউন্টিং এজেন্টরা। নির্বাচনের মতো গণনাকেও রীতিমতো প্রহসনে পরিণত করা হয়েছে। সকাল সাতটা থেকে কাউন্টিং এজেন্টরা গণনা কেন্দ্রে ঢুকে তাঁদের নিজেদের বুথের গণনা করতে করতেই রাত দশটা পর্যন্ত অপেক্ষা করেছেন। কিন্তু গণনার টেবিলে গিয়ে রীতিমতো হতবাক হয়েছেন কাউন্টিং এজেন্টরা। তার কারণ, যা ভোট পড়েছে, তা ১৮ নম্বর ফর্মে প্রিসাইডিং অফিসার উল্লেখ করেছেন। অথচ গণনা করতে গিয়ে দেখা গিয়েছে, ব্যালট বাক্সে বেশি ব্যালট। আবার সিল করা ব্যালট বাক্সের কোনও তোয়াক্কাই করেননি আধিকারিকরা। সিল না থাকা অবস্থাতেই জোর করে গণনা করা হয়েছে। 
প্রতিটি ঘটনা বোঝাচ্ছে, জালিয়াতির গণনা হয়েছে।
আরও ভয়ঙ্কর ঘটনা আছে। নন্দকুমার ব্লকের ব্যাবর্তাহাট পশ্চিম গ্রাম পঞ্চায়েতে সাতটি বুথ। এই গ্রাম পঞ্চায়েতের ১ থেকে ৭ নম্বর পোলিং স্টেশনের ভোট গণনা হয়েছিল শ্রীকৃষ্ণপুর হাইস্কুলের ১০ নম্বর রুমে। এখানে ৭৫ থেকে ৮১ নম্বর টেবিলে সিপিআই(এম) প্রার্থী এবং তাঁর কাউন্টিং এজেন্টরা উপস্থিত ছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই উপস্থিত ছিলেন তৃণমূল এবং বিজেপি’র কাউন্টিং এজেন্টরাও। গণনার সময়ে দেখা যায়, পোলিং স্টেশনে যে নম্বরের ব্যালট বাক্স ছিল, কাউন্টিং টেবিলে তার বদ‍‌লে অন্য নম্বরের ব্যালট বাক্স এসে পৌঁছেছে। ব্যালট বাক্সগুলিতে ঠিকানা লেখা কাগজে প্রিসাইডিং অফিসার ও পোলিং এজেন্টদের কোনও সই ছিল না। অথচ নির্বাচনের দিন পোলিং স্টেশনে ব্যালট বাক্সগুলি তার ও দড়ি দিয়ে বেঁধে অ্যাড্রেস ট্যাগ ও ব্রাউন কাগজ লাগিয়ে সিল করা হয়েছিল। কিন্তু কাউন্টিং টেবিলে যে বাক্সগুলি দেওয়া হয়েছিল, তাতে কোনও কিছুই ছিল না। কাউন্টিং এজেন্টদের অভিযোগে বাধ্য হয়ে বিডিও পোলিং স্টেশনে যে সিসি ক্যামেরা ব্যবহার হয়েছিল, তা দেখান। তাতে দেখা যায়, পোলিং স্টেশনে যে ব্যালট বাক্সগুলি ব্যবহার করা হয়েছিল, তাতে প্রিসাইডিং অফিসার ও পোলিং এজেন্টদের সই ছিল। এবারের নির্বাচনে ব্যালট বাক্সকে কাপড় দিয়ে বেঁধে সিল করার কোনও ব্যবস্থাই ছিল না কমিশনের তরফে। তার বদলে ব্যালট বাক্সগুলি পলিথিন দিয়ে মুড়ে মাথায় দড়ি বেঁধে সিল করা ছিল। কাউন্টিং টেবিলে আসা ব্যালট বাক্সগুলিতে সেই পলিথিনও ছিল না।
অর্থাৎ বুথ থেকে যে বাক্স ডিসিআরসি-তে গিয়েছিল, তা স্ট্রং রুমে যায়নি। অথবা স্ট্রং রুমেই তা বদলানো হয়েছে। তাৎপর্যপূর্ণ হলো, ডিসিআরসি থেকে স্ট্রং রুমে বাক্স পৌঁছানোর সময়ে কোনও বিরোধী দলের এজেন্টকে থাকতে দেওয়া হয়নি। 
এবার ইডি ভোটকে বাতিল করানো হয়েছে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, দু’নম্বর নাঁড়াদাড়ি লক্ষীনারায়ণ পার্ট বেসিক স্কুলে আটটি ইডি ভোট খোলা হয়। তার মধ্যে দু’টি ভোট তৃণমূলের পক্ষে যায়, বাকি ছ’টি ভোট বাতিল হয়েছে। দেখা যায়, বাতিল ব্যালটে সিপিআই(এম) ও বিজেপি’র প্রতীকে ছাপ দেওয়া রয়েছে। পরিকল্পনা মতোই সিপিআই(এম) সহ বিরোধীদের ব্যালটগুলি ইচ্ছাকৃতভাবে বাতিল করার জন্য দু’বার ছাপ মারা হয়েছে। এজেন্টদের প্রতিবাদে এই ভোট বাক্সগুলির গণনা বন্ধ থাকে। রিটার্নিং অফিসার তথা বিডিও গণনা টেবিলগুলিতে এসে সমস্ত এজেন্ট এবং কাউন্টিং অফিসারের উদ্দেশে বলেন, ‘‘এই বাক্সগুলি খোলা হোক। গণনা হোক এবং গণনার সময়ে বাতিল ব্যালট পেপারগুলির ৭৫ ভাগ তৃণমূলের পক্ষে এবং ২৫ ভাগ অন্যান্য প্রার্থীর পক্ষে গণনা করুন।’’ এই প্রস্তাবে সিপিআই(এম) প্রার্থী ও এজেন্ট যাঁরা উপস্থিত ছিলেন, তাঁরা তীব্র প্রতিবাদ করেন। বিডিও তখন কাউন্টিং টেবিলের কাছ থেকে ফিরে যান। কিছু সময় পরে এসেই তিনি আবার ওই রুমে কাউন্টিং টেবিল গলির কাছে এসে বলেন, ‘‘এই ব্যালট বাক্সগুলি এখন গণনা করা হবে না। এখন পঞ্চায়েত সমিতি ও জেলা পরিষদের গণনা হবে। তাই আপনারা সবাই এখন চলে যান। আপনাদের ডেকে সিদ্ধান্ত নিয়ে তারপরেই এই বাক্সগুলির গণনা করা হবে।’’ এই ঘোষণার পর সমস্ত এজেন্ট ওই গণনা কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসেন। কিন্তু দেখা যায়, গভীর রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করার পরও কোনও সিপিআই(এম) এজেন্টকে ডাকা হয়নি। বরং গভীর রাতে কাউকে কিছু না জানিয়েই কাউন্টিং অফিসারদের চাপ দিয়ে ওই বাক্সগুলির গণনা করে ফলাফল ঘোষণা করা হয়। এই ব্লকের অন্যান্য গ্রাম পঞ্চায়েতের বিভিন্ন আসনে ১৫০ থেকে ৩০০টি পর্যন্ত ব্যালট পেপার বাতিল করা হয়েছে, যেগুলিতে সিপিআই(এম) ও বিজেপি’র প্রতীকে ছাপ লাগানো ছিল। কোনও কোনও বুথে ১৮ নম্বর ফর্মে লিখিত যা ভোট পড়েছে, তার থেকে বেশি ব্যালট পেপার পাওয়া গিয়েছে। সেগুলিও গণনা করে ফলাফল ঘোষণা করে দেওয়া হয়েছে। কোনও কোনও বুথে ব্যালট বাক্সে অন্য বুথের ব্যালটপত্র পাওয়া গিয়েছে। কাউন্টিং এজেন্টদের তীব্র প্রতিবাদ ও বিরোধিতা সত্ত্বেও সেই বুথগুলিরও গণনা সম্পন্ন করা হয়েছে। নন্দকুমার ব্লকের পঞ্চায়েত সমিতি ও জেলা পরিষদের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। বিডিও'র প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদতে রিসিভিং সেন্টারে সমস্ত ব্যালট পেপারকে একটি ঘরে নিয়ে গিয়ে তৃণমূলের লোকজনদের দিয়ে এই ঘটনা ঘটানো হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ডিসিআরসি-তে ভোটের দিন থেকে কাউন্টিং পর্যন্ত কোনও সিসি ক্যামেরা চালু ছিল না। আর ডিসিআরসি থেকে ব্যালট বাক্সগুলিকে স্ট্রং রুমে নিয়ে যাওয়ার সময়ে কোনও রকম ভিডিওগ্রাফি করা হয়নি বলেও জানা গিয়েছে। এই ঘটনা সম্পর্কে জানতে চেয়ে নন্দকুমারের বিডিও শানু বক্সীকে কয়েকবার ফোন করা হয়। কিন্তু তাঁর ফোন বেজে গিয়েছে। কোনও উত্তর পাওয়া যায়নি।

 

Comments :0

Login to leave a comment