COAL MINE PRIVATISATION

খাদান রক্ষার লড়াইয়ে রাস্তা দেখাচ্ছে চিনাকুড়ি

রাজ্য

ছবি: প্রতীকী

দেবদাস ভট্টাচার্য: সোদপুর (কুলটি) 
 

 শ্রমিক শ্রেণির বেসরকারিকরণ-বিরোধী লড়াইয়ের উজ্জ্বল ভূমি ইসিএল’র চিনাকুড়ি-৩ নম্বর কোলিয়ারি। বলা যেতে পারে সমগ্র রানিগঞ্জ কয়লাঞ্চলকে মুখোমুখি প্রতিরোধ গড়ে তুলে লড়াই করার সাহস জোগাচ্ছে চিনাকুড়ি তথা সমগ্র সোদপুর এরিয়া। বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে শ্রমিক শ্রেণির জোটবদ্ধ লড়াইয়ের পাশে শামিল হয়েছেন এলাকার সর্বস্তরের মানুষ। 
প্রায় দু’সপ্তাহ আগে, গত ২৭ সেপ্টেম্বর রাধানগর রোড দিয়ে পরপর পাঁচ গাড়ি বোঝাই কেন্দ্রীয় শিল্প নিরাপত্তা বাহিনী (সিআইএসএফ) নিয়ে বেসরকারি মালিক এসেছিলেন চিনাকুড়ি ৩ নম্বর কোলিয়ারির দখল নিতে। সঙ্গে সোদপুর এরিয়া জিএম ছিলেন। এলাকার মানুষকে সঙ্গে নিয়ে শ্রমিক শ্রেণির লড়াই সেদিন নয়া উদাহরণ করেছিল। বিজেপি সরকারের ব্যবস্থাপনায় একতরফাভাবে কর্তৃপক্ষ বেসরকারি হাতে চালু খনি তুলে দেবার চুক্তি বা মউ স্বাক্ষরিত করেছে। এরপরই এলাকায় গড়ে উঠেছে সোদপুর এরিয়া বাঁচাও কমিটি। সিআইএসএফ’র গাড়ির সঙ্গে অনেকগুলি গাড়িকে খনির দিকে যেতে দেখে দলে দলে মানুষ চিনাকুড়ি ৩ নম্বর খনির গেট ঘিরে ধরেন। গায়ের জোর দেখিয়েও সেদিন সিআইএসএফ সুবিধা করতে পারনি। বেসরকারি মালিককে ফিরে যেতে হয়। নিষ্ফল আক্রোশে সোদপুরের জিএম লড়াকু শ্রমিকদের বলেছিলেন, ‘তুমহারা বাপকো লে আও। খাদান মে প্রাইভেট পার্টি ঘুসেগা। তুমলোগ কুয়া কামেঢক হো।’ 
মঙ্গলবার সেই জিএম দপ্তর ঘিরে শ্রমিকরা বেসরকারিকরণ বিরোধী বিক্ষোভে সোচ্চার হয়ে জিএম-কে বললেন, ‘জিএম সাহেব তুমহারা বাপকো লে আও। হামলোগোঁ কো হিয়াঁ সে উঠা কে দেখা দো। হাম জান দেংগে, লেকিন মালিক কা হাত মে খাদান নেহি দেংগে।’ এদিন শ্রমিকরা চিনাকুড়ি ৩নম্বর খনি থেকে দল বেঁধে মিছিল করে এসেছিলেন সোদপুর জিএম দপ্তরে। এলাকার সাধারণ মানুষও শামিল ছিলেন বিক্ষোভে। বিক্ষোভ সভায় বক্তব্য রাখেন সিআইটিইউ অনুমোদিত ভারতের কোলিয়ারি মজদুর সভা (সিএমএসআই) সাধারণ সম্পাদক বংশগোপাল চৌধুরি, সুজিত ভট্টাচার্য, আইএনটিইউসি নেতা প্রজয় মসি, চণ্ডী ব্যানার্জি, বিএমএস নেতা রামলখন মাহাতো, এআইটিইউসি নেতা গুরুদাস চক্রবর্তী, এইচএমএস নেতা প্রফুল্ল চ্যাটার্জি, টিইউসিসি নেতা দিলীপ আচার্য প্রমুখ। সভাপতিত্ব করেন জানকি প্রসাদ। 
সোদপুর এরিয়া বাঁচাও কমিটির ডাকে প্রতিবাদ বিক্ষোভ সভা হয়। শ্রমিক এবং এলাকার মানুষ এসেছিলেন হাতে কোনও ঝান্ডা না নিয়ে। সবার হৃদয়ের রঙে রেঙে উঠেছে এই লড়াই। বিপন্ন মানুষ। বিপন্ন খনি শ্রমিক। আবার কয়লা কুঠির মালিকের জমানায় ফিরিয়ে দিতে চাইছে এই এলাকাকে। দীর্ঘ লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে ব্যক্তি মালিকের কয়লা কুঠির যন্ত্রণা থেকে মানুষ মুক্তি পেয়েছেন কয়লা শিল্প জাতীয়করণ হওয়ায়। 
চিনাকুড়ি-৩ নম্বর খনির গভীরে ম্যান রাইডিং অপারেটারের কাজ করেন পীতাম্বর রাম, ট্রামার নগেন্দ্র হরিজন, পাম্প অপারেটার মহেশ প্রসাদ নুনিয়ারা জিএম দপ্তরের গেট ঘিরে রেখে মুষ্ঠিবদ্ধ হাত ওপরে তুলে সদর্পে স্লোগান দিচ্ছিলেন, মালিকোঁকা দালাল দূর হটো। যো মজদুর সে টকরায়েগা ওহ চুরচুর হো যায়েগা। চালু খাদান মালিক কো দেনা নেহি চলেগা। 
আক্ষরিক অর্থে গত চার মাস ধরে চিনাকুড়ির শ্রমিক তপন কুমার চ্যাটার্জি, পীতাম্বর রামরা খনি ঘিরে লাগাতার শিবির করে পাহারায় বসেছেন। বেসরকারি মালিকের হাতে খনি তুলে দেবার জন্য একতরফা ভাবে মউ স্বাক্ষর করেছে কর্তৃপক্ষ। নগেন্দ্র হরিজনরা টাকা তুলে মাইক সেট কিনেছেন, তাঁবু কিনেছেন। প্লাস্টিকের চেয়ার কিনেছেন। চার মাস ধরে খনিতে লাগাতার বেসরকারিকরণ-বিরোধী বিক্ষোভ জারি রেখেছেন শ্রমিকরা। সচেতন রয়েছেন এলাকার মানুষ। ব্যক্তি মালিক আবার খনির দখল নিতে আসলেই হবে প্রতিরোধের লড়াই। 
এদিন বিক্ষোভ সভা থেকে নেতৃবৃন্দ হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, গায়ের জোরে খনি নিতে এলে হবে লড়াই। এ লড়াই কেবল খনিতে সীমাবদ্ধ থাকবে না। লড়াই হবে রাস্তায়। মানুষ তৈরি আছেন। 
গত ফেব্রুয়ারি মাসে কয়লা মন্ত্রকের আন্ডার সেক্রেটারি দিল্লিতে বৈঠক করে ঘুরপথে কয়লা খনি বেসরকারিকরণে একটা নতুন শব্দ ‘মাইনস ডেভেলপার অপারেটার’ (এমডিও) চালু করেন। সিএমপিডিআইএল’কে দায়িত্ব দেওয়া হয় চালু নেই, পরিত্যক্ত এবং বন্ধ খনির তালিকা তৈরির জন্য। বাস্তবে বন্ধ, চালু নেই এবং পরিত্যক্ত খনি বেসরকারি হাতে তুলে না দিয়ে চালু এবং উৎপাদনশীল খনি বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। কেবল খনি নয়, ভূগর্ভে সঞ্চিত মূল্যবান বিস্তীর্ণ কয়লার স্তর তুলে দেওয়া হচ্ছে মালিকের হাতে। এভাবে একটার নামে একাধিক খনির দখল পাবে মালিকপক্ষ। 
ইসিএল’র সোদপুর এরিয়ার চিনাকুড়ি-৩ নম্বর খনিচালু খনি এবং উৎপাদশীল। ৫৭০ জন শ্রমিক নিয়ে গত দুই বছর ধরে লাভ করছে এই খনি। সোদপুর এরিয়ার খনিগুলির মধ্যে সর্বোচ্চ উৎপাদন হয় এই খনিতে। রেভেনিউ শেয়ার মডেলে বেসরকারি মালিকের হাতে খনি দেওয়া হচ্ছে। ৪ শতাংশ রেভেনিউ শেয়ার লিজ চুক্তিতে। মালিক যেমন খুশি উৎপাদন করবে। যেমন খুশি দামে কয়লা বিক্রি করে মুনাফা লুটবে। সরকারকে দেবে মাত্র ৪ শতাংশ রাজস্ব। চিনাকুড়ি খনির নিচে পরপর ছয়টি কয়লার স্তর রয়েছে। কয়লার স্তরের মালিকানা পাবে বেসরকারি মালিক। চিনাকুড়ির নামে মালিক পেয়েযাচ্ছে সোদপুর এরিয়ার পারবেলিয়া, দুবেশ্বরী কোলিয়ারি কয়লাও।  যেখানে ১৯২ মিলিয়ন টন কয়লার মজুত ভান্ডার রয়েছে। ১৭৬৩ হেক্টার জমির পরিমাণ নিয়ে মালিকের লুটের বিশাল সাম্রাজ্য ছড়াবে চিনাকুড়ি ৩ নম্বর খনিকে কেন্দ্র করে। 
এখানে চালু উৎপাদনশীল খনিগুলিতে ২২০০ শ্রমিক কাজ করছেন। তাদের অন্যত্র স্থানান্তর করা হবে। অতিরিক্তম্যান পাওয়ারের চাপে সেই খনিগুলিও লোকসানের মধ্যে পড়বে। নেতৃবৃন্দ বলেছেন, এই চুক্তি কয়লা খনি জাতীয়করণআইন বিরুদ্ধ। চিনাকুড়িতে সফল হলে ইসিএল’র অন্যান্য খনিতেও হামলে পড়বে বেসরকারি মালিকরা। লিজ ভিত্তিতে মালিকের অবাধ লুটের ক্ষেত্র তৈরি করার অপচেষ্টা রুখতেই হবে। এদিন কর্তৃপক্ষের কাছে ডেপুটেশনও দেওয়া হয়। শ্রমিক এবং এলাকার মানুষ একযোগে জানিয়ে দিলেন যতক্ষণ না মউ চুক্তি বাতিল করা হচ্ছে ততক্ষণ বেসরকারিকরণ-বিরোধী লড়াই জারি থাকবে। 

 

Comments :0

Login to leave a comment