ANAYAKATHA — MUKTADHARA | CHADER BARI — SOURAV DUTTA |14 APRIL 2024

অন্যকথা — মুক্তধারা | চাঁদের বাড়ি — সৌরভ দত্ত | নববর্ষ ১৪৩১ — পয়লা বৈশাখ

সাহিত্যের পাতা

ANAYAKATHA  MUKTADHARA  CHADER BARI  SOURAV DUTTA 14 APRIL 2024

অন্যকথা মুক্তধারা

চাঁদের বাড়ি

সৌরভ  দত্ত

নববর্ষ ১৪৩১ পয়লা বৈশাখ

ক্যালেন্ডারের ডেট ভেঙে ভেঙে,ছিঁড়েখুঁড়ে গেছে কালবেলায়--নির্ভুল রাতের বুড়িচাঁদের প্রাঞ্জল 
কথকতাগুলি।যেগুলি আঁচলের গিঁটে বেঁধে পাশে শুতো দিদা।ল্যাভেণ্ডা চাঁপার সেই প্রস্ফুটিত হাসি নেই আজ আর।ভাঙা দালানের শোকাহত আলোছায়ার জানালা--দিয়ে ঘুমের আশ্রয়ে ঢুকে পড়ে কেউ।কে ঢুকে পড়ে?নিঃসঙ্গ সেই বুলবুলি পাখির বাসায়!জড়তা কাটিয়ে তোলা--চৈত্রের সুস্নিগ্ধ বাতাস কি কোন বন্ধকী ঋণ রেখে যায়  বর্ষশেষের পৃষ্ঠায়?হ্যারিকেনের আলো জ্বেলে পুরিয়া বানাচ্ছে যে স্বপ্নের ব্যাবিলন।আমি তো উঠিনি ভয়ে সেই ভাঙাচোরা সিঁড়ি দিয়ে। পাছে ঠোক্কর খাই।একটা বছর মানে ঘূর্ণন তরঙ্গের নৌকোয় ভাসমান নিরুদ্দেশ্য জীবন।যেখানে থরে থরে ঝরে পড়ে কাঁচা আমের কুশি,প্রমিতাক্ষর।শীতলা মঙ্গলের বৈকালিক বিকেলের আলো ফুরিয়ে যেতে যেতে ফেলে রেখে যায় গভীর দীর্ঘশ্বাস।মোমজন্মের আঠালো সম্পর্কের মিড়গুলো-- স্থানু পৃথিবীর একবিন্দু জল।কবিতার প্রতিরূপময় স্বীকারোক্তিতে--প্রশ্নের ভূমিকা নিরর্থক।ঈশ্বর তাড়িত স্বপ্নদর্শী আকাশের মাঝখানে আমার দিদার মুখ আজো ফুটে ওঠে দুধে আলতা হয়ে।আত্মখননের রামধনু রঙা সান্ধ্যলিপিগুলো পোড়ো বাড়িটার দেওয়ালে মৃত শ্যাওলার ম্যুরালচিত্র।গোলাপ জামের গাছটা আজও আছে--তার নীচে রয়ে গেছে বড়মামার পোষা টিয়াপাখিটার সমাধি।সহস্রাব্দ দূরে বছর চলে যায়; ফিরে আসে পূর্বপুরুষের ঘ্রাণ।গাজনের ঢাক বাজিয়ে চলে মূল সন্ন্যাসীর দল।প্রতিটা ডাবের শিষে একটা অদ্ভুত মায়ার স্পর্শ।গাণনিক বলে যান--'বটি শূন্য,বটি শূন্য,পঞ্চবটী ধাম'...ভোলামন লুটিয়ে পড়ে সেই  চরণ ধূলায়।আসলে কোনো বৈশাখীই প্রেমের স্ট্যাটিসটিকস জানে না।তার চোখে চোখ রাখতে  ভয় হয়। অশ্বখুরে  ধুলো উড়িয়ে কতবার পালিয়ে গেছি সংগোপনে।গল্পের চরিত্ররা লিখে রাখে সেই শোকগাথা,চুম্বনঘোর।পরাজয়ের পরে
রক্তবমি,যাবতীয় মুহ্যমানতা।

আমাদের ছিল এক গভীর স্নেহের  জলাধার ।মাঝমাঝে সন্ধ্যায় চিলেছাদে মাদুর বিছিয়ে বসতাম তার চারপাশে।মাসি লন্ঠনের আলোয় রূপকথা নামিয়ে আনত।নারকেল গাছের পাতায় পাতায় পাক খেত এক উন্মত্ত উইন্ডমিল।অকৃত্রিম আশাবরী রাতের সেই ছেলেবেলাগুলো এখন মস্তকহীন ঝুলন্ত সিঁড়ির মতো পাতালঘরে বন্দি।সেখানে এসে না বসে কোনো কিন্নরী,চিঠিতে লেখে না কেউ নববর্ষের শুভাশিস।ইতিহাস তো এমনই ডানাভাঙা আয়ুরেখা...

কালবৈশাখি ঝড়ে উড়ে যেত বই,পেন,খাতা,ছেঁড়া মাদুর।আমরা দেখতাম ঐ মাদুরে চড়ে আল্লার দোয়া নিয়ে উড়ে যাচ্ছেন কোনো মেহেরবান মুসাফির।পয়লা বৈশাখে রূপোলি তবকে  জড়ানো সন্দেশ আনতেন বাবুমামারা।তার শীর্ষবিন্দু ধরে অপেক্ষার বহুদূর স্তর পর্যন্ত নেমে যেতাম আমারা সব ভাইবোন।কালী ঠাকুরের চোখ আঁকার হাত একটু কেঁপে উঠলেই মেজোমামার সে কি তিরিক্ষি মেজাজ।ছোটমামা তখন আসলেমি করে 'সোভিয়েত দেশ' বুকে জড়িয়ে শুয়ে আছে আদুরে রোদ্দুরস্পর্শী চিলেকোঠায়।ঐ পেঁপেগাছ আর ধূসর চিলেকোঠার ঘ্রাণ পাগল করত আমাকে।চোখের সামনে দুলতো দুটো কাঠের খড়ম।বাগানে খেলে বেড়াত হলুদ,সাদা হরেক প্রজাপতি।সিঁড়িঘরের দেরাজে রাখা নষ্টামির সরঞ্জাম হরপ্পা-মহেনজোদাড়োর প্রত্নভাস্কর্য:একরাশ মৈথুন চিত্র।চুপিসাড়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসত --রবীন্দ্রনাথের জীবনস্মৃতির এক-একটা রক্তিম পৃষ্ঠা।এক দুপুরে মনে পড়ে প্যাঁটরা থেকে বের করে বিশুদাদুর ল্যাঙোট পরে হাতে বাঁখারির তলোয়ার নিয়ে মহারথী সেজেছিলাম।তখন কোনো আয়না ছিল না জীবনের --স্বাধীন আনন্দের ভিতর তখন ছিল না কোনো শত্রুপক্ষের অনুপ্রবেশ।এখন আমরা সকলেই অনুপ্রবেশকারী,'সকলেই সকলকে আড়চোখে দ্যাখে'।পাঠক পাড়ায় নীল ষষ্ঠীর পুজো দিতে যেত মা,মাইমারা।বার-ব্রত নিয়ে ভরে থাকত আমাদের একান্নভর্তি উঠোন।সদরের চণ্ডীমন্ডপের চাতালে বৈকালিক আড্ডায় পক্বকেশ শিব ভট্টচার্যি,মন্টু খুড়ো,অমরেন্দ্র পাঠক এক এক করে সবাই এসে হাজির হতেন।দীর্ঘক্ষণ পুঁথিপাট চলত,খানিক রসিকতা।বাইরের মাঠে তখন মিড উইকেটের উপর দিয়ে খিড়কির দিকে উড়ে যেত বুবানের এক-একটা ছক্কা।আমরা তখন কেউ শচীন তেন্ডুলকর,কেউ সনৎ জয়সূর্যিয়া।

মামার বাড়ির ঘাড়ভাঙা ধানের মরাইটা এখন শস্যশূন্য,নিঃসাড়।কুলুঙ্গির কুঁজোয় শুকিয়ে গেছে জল।বারান্দার ঘুলঘুলিতে গোলা পায়রার বকমবকম গান গেছে থেমে।এ নিদাঘে নদী টপকে অশ্বত্থ গাছের নীচে বাঁধা বসুঝারায় জলঢালতে যায় না কেউ!চারিদিকে প্রকীর্ণ জঙ্গল।চৈত্রের সঙের নীল চোখ দিয়ে ঝরে পড়ে অশ্রুকণা।বৈশাখের রুদ্রবীণে আজ মহাসংক্রমের করুণ সুর বাজে--জলভরা সন্দেশ,আর দিদার পানের বাটা যেন কোন মৃত্যু কুহকে হারিয়ে গিয়েছে।

তবু,রয়ে যায় নববর্ষের পিছুটান,হালখাতার দিন, চিরায়ত বাঙালিয়ানা, প্রিয়জনের উষ্ণ আলিঙ্গনের স্পর্শ --তারা খসা সময়ের একক 'দিনগুলি,রাতগুলি'...কোনো এক হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালার অপেক্ষায়।

Comments :0

Login to leave a comment